নভেম্বরে আরও বৃষ্টির পূর্বভাসে শঙ্কায় কৃষকেরা
অবিরাম বৃষ্টিতে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার ফসলি জমি প্রায় তলিয়ে গেছে। এতে আমন ধান, আলু, কাঁচামরিচ, ভুট্টা ও শীতকালীন সবজি চাষীরা মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় 'মোন্থা'র প্রভাবে গত বৃহস্পতিবার থেকে রোববার পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হালকা, মাঝারি ও ভারি বৃষ্টিপাত হয়েছে। এরমধ্যেই রয়েছে মাঠে আমন ধান, আলু, পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ, ভুট্টা, সরিষা, শীতকালীন সবজি ও বিভিন্ন ডাল–তেলবীজ।
বিভিন্ন জেলার কৃষকরা জানিয়েছেন, টানা চার দিনের বৃষ্টিতে পাকতে শুরু করা আমন ধান, আলু ও ভুট্টার জমি পানিতে ডুবে গেছে। ক্ষতি কমাতে অনেকে পানির নিচে থাকা জমি থেকে বীজ আলু তুলে ফেলছেন, যাতে সেগুলো পচে না যায়। পরে বাড়িতে এনে সংরক্ষণের চেষ্টা করছেন তারা।
এছাড়া নভেম্বরে আরও ২–৩টি নিম্নচাপের আশঙ্কা থাকায় নতুন করে ভারি বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাসও রয়েছে। এতে কৃষকরা আশঙ্কায় রয়েছেন, কারণ দীর্ঘস্থায়ী পানিতে ফসলের রোগবালাই ছড়িয়ে পড়তে পারে।
বগুড়ার শেরপুর উপজেলার আমইন এলাকার কৃষক জাহাঙ্গীর আলম জানান, "এখন ধান কাটার সময়। কিন্তু হঠাৎ বৃষ্টি এসে সব নষ্ট করে দিল। জমিতে পানি জমে গেছে, অনেক ধানগাছ শুয়ে পড়েছে। কয়েক দিনের মধ্যেই পোকা ধরবে, কিছু ধান পচে যেতে পারে, আবার চিটাও হয়ে যাবে। এই ক্ষতি সামাল দেওয়া সত্যিই কঠিন।"
শুধু বগুড়াই নয়, কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১৬টি জেলায় ঝড় ও বৃষ্টিপাতে গত বৃহস্পতিবার থেকে রোববার পর্যন্ত প্রায় ২৬ হাজার হেক্টর ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে আমন ধানে—প্রায় ২১ হাজার হেক্টর। এছাড়া ১,৬০০ হেক্টর সবজি, ৫৫২ হেক্টর পেঁয়াজ এবং ১,৩৪৮ হেক্টর সরিষার জমি ক্ষতির মুখে পড়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এ বছর ৫৭ লাখ হেক্টর জমিতে আমন ধানের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত ১.৭৬ লাখ হেক্টর জমির ধান কাটা হয়েছে। বেশিরভাগ জমির ধান এখন পরিপক্কতার পর্যায়ে, কিন্তু এ সময় জমিতে পানি ওঠায় বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা।
ধান ছাড়াও ভুট্টা, আলু, পেঁয়াজ, মরিচ, মাসকলাইসহ নানা ফসলের ক্ষতি হয়েছে। বগুড়ার শেরপুর উপজেলার ভুট্টাচাষী শহিদুল ইসলাম শাওন জানান, "২০ দিন আগে ১৬ বিঘা জমিতে ভুট্টা রোপণ করেছি। শ্রমিক, বীজ ও সার মিলে দেড় লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এবার ভালো ফলনের আশা ছিল। কিন্তু দুদিনের বৃষ্টিতে সব তলিয়ে গেছে। অধিকাংশ বীজ পচে যাবে, খরচ আর শ্রম—দুটোই এখন দ্বিগুণ হচ্ছে আমাদের।"
ক্ষয়ক্ষতি কমাতে মাঠপর্যায়ে কৃষকদের বিভিন্ন পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কৃষি কর্মকর্তারা। বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সোহেল মো. শামসুদ্দীন ফিরোজ বলেন, "রোপা আমন ধানের জমি থেকে পানি নিষ্কাশনের জন্য সব উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাকে জরুরি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।"
"আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে দুই–তিন দিনের মধ্যে পানিতে নুয়ে পড়া ধানের তেমন ক্ষতি হবে না। হেলে পড়া ধানগাছগুলো ঝুঁটি বেঁধে দিলে ক্ষতি আরও কমানো যাবে। পানি দ্রুত সরিয়ে নেওয়ার বিকল্প নেই," বলেন তিনি।
ক্ষতির চক্রে আলুচাষীরা
সর্বশেষ মৌসুমে আলুর উৎপাদন বেশি হওয়ায় শুরু থেকেই খরচ তুলতে পারেননি কৃষকরা। যারা আলু মজুদ করেছিলেন, তাদের প্রতিকেজিতে ১৫–২০ টাকা পর্যন্ত লোকসান গুনতে হয়েছে। মৌসুমে যারা বিক্রি করেছিলেন, তারাও উৎপাদন খরচের অর্ধেক দামে আলু বিক্রি করতে বাধ্য হন। ফলে কৃষকরা এবার আলু চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন বলে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন।
এর মধ্যে যেসব কৃষক আগাম আলু রোপণ করেছিলেন, তারাও বৃষ্টিতে বিপাকে পড়েছেন। অনেকেই জমিতে রোপন করা আলু তুলে ফেলেছেন, যাতে বীজ পচে না যায়। কারও কারও বীজ আলু ইতোমধ্যেই নষ্ট হয়ে গেছে।
রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার মাড়িয়া চাম্পাকুড়ি এলাকার কৃষক সোহরাব হোসেন জানান, তিনি এবার ১২ কাঠা জমিতে আগাম আলু চাষ করেছিলেন। ভোক্তাদের মধ্যে নতুন আলুর চাহিদা থাকায় তিনি আগাম চাষে বাড়তি লাভের আশায় ছিলেন। কিন্তু গত শুক্রবার রাতের ভারি বৃষ্টিতে তার সব জমি পানিতে ডুবে আলু নষ্ট হয়ে গেছে।
সোহরাব বলেন, "গত বছর আলুর দাম না পেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলাম। তাই এবার ঝুঁকি কমাতে কম জমিতে আগাম আলু করেছি, যাতে বেশি দামে বিক্রি করতে পারি। কিন্তু এক রাতের বৃষ্টিতে সব শেষ।"
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, এ পর্যন্ত কৃষকরা প্রায় ২৩ হাজার হেক্টর জমিতে আগাম আলু চাষ করেছেন। তবে চলমান ক্ষতির কারণে অনেকেই এবার চাষ থেকে সরে আসতে পারেন বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
রবি মৌসুম বিলম্বিত হওয়ার আশঙ্কা
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ টিবিএসকে বলেন, "নভেম্বরে সাধারণত বৃষ্টি হয় না। এবারের বৃষ্টিপাতের ধরণ একেবারেই ভিন্ন—টানা ও দীর্ঘস্থায়ী বৃষ্টি হচ্ছে। এই সময়ে কৃষকরা আগাম আলু ও শীতকালীন সবজি রোপণ করেন, কিন্তু এবারের বৃষ্টিতে এসব ফসল নষ্ট হয়ে যাবে। যেগুলো টিকে থাকবে সেগুলোর ফলন কমবে, রোগবালাই বাড়বে।"
তিনি আরও বলেন, "সবজির বীজ এখন অনেক দামি। অনেক কৃষকই লোকসানের কারণে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেন না। এতে কৃষকরা আবাদ কমিয়ে দেবেন। একইভাবে আমন ধানের গুণগত মানও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আবার বৃষ্টি হলে রবি শস্য ও শীতকালীন সবজি আরও ক্ষতির মুখে পড়বে।"
অধ্যাপক ফারুক আহম্মেদ জোর দিয়ে বলেন, "আবহাওয়ার পূর্বাভাস কৃষকদের কাছে সময়মতো পৌঁছানো অত্যন্ত জরুরি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এমন অনিয়মিত বৃষ্টিপাত বাড়ছে, তাই আমাদের আবহাওয়া সতর্কতা ব্যবস্থায় আরও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।"
তিনি আরও জানান, "এবারের অসময়ের বৃষ্টির কারণে রবি মৌসুম ইতোমধ্যে পিছিয়ে গেছে। কৃষকরা এবার আগাম আলু ও সবজির চাষ অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছেন।"
নভেম্বরে আরও বৃষ্টির পূর্বাভাস
আবহাওয়া অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নভেম্বর মাসে আরও দুই থেকে তিনটি নিম্নচাপের আশঙ্কা রয়েছে, যার মধ্যে একটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে। এসবের প্রভাবে সারাদেশে আবারও ভারি বৃষ্টিপাত হতে পারে।
আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ভারতের পশ্চিমবঙ্গ অঞ্চলের আকাশে কিছু মেঘমালা এখনো অবস্থান করছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের ওপর স্থানীয়ভাবে মেঘ তৈরি হচ্ছে, যার ফলে ঢাকা, যশোর, কুষ্টিয়া ও ফরিদপুরসহ কিছু এলাকায় বৃষ্টিপাত হচ্ছে। আগামী ৫ নভেম্বরের পর কিছু এলাকায় আবারও বৃষ্টি হতে পারে।"
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর (বিএমডি) জানায়, পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগর ও মিয়ানমার উপকূলের সংলগ্ন এলাকায় একটি নিম্নচাপ সক্রিয় রয়েছে, যা উত্তর–উত্তর-পশ্চিমমুখে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ উপকূল বরাবর অগ্রসর হতে পারে।
বিএমডির তথ্যমতে, গত সপ্তাহে রাজশাহী, রংপুর ও ময়মনসিংহ বিভাগে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি বৃষ্টি হয়েছে।
আবহাওয়াবিদ ড. মো. বজলুর রশিদ বলেন, "অক্টোবর মাসে সাধারণত বৃষ্টিপাত কম হয়। কিন্তু এ বছর পরিস্থিতি ভিন্ন ছিল। অক্টোবরের শুরুতে বরিশালে দুই–তিন দিনের মধ্যে অস্বাভাবিকভাবে ভারি থেকে অতি ভারি বৃষ্টি হয়েছে।"
তিনি আরও জানান, এ বছর ১৩ অক্টোবর রাজশাহী, রংপুর, ঢাকা, ময়মনসিংহ ও খুলনা বিভাগ থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু (মনসুন) বিদায় নেয়, আর ১৪ অক্টোবরের মধ্যে সারা দেশ থেকে মৌসুমি বায়ুর সমাপ্তি ঘটে।
নভেম্বরে বিএমডির দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, বঙ্গোপসাগরে ২–৩টি নিম্নচাপ সৃষ্টি হতে পারে, যার মধ্যে একটি ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বিএমডির তথ্য অনুযায়ী, গত অক্টোবর মাসে রাজশাহীতে ১৭৭ মিমি বৃষ্টি হয়েছে, যা স্বাভাবিকের তুলনায় ৩২ শতাংশ বেশি; রংপুরে হয়েছে ২২৩ মিমি, যা ৪৩ শতাংশ বেশি; ময়মনসিংহে ১৩ শতাংশ বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে এবং ঢাকায় স্বাভাবিকের চেয়ে ৫.২ শতাংশ বেশি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সরেজমিন উইংয়ের পরিচালক মো. ওবায়দুর রহমান মণ্ডল টিবিএসকে বলেন, "আমন ধানের কিছু জমি জলমগ্ন হয়েছে। কৃষকরা এখন আট–দশটি গাছ একসাথে বেঁধে সোজা করে দাঁড় করিয়ে রাখছেন, যাতে গাছগুলো না পচে।"
তিনি বলেন, "তবে বপন করা সবজির বীজ আর দুই–চার দিনের মধ্যেই নষ্ট হয়ে যাবে। আমরা কৃষকদের এসব পরিস্থিতি মোকাবেলায় নিয়মিত পরামর্শ দিচ্ছি।"
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব?
কানাডার ইউনিভার্সিটি অব সাসকাচেওয়ানের আবহাওয়া ও জলবায়ুবিষয়ক পিএইচডি গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ বলেন, পৃথিবীর তাপমাত্রা প্রতি ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে বায়ুমণ্ডলে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ প্রায় ৭ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।
তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, "জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ক্রমাগত বাড়ছে। এর ফলে বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণও বাড়ছে, যা ভারি বৃষ্টিপাতের মূল কারণ।"
তিনি আরও বলেন, "জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এখন ঘূর্ণিঝড়, নিম্নচাপগুলো ভূমির দিকে ধীরে অগ্রসর হয় এবং আগের তুলনায় দীর্ঘ সময় স্থায়ী হয়। এতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও বেড়ে যাচ্ছে।"
প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন টিবিএসের বগুড়া প্রতিনিধি খোরশেদ আলম এবং রাজশাহী প্রতিনিধি বুলবুল হাবিব।
