নির্বাচনী প্রচারণায় আগাম অর্থায়ন: ভবিষ্যৎ লাভের জন্যই কি অর্থ বিনিয়োগ?
এটি ভবিষ্যতের কথা ভেবে লেনদেন করার মতো—আজকের নির্ধারিত দামে কোনো পণ্য ভবিষ্যতের জন্য কিনে রাখা বা বিক্রি করা। এমন লেনদেন প্রায়ই ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ এতে লোকসান বা লাভ উভয়ই হতে পারে। একইভাবে, নির্বাচনের সময়ও মানুষ ভবিষ্যতের জন্য বিনিয়োগ করছেন। তারা হলেন দলের কর্মী, আত্মীয়, বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষী—সমর্থকদের এক বৃহত্তর বলয়, যারা সম্ভাবনাময় কোনো প্রার্থীর ওপর বাজি ধরেন।
নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়ার অনেক আগে থেকেই এই খরচের ধুম পরে যায়। হঠাৎ করেই পাড়া-মহল্লায় সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম ও ছবিসহ পোস্টার ও ব্যানার দেখা যায়। এই প্রচারণার কৃতিত্ব প্রায়ই 'এলাকাবাসী' বা দলীয় উৎসাহীদের দেওয়া হয়। সমর্থনের বহিঃপ্রকাশও ঘটে নানা রূপে—প্রচারণার টি-শার্ট স্পনসর করা, স্লোগান যারা দিচ্ছেন তাদের জন্য চা-পার্টির আয়োজন করা, মোটরসাইকেল শোভাযাত্রার জন্য জ্বালানির খরচ দেওয়া।
একজন প্রার্থীর নির্বাচনী ব্যয়ের একটি সীমা রয়েছে—২৫ লাখ টাকা বা ভোটার প্রতি ১০ টাকা (সর্বোচ্চ)। কিন্তু এই সর্বোচ্চ সীমা প্রযোজ্য হয় আনুষ্ঠানিক নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর। এর আগে ব্যয় করা যেকোনো অর্থ তদারকির বাইরে থেকে যায়।
তবুও, প্রার্থী ও তাদের প্রচারণার আয়োজকরা সতর্ক থাকেন।
বিএনপির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, "দলের মধ্যে কোনও কোনও ব্যবসায়ী টি-শার্ট, খাবার বা নাস্তার ব্যবস্থা করেন। এছাড়া দলের নেতা-কর্মীরা নিজ উদ্যোগে সমাবেশ বা শোভাযাত্রায় অংশ নেন। মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা হলে ইউনিট পর্যায়ের নেতারাই এসবের ব্যবস্থা করেন। এজন্য দলের বাড়তি কোনো খরচ হয় না।"
জামায়াতের এক নেতার কাছ থেকেও অনুরূপ ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে।
জামায়াতের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, "আমাদের নির্বাচনী এলাকাভিত্তিক যে থানা (স্থানীয় ইউনিট) কাঠামো রয়েছে, তার মাধ্যমেই মিছিল বা সমাবেশের জন্য লোক জমায়েত করা হয়। মাঝে মাঝে এমনও হয় যে, দলের কোনো শুভাকাঙ্ক্ষী সকালের নাস্তা বা দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করেন। এছাড়া, ওয়ার্ড ও থানা নেতাদের নেতৃত্বে কর্মীরা উপস্থিত হন।"
আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির মধ্যভাগে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচনে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী এই দুই রাজনৈতিক দল ইতোমধ্যেই দেশের ৩০০টি আসনের বেশিরভাগে তাদের প্রার্থী ঘোষণা বা নির্বাচিত করেছেন। অন্যান্য দল যেমন এনসিপি ও সক্রিয় রয়েছে।
নির্বাচনের তফসিল এখনও ঘোষণা হয়নি। তবুও, রাজধানী ঢাকা এবং অন্যান্য অঞ্চলে প্রচারণা জোরদার হচ্ছে।
রাজধানী ঢাকার ২০টি আসনসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রভাবশালী প্রার্থীরা মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা, গাড়ির বহর এবং হাজার হাজার মানুষের সমাবেশের মাধ্যমে তাদের শক্তি প্রদর্শন করছেন।
শনিবার ঢাকা-১১ আসনের বিএনপি মনোনীত প্রার্থী ড. এম এ কাইয়ুম রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় গাড়ি বহর এবং কয়েক হাজার মানুষ নিয়ে শোভাযাত্রা করেন। তবে বিএনপির নেতারা বলছেন, এই শোভাযাত্রার জন্য দলের আলাদা কোনো খরচ হয়নি, কারণ কর্মীরা তাদের নিজস্ব মোটরসাইকেল নিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছেন।
সেইদিন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আমীর নূরুল ইসলাম বুলবুল তার নির্বাচনী এলাকা চাঁপাইনবাবগঞ্জে কয়েক হাজার মোটরসাইকেল নিয়ে নির্বাচনী শোভাযাত্রা করেন। দলের দাবি, এই শোভাযাত্রায় শুধুমাত্র টি-শার্ট ব্যয় ছাড়া আলাদা কোনো খরচ হয়নি। তবে শুধুমাত্র টি-শার্টের খরচ হিসাব করলেও একদিনের এই শোভাযাত্রায় জামায়াত ৩ লাখ টাকা ব্যয় করেছে।
শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জে নয়, দেশের উত্তরের অনেক জেলাতেও নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে বিএনপি ও জামায়াতের প্রার্থীরা এধরনের শক্তি প্রদর্শনের শোভা আয়োজন করেছেন।
বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলা কৃষক দলের সাধারণ সম্পাদক তোফায়েল আহমেদ সাবু বলেন, "আমাদের আসনের বিএনপি মনোনীত প্রার্থী মীর শাহে আলম শিবগঞ্জের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয়। তিনি যদি কোনো সমাবেশের ঘোষণা দেন, আমরা ইচ্ছা করেই সেখানে যাওয়ার চেষ্টা করি। একসঙ্গে আমরা হাজার হাজার মানুষকেও যাওয়ার জন্য অনুরোধ করি। এই পরিস্থিতিতে কয়েকজনের জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করতে হয়।"
শনিবার কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার এনসিপির প্রধান সমন্বয়ক আবুল কাশেম অভির নেতৃত্বে শতাধিক মোটরসাইকেল এবং কয়েক হাজার মানুষ নিয়ে শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়।
সেই একই দিনে গণঅধিকার পরিষদের সিনিয়র নেতা আবু হানিফ তার নির্বাচনী এলাকা কিশোরগঞ্জ-১-এ শতাধিক মোটরসাইকেল নিয়ে শোভাযাত্রা করেন।
এর একদিন আগে, জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা মহানগর দক্ষিণের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য ও নায়েবে আমীর হেলাল উদ্দিন ঢাকা-৮ সংসদীয় এলাকার হাইকোর্ট, নয়াপল্টন ও মগবাজারে মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা করেন।
শুধু এই ব্যক্তিরা নয়; গত এক সপ্তাহে রাজনৈতিক দলগুলোর অন্তত ৫০ জন প্রার্থী তাদের নিজ নিজ নির্বাচনী আসনে মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা ও বড় জমায়েত করছেন। পাশাপাশি নির্বাচনী আসনের রাস্তা, সড়ক ও ছোট গলিগুলোতে প্রার্থীদের প্রচারের বিভিন্ন ব্যানার ও পোস্টার ঝুলানো হয়েছে।
কালো টাকার ব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নির্বাচনের আগে এ ধরনের শক্তি প্রদর্শন "কালো টাকা" (হিসাববিহীন সম্পদ) ব্যবহারের একটি বহিঃপ্রকাশ। একই সাথে, এই প্রার্থীরা তাদের নিজ নিজ আসনে বিজয় নিশ্চিত করতে নির্বাচনের আগে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছেন, এবং জেতার পর তাদের মূল উদ্দেশ্য হলো সরকারি তহবিল থেকে এই ব্যয়ের কয়েকগুণ উসুল করা।
ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের প্রধান পরিচালক আবদুল আলিম বলেন, "প্রার্থীদের এসব কর্মকাণ্ড নির্বাচন পূর্বকালীন বিনিয়োগের অন্তর্ভুক্ত। যেহেতু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে সম্পন্ন হওয়া নির্বাচন-সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও)-এর আওতায় পড়ে না, সেহেতু এগুলো তার বিধান থেকে মুক্ত। তবে 'দেওয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১২' অনুযায়ী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।"
আলিম নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিটির সাবেক সদস্য ছিলেন। তিনি বলেন, "আমরা কমিশনকে প্রস্তাব দিয়েছিলাম যে এই নির্বাচন পূর্বকালীন কর্মকান্ডকেও আচরণবিধির আওতায় আনা উচিত। কারণ এখন যে টাকা ব্যয় করা হচ্ছে তা হিসাববহির্ভূত; ফলে যারা আর্থিকভাবে ক্ষমতাশালী, তারা বেশি টাকা খরচ করছেন এবং এটি নির্বাচনের ফলাফলে প্রভাব ফেলবে। এছাড়া, এত বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় করা সম্পূর্ণ অনৈতিক।"
নিয়ন্ত্রণের ফাঁকফোকর ও জবাবদিহিতা
বর্তমানে সংসদ নির্বাচনে একজন প্রার্থী সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা বা ভোটারপ্রতি ১০ টাকা (সর্বোচ্চ) খরচ করতে পারেন।
তবে নতুন আইন অনুযায়ী, কোনো নির্বাচনী আসনে ভোটার সংখ্যা বেশি থাকলে প্রার্থী ২৫ লাখ টাকার বেশি ব্যয় করতে পারবেন। উদাহরণস্বরূপ, ৭ লাখ ভোটারের আসনে একজন প্রার্থী সর্বোচ্চ ৭০ লাখ টাকা ব্যয় করতে পারবেন।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ২০২৪ সালের ১২তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর একটি গবেষণা প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, নির্বাচনে প্রার্থীরা গড়ে ১ কোটি ৫৬ লাখ ৮৩ হাজার ৭৭৭ টাকা খরচ করেছেন, যা ব্যয়সীমার ছয়গুণ। সবচেয়ে বেশি ব্যয় করেছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা, গড় সীমার ১১.৪৫ গুণ বেশি। ১২তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা গড়ে ১ কোটি ৬৭ লাখ ৮০ হাজার ১০২ টাকা ব্যয় করেছেন। টিআইবির গবেষণায় আরও প্রকাশিত হয়েছে, ২০১৮ সালের ১১তম সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীরা গড়ে ৭৯ লাখ ৭২ হাজার ৮৭৬ টাকা ব্যয় করেছেন।
বিপুল অর্থ ব্যয় মানে 'লাভের জন্য বিনিয়োগ': টিআইবি
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান নির্বাচনের আগে মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা ও শক্তি প্রদর্শনসহ রাজনৈতিক প্রচারণায় বিপুল অর্থ ব্যয়কে 'লাভের জন্য বিনিয়োগ' হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
তিনি টিবিএসকে বলেন, "বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি আসলে পরিবর্তন হয়নি। ক্ষমতা দখলের জন্য নির্বাচনকেন্দ্রিক প্রতিযোগিতা ও এর বাণিজ্যিকীকরণে কোনো পরিবর্তন আসেনি। ক্ষমতায় টিকে থাকা বা ক্ষমতা পাওয়ার মানসিকতা দেশের ব্যাপক ক্ষতি করছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সাংস্কৃতিক রূপান্তরের কোনো চাহিদা নেই; তারা একসাথে বসতে বা অতীত থেকে শিখতে ইচ্ছুক নয়।"
ড. ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, "রাজনৈতিক দলের কর্মীরা প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন এই আশায় যে পরবর্তীতে তারা নেতাদের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা পাবেন। ব্যবসায়ীরাও এই সুযোগ কাজে লাগাতে রাজনীতিতে ব্যাপকভাবে জড়িত হয়েছে; তাদের কাছে এটি একটি বিনিয়োগের ক্ষেত্র।"
তিনি আরও বলেন, "নির্বাচনের আগে ব্যয়ের তথ্য জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও এটি কার্যকরভাবে অনুসরণ করা হয় না। ব্যয় সীমাবদ্ধতা বাস্তবে কতটা যথাযথভাবে প্রয়োগ হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।"
নির্বাচন পূর্ববর্তী খরচ কিভাবে নিয়ন্ত্রণ হবে?
নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার টিবিএসকে বলেন, "জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আচরণবিধি কার্যকর হবে তফসিল ঘোষণার তারিখ থেকে গেজেট প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত। সমস্যা হলো ভোটার প্রতি ১০ টাকা ব্যয় ইতোমধ্যেই খরচ করা হচ্ছে। প্রতীকও এখনও বরাদ্দ হয়নি—কার টাকা কে খরচ করছে, তা বোঝা কঠিন।"
তিনি আরও বলেন, "নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হলো তফসিল ঘোষণার পর থেকে গেজেট প্রকাশ পর্যন্ত। যদি কমিশন এত ব্যাপক দায়িত্ব এখন নেয়, তাহলে তারা অন্য কাজ কবে করবে? এখন এটি দেখার দায়িত্ব সরকারের।"
নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলি বলেন, "আইনে বলা আছে, ভোটের দিন থেকে তিন সপ্তাহ আগে প্রচারণা করা যাবে না। এখন যদি কেউ প্রচারণা করে, তা দেখা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। কোথাও বলা নেই যে কমিশন তফসিল ঘোষণার আগে কিছু করতে পারবে না। নির্বাচনী প্রচারণা ও ভোট চাওয়া বিষয়টি কমিশনের এখতিয়ারে পড়ে।"
এদিকে, নির্বাচন কমিশন ধারাবাহিক সংলাপ করছে। সম্প্রতি এক সংলাপে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের পরিচালক মুহাম্মদ বদিউজ্জামান বলেন, "আমরা নির্বাচনী ব্যয় বা বিদ্যমান ব্যয়সীমা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিটি নির্বাচনে প্রার্থীরা ব্যয়সীমার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ব্যয় করছেন।"
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, "২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের ব্যয় নির্ধারিত সীমার দ্বিগুণের বেশি ছিল, পরবর্তী নির্বাচনে তিনগুণ এবং ১০ম সংসদ নির্বাচনে চারগুণ। অতিরিক্ত ব্যয় নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি ব্যবস্থা থাকা উচিত।"
তিনি আরও বলেন, "নির্বাচন শেষে প্রার্থী তার ব্যয়ের হিসাব কমিশনে জমা দেন। তবে এটি জনসমক্ষে প্রকাশ করার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এটি বাধ্যতামূলক করা উচিত।"
