ভূমিকম্পে ঢাকার ৩০০ ভবন ক্ষতিগ্রস্ত; রাজউকের নিষ্ক্রিয়তায় হাইকোর্টের ক্ষোভ
শুক্রবারের ভূমিকম্পে ঢাকার অন্তত ৩০০টি ভবনের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ২৫টি ভবন হেলে পড়েছে। এর মধ্যে ৫টি ভবনকে 'অতি ঝুঁকিপূর্ণ' হিসেবে চিহ্নিত করে সেগুলো ভেঙে ফেলার নির্দেশ দিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। আরও বেশ কিছু ভবনে ফাটল ধরা বা হেলে পড়ার ঘটনা ঘটেছে, যা শহরের নাজুক অবস্থা এবং সরকারের প্রস্তুতি নিয়ে উদ্বেগ বাড়িয়ে তুলেছে।
নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বারবার সতর্ক করা সত্ত্বেও রাজউক ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষ ঝুঁকিপূর্ণ বা অবৈধ ভবনের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় 'আরবান রেজিলিয়েন্স' প্রকল্পের আওতায় ঢাকার বেশ কিছু এলাকার ভবন পরীক্ষা করে দেখেছে রাজউক। ২০২৪ সালে প্রকাশিত জরিপের ফলাফল অনুযায়ী, ঢাকার ২১ লাখ ৪৫ হাজার ভবনের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ ভবন বড় ধরনের (৭ মাত্রার বেশি) ভূমিকম্পে ধসে পড়ার শঙ্কায় রয়েছে। এর মধ্যে বহুতল ভবন আছে ৭৫ হাজারের বেশি।
এর আগে ঢাকায় সরকারিভাবে নির্মিত ৩৭ শতাংশ নতুন ভবনকেই ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এর মধ্যে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (পিজি হাসপাতাল) নতুন ১৭-তলা একটি ভবন ও অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। সরকারি-বেসরকারি ৪২টি স্থাপনাকে অত্যন্ত বিপজ্জনক ঘোষণা করে সেগুলো ভেঙে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিল রাজউক।
এর মধ্যে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি, মাদ্রাসা বোর্ডের তিনটি, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের একটি ও গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্মাণ করা ৩০টি ভবন ছিল। কিন্তু এর কোনোটিই এখনো ভাঙা হয়নি।
হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এইচবিআরআই) তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার বিদ্যমান কংক্রিটের ভবনের ৫৬.২৬ শতাংশই ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিতে আছে। ৩৬.৮৭ শতাংশ আছে মাঝারি ঝুঁকিতে। শুক্রবারের ভূমিকম্পের পর এই ভবনগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটিতেই ফাটল ও হেলে পড়ার ঘটনা ঘটেছে।
রাজউক চেয়ারম্যান মো. রিয়াজুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ৫০টি ভবন ব্যবহার না করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন তারা। সেগুলোর কোনটি মেরামত করা সম্ভব, তা নির্ধারণে পরিদর্শন চলছে। তিনি বলেন, 'আমরা স্কুল এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করছি।'
বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ইশরাত ইসলাম আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থার জরুরি প্রয়োজনিয়তার ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, 'এখন হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আবাসিক হল, বহুতল মার্কেটসহ যেসব এলাকায় জনসমাগম বেশি, সেখানে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করে পরবর্তী ব্যবস্থা নিতে হবে। একদিকে যেমন সরকারি সংস্থাগুলো এতদিন ভূমিকম্প সহনীয় ভবন নির্মাণে জোর দিতে ব্যর্থ হয়েছে, তেমনি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যক্তি পর্যায়েও সচেতনতা ছিল না।'
অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও জলাশয় ভরাট ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও নিরাপত্তা প্রোটোকল মেনে চলার আহ্বান জানান অধ্যাপক ইশরাত।
আইনি ব্যবস্থার নির্দেশ হাইকোর্টের
ক্রমবর্ধমান এই সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে রাজউকের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে রাজউকের এই নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবীকে লিখিতভাবে রিট আবেদন করতে বলেছেন আদালত।
রোববার (২৩ নভেম্বর) আইনজীবী সৈয়দ মাহসিব হোসেন হাইকোর্ট বেঞ্চের সামনে বিষয়টি তুলে ধরলে বিচারপতি ফয়েজ আহমেদ ও বিচারপতি মো. মঞ্জুর আলমের হাইকোর্ট বেঞ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর বিষয়ে রাজউকের দ্রুত পদক্ষেপ চেয়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আইনজীবীকে লিখিত রিট আবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন।
আইনজীবী মাহসিব হোসেন বলেন, দুই দিনে ঢাকায় পরপর চারবার ভূমিকম্প হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, কয়েক দিনের মধ্যে ৭ মাত্রার ভূমিকম্পের সম্ভাবনা রয়েছে। 'তাই রাজউক দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে ক্ষতির পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পাবে।'
শহরের ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো পরিদর্শন ও পরবর্তী করণীয় সুপারিশের জন্য রাজউকের সদস্য (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ) ইরাদুল হকের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে সংস্থাটি। প্রাথমিক প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে এবং সাত ও পনেরো দিনের মধ্যে আরও বিস্তারিত প্রতিবেদন আশা করা হচ্ছে। ভূমিকম্প ঝুঁকি মোকাবিলায় সমন্বয়ের জন্য মন্ত্রণালয় এবং প্রধান উপদেষ্টা পর্যায়েও অতিরিক্ত কমিটি গঠন করা হচ্ছে।
শুক্রবারের ভূমিকম্পের পর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান নিরাপত্তার স্বার্থে সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা ভূমিকম্পের ঝুঁকি কমাতে খোলা জায়গা রাখা, বিল্ডিং কোড বা নির্মাণ বিধিমালা কঠোরভাবে মেনে চলা এবং জনগণের প্রস্তুতির ওপর গুরুত্বারোপ করছেন।
শুক্রবারের ভূমিকম্প দীর্ঘদিনের পুরোনো একটি সমস্যাকে আবারও সামনে এনেছে: হাজার হাজার ভবন অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা সত্ত্বেও রাজউক এখনো একটিও ভাঙেনি। হাইকোর্ট এখন এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হওয়ায় বড় কোনো ভূমিকম্প আঘাত হানার আগেই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে আইনি ও জনমতের চাপের মুখে পড়েছে কর্তৃপক্ষ।
