কেন মাধ্যমিকে লটারি প্রক্রিয়ায় ভর্তি বাতিল চান সরকারি স্কুলের শিক্ষকরা?
২০২১ সালে কোভিড মহামারির সময় প্রথমবারের মতো সরকারি ও বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ডিজিটাল লটারি পদ্ধতিতে ভর্তি কার্যক্রম শুরু হয়। সেসময় সময় সাময়িকভাবে চালু হওয় লটারি পদ্ধতি এখন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি প্রক্রিয়ার 'স্থায়ী' নিয়মে পরিণত হয়েছে।
গত ২৭ অক্টোবর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতি, যেখানে তারা লটারি পদ্ধতি বাতিলের দাবি জানিয়েছেন।
সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বলছেন, লটারি পদ্ধতিতে ভর্তি কার্যক্রম চালু থাকায় কমে যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা। মেধার ভিত্তিতে ভর্তি পরীক্ষা না থাকায় একই শ্রেণিতে মেধাবী ও অপেক্ষাকৃত দুর্বল শিক্ষার্থী একসঙ্গে পড়ছে, ফলে পাঠদানে ভারসাম্য রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে।
যদিও শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ২০২৬ শিক্ষাবর্ষেও সরকারি ও বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি কার্যক্রম লটারি পদ্ধতিতেই সম্পন্ন হবে।
কেন লটারি পদ্ধতি ভর্তি চাচ্ছেন না শিক্ষকরা?
সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগ, অবকাঠামো ও ঐতিহ্যগত দিক থেকে তুলনামূলকভাবে এগিয়ে থাকায় এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে অভিভাবকদের আগ্রহও বেশি।
লটারি পদ্ধতি চালুর বিষয়ে তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ভর্তি যুদ্ধ নামে 'অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা' বন্ধ করা ও কোচিং ব্যবসার লাগাম টানাই এই পদক্ষেপের লক্ষ্য।
যদিও শিক্ষকরা এখন বলছে, ভর্তি পরীক্ষা থাকলে অন্তত শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা যাচাই করা যেত। এখন লটারিতে সুযোগ পাওয়ায় অনেক শিক্ষার্থী প্রস্তুতির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে না, আবার যারা মনোযোগী, তারাও আগ্রহ হারাচ্ছে। এতে শ্রেণিকক্ষে শেখার আগ্রহ ও মনোযোগ দুটোই কমে যাচ্ছে, যা সরাসরি প্রভাব ফেলছে শিক্ষার মান ও বিদ্যালয়ের ফলাফলে।
'বাংলাদেশ সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতি'র সদস্যসচিব ও ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক মো. আব্দুল মূবীন দ্য বিজনেজ স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'একই ক্লাসে মেধাবী ও অপেক্ষাকৃত দুর্বল শিক্ষার্থীকে একসাথে সমানভাবে শেখানো কঠিন হয়ে পড়ে। আমি চল্লিশ মিনিট ক্লাস নেই, কখন এদেরকে বোঝাবো, কখন নিয়ন্ত্রণ করব। যে অল্প কয়েকজন মনোযোগী থাকে তারাও আগ্রহ হারায়।সরকারি সিদ্ধান্ত আমরা মানতে বাধ্য, কিন্তু আমরা বিষয়গুলো বলার চেষ্টা করছি।'
তিনি আরও বলেন, অভিভাবকরা প্রায়শই বলছেন— ভর্তি পরীক্ষা হলে, আমার বাচ্চা যদি কোয়ালিফাই না করে তাহলে আমি অন্তত বুঝতে পারব আমার বাচ্চার ঘাটতি আছে। যখন লটারির মাধ্যমে হয় তখন সে সুযোগ থাকছেই না বরং এই প্রক্রিয়া শিক্ষার্থী এবং অভিভাবক সবার উপর মানসিকভাবে প্রভাব ফেলছে।
'বাংলাদেশ সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতি' নামে বর্তমানে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আরও ছয়টি সংগঠন সক্রিয় থাকার কথা জানা যায়। নিজেদের মধ্যে নানা বিভক্তি থাকলেও প্রত্যেকটি সংগঠনই সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে লটারি পদ্ধতি বাতিল ও পুনরায় ভর্তি পরীক্ষা চালুর পক্ষে।
সবুজবাগ সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক আবদুস সালাম বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
দ্য বিজনেজ স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, আমি এ বিদ্যালয়ে একসময় দেখেছি শিক্ষার্থীরা প্রচুর আগ্রহী পড়াশুনায়। সেসময় প্রচুর প্রতিযোগিতা ছিল, কিন্তু লটারি ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর এখন তা একদমই কমে যাচ্ছে। আমরা চাই, মেধা বিকাশের জন্য সব জায়গায় প্রতিযোগিতা তৈরি হোক।
ময়মনসিংহ জেলার একটি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দ্য বিজনেজ স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, লটারি শুধু প্রথম শ্রেণির জন্য ঠিক আছে। কিন্ত অন্যান্য শ্রেনীতে ভর্তির ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা আগের শ্রেণিগুলো সম্পন্ন করেছে কি না তা যাচাই করা যায় না। একেবারে স্কুলেই যায়নি এমন শিক্ষার্থীও লটারিতে আবেদন করতে পারছে এবং ভর্তির সুযোগও পাচ্ছে। ফলে শ্রেণিকক্ষে মিশ্র অভিজ্ঞতা সম্পন্ন শিক্ষার্থী থাকছে। যারা পূর্ববর্তী শ্রেণিগুলো সম্পন্ন করেনি তাদের এগিয়ে নেওয়া একেবারেই দূরুহ ব্যাপার।
উদাহরণ টেনে এই প্রতিষ্ঠান প্রধান বলেন, প্রথম শ্রেণি যে বাচ্চাটা সম্পন্ন করেনি তাকে দ্বিতীয় শ্রেণি, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি সম্পন্ন না করা শিক্ষার্থীকে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ানো খুবই কষ্টকর।
সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর ভর্তি প্রক্রিয়া নিয়ে দেশের অন্তত আটটি জেলা শহরের সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাথে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তাদের প্রায় প্রত্যেকেই 'লটারি পদ্ধতি'তে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে একই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা জানান।
যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান দ্য বিজনেজ স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, লটারি কিংবা ভর্তি পরীক্ষা কোনোটাই শিক্ষাব্যবস্থার জন্য যৌক্তিক না। বিশেষ করে, লটারি সিস্টেম বাজে সিদ্ধান্ত। বৈশ্বিক মানদন্ড ও নিয়ম অনুযায়ী আমাদের উচিত, ক্যাচমেন্ট এরিয়া অনুযায়ী ভর্তি করানো। অর্থাৎ বিদ্যালয়ের পাশে যারা থাকে তারা সে স্কুলে পড়বে।
তিনি আরও বলেন, এ ব্যবস্থা চালু করতে হলে বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে মানের সমতা আনতে হবে—একই পাঠ্যক্রম, একই পাঠ্যপুস্তক, একই অবকাঠামো ও যোগ্য শিক্ষক থাকতে হবে। এজন্য শিক্ষায় অন্তত জিডিপির ৫ শতাংশ বরাদ্দ দিতে হবে। কিন্তু আমরা দিচ্ছি কখনো ১.৭, কখনো ১.৯ শতাংশ—এভাবে আসলে সম্ভব নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ড. এস এম হাফিজুর রহমান দ্য বিজনেজ স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমি কিসের উপর ভিত্তি করে শিক্ষার্থীদের ভর্তির সুযোগ দিচ্ছি, সেটা একটা বড় বিষয়। আমাকে মেধা যাচাই করতে দিতে হবে, তা লটারি দিয়ে হয় না। এটা ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়ে আসা উচিত।'
