ঢাকার এত কাছে আগে কি কখনও এই মাত্রার ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল?
রাজধানী ঢাকার ইতিহাসের সবচেয়ে কাছে উৎপত্তিস্থল বা এপিসেন্টারের ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। শুক্রবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে সৃষ্ট ৫.৭ মাত্রার এই ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে পুরো দেশ। নরসিংদীতে সৃষ্ট এই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকার আগারগাঁও আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে মাত্র ১৩ কিলোমিটার পূর্বে।
শক্তিশালী এই কম্পনে এখন পর্যন্ত পুরান ঢাকার তিনজনসহ অন্তত ৪ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া হুড়োহুড়ি করে নামতে গিয়ে ও বিভিন্ন ঘটনায় আহত হয়েছেন শতাধিক মানুষ। রাজধানীতে হেলে পড়েছে কয়েকশ ভবন।
ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার এত কাছে এত বেশি মাত্রার ভূমিকম্প এর আগে কখনও ঘটেনি। কম্পনের স্থায়িত্ব আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড বেশি হলে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের শঙ্কা ছিল।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের (বিএমডি) পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) মো. মমিনুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'এবারের ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ঢাকার একেবারে কাছেই ছিল, ফলে অনুভূত হয়েছে অনেক বেশি। চট্টগ্রামের রাঙামাটি বা খাগড়াছড়িতে যদি ৭ মাত্রার ওপরেও ভূমিকম্প হয়, তাহলে আমরা ঢাকায় এতটা ঝাঁকুনি অনুভব করি না। তবে এই ভূমিকম্পের স্থায়িত্বকাল আর ৫-৭ সেকেন্ড বেশি হলেই ঢাকার অনেক ভবনই ধসে পড়ত। এ ধরনের ভূমিকম্পের সম্মুখীন ঢাকা ও আশপাশের এলাকা আগে কখনও হয়নি।'
সিসমোলজি বা ভূমিকম্প বিষয়ক গবেষক মমিনুল ইসলাম আরও বলেন, 'সাধারণভাবে মনে হতে পারে ৫ মাত্রার ভূমিকম্প থেকে ৬ মাত্রার ভূমিকম্প মাত্র এক পয়েন্ট বেশি। কিন্তু বিষয়টি এমন না। ৫ মাত্রার চেয়ে ৬ মাত্রার ভূমিকম্পের কম্পনের প্রবণতা ১০ গুণ বেশি। এখানে প্রতিটি ভগ্নাংশ মানে এর তীব্রতা তত গুণ বেশি। ফলে এই ভূমিকম্পের প্রবণতা বা তীব্রতা অন্তত ১০০ কিলোমিটার রেডিয়াসে থাকে।'
অতীতের পরিসংখ্যান ও তুলনা
ঢাকা ও এর আশপাশে ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল থাকার ঘটনা অতীতেও ঘটেছে, তবে মাত্রা ছিল কম। এর মধ্যে ২০১২ সালের ১৮ মার্চ ৪.৫ মাত্রা, ২০০৮ সালের ২৬ জুলাই ৪.৮ মাত্রা এবং ২০০১ সালের ১৯ ডিসেম্বর ৪.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। ওই ঘটনাগুলোতে বড় ধরনের হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে ২০১১ সালের ২৬ নভেম্বর চট্টগ্রামে ৬.২ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল।
ঐতিহাসিকভাবেও এ অঞ্চল বড় ভূমিকম্পের সাক্ষী। ১৮৯৭ সালের 'গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়েক' (৮.০ মাত্রা) তৎকালীন অবিভক্ত বাংলায় ১,৫০০-এর বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল। এছাড়া ১৯১৮ সালের শ্রীমঙ্গল ভূমিকম্প (৭.৬ মাত্রা) ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণ হয়েছিল।
ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির শঙ্কা: রাজউকের সমীক্ষা
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)-এর ২০২৪ সালের সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, টাঙ্গাইলের মধুপুর ফল্টে ৬.৯ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানলে ঢাকার ৪০.২৮ শতাংশ থেকে ৬৪.৮৩ শতাংশ ভবন ধসে পড়তে পারে।
সমীক্ষা অনুযায়ী, দিনের ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভূমিকম্প হলে হতাহতের সংখ্যাও ভিন্ন হতে পারে:
সকালে হলে মৃত্যু হতে পারে ২.১ লাখ থেকে ৩.১ লাখ মানুষের; বিকালে হলে এই সংখ্যা ২.৭ লাখ থেকে ৪ লাখ হতে পারে এবং রাতে হলে নিহতের সংখ্যা ৩.২ লাখ থেকে ৫ লাখে পৌঁছাতে পারে।
এছাড়া সিলেটের লিনিয়ামেন্টে (ডাউকি ফল্ট লাইন) ৭.১ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকার ৪০ হাজার ৯৩৫টি থেকে ৩ লাখ ১৪ হাজার ভবন (১.৯১ শতাংশ থেকে ১৪.৬৬ শতাংশ) ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
মধুপুর ফল্টে ৬.৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে অবকাঠামোগত ক্ষতির পরিমাণও হবে ভয়াবহ। এতে প্রধান সড়কগুলোর ৪৯.৬ শতাংশ এবং শহরের ভেতরের সড়কগুলোর ৫৯.৪ শতাংশ ধসে যেতে পারে। সবচেয়ে আশঙ্কাজনক হলো, প্রধান সেতুগুলোর ৯৬.২২ শতাংশ এবং শহরের সেতুগুলোর ৯৬.৭৯ শতাংশ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
আর্থিক ক্ষতির হিসাবে, পরিবহন খাতে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি, পানি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সিস্টেমে ৮৮৭ মিলিয়ন ডলার এবং বিদ্যুৎ অবকাঠামোতে ২৭.১ মিলিয়ন ডলার ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ঝুঁকিতে ঢাকার ভবন ও অবকাঠামো
রাজউকের আওতাধীন এলাকায় বর্তমানে ২১.৫ লাখের বেশি ভবন রয়েছে, যার মধ্যে ৫.১৪ লাখ কনক্রিটের স্থাপনা। সমীক্ষায় ৩ হাজার ২৫২টি ভবন পরীক্ষা করে ৪২টিকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে অবিলম্বে ভেঙে ফেলার সুপারিশ করা হয়েছে।
সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির (সিডিএমপি) সমীক্ষা অনুযায়ী, ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্পে ৭২ হাজার ভবন ধসে পড়বে এবং আরও দেড় লাখ ভবন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশেষ করে দুর্বল মাটির ওপর গড়ে ওঠা বহু পুরনো ভবন এবং বিল্ডিং কোড না মেনে তৈরি করা ছয়তলার বেশি উঁচু ভবনগুলোই হবে প্রধান শিকার।
ঝুঁকির কারণ ও প্রস্তুতিতে ঘাটতি
বিশেষজ্ঞরা ঢাকার ঝুঁকি বাড়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ চিহ্নিত করেছেন। বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ এই শহরে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা বহুতল ভবন, বস্তি এবং সরু রাস্তাগুলো বড় বাধা। অনেক ভবনই ভূমিকম্প সুরক্ষা মানদণ্ড (সিসমিক সেফটি স্ট্যান্ডার্ড) মেনে তৈরি হয়নি, যা এগুলোকে মৃত্যুফাঁদে পরিণত করেছে।
এছাড়া বাংলাদেশের মাটির গঠনগত দুর্বলতাও একটি বড় কারণ। দেশের বড় অংশই আলগা ও জলাবদ্ধ পলিমাটির ওপর গঠিত। শক্তিশালী কম্পনে এই মাটি তরলীকৃত হয়ে যেতে পারে, যা ভবন ধসের কারণ হতে পারে।
জাপান বা ক্যালিফোর্নিয়ার মতো ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চলগুলোতে ব্যাপক জনসচেতনতা, জরুরি মহড়া এবং কার্যকর দুর্যোগ মোকাবিলা ব্যবস্থা থাকলেও বাংলাদেশে এর ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে বলে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
