মেট্রোর আগের দুর্ঘটনার তদন্ত কমিটি করণীয় বললেও মূল দায়ীদের চিহ্নিত করতে পারেনি: বিশেষজ্ঞরা
মাত্র দুটি পিয়ারের ব্যবধান। এক বছর আগে ৪৩০ নম্বর পিয়ারের একটি বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়েছিল। তারপর রোববার (২৬ অক্টোবর) একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল—এবার ৪৩৩ নম্বর পিয়ারের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে, যাতে একজন পথচারীর মৃত্যু হয়েছে। দুটি ঘটনাই ঘটেছে একই এলাকায়, ফার্মগেট মেট্রো স্টেশনের কাছে। সর্বশেষ ঘটনার পর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগের ঘটনার পর সমস্যার সমাধান করা হলে এই পুনরাবৃত্তি ঠেকানো যেত।
আগের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রতিবেদনটিতে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঠেকাতে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার সুপারিশ করা হলেও, এর জন্য কারা দায়ী তা চিহ্নিত করা হয়নি। ওই প্রতিবেদন কখনও জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি বা এটি নিয়ে আলোচনাও হয়নি।
গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার পর গঠিত ওই তদন্ত কমিটির সুপারিশগুলোর মধ্যে ছিল: সব বাঁকানো অংশে, ঢালু অংশে এবং স্টেশনের প্রবেশ ও প্রস্থানের পথ বরাবর বিয়ারিংয়ের অবস্থান সশরীরে পরীক্ষা করতে হবে। পাশাপাশি রেকর্ডের জন্য সব বিয়ারিংয়ের অবস্থান ড্রোন দিয়ে ছবি তুলে সংরক্ষণ করতে হবে। স্বল্পমেয়াদি সুপারিশের মধ্যে ছিল সেকশনের ট্র্যাকের প্যারামিটার পরীক্ষা, ক্ষতিগ্রস্ত পিয়ারে ল্যাটারাল প্রোটেকশন স্থাপন ও এক মাসের মধ্যে খুলে পড়া বিয়ারিংটি বদলে নতুন একটি স্থাপন করা।
তদন্ত কমিটি আরও বলেছিল, ঠিকাদারকে অবশ্যই বিয়ারিং প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের মান নিশ্চিতকরণ সনদ জমা দিতে হবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, ঢাকা মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার ঘটনা এবং তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, এটি নিছক কোনো দুর্ঘটনা নয়। এটি নির্মাণ ত্রুটি ও নিম্নমানের উপাদান ব্যবহারের ফল বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এই যোগাযোগ ও অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, 'এত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান এত দ্রুত প্রতিস্থাপনের সুপারিশ প্রমাণ করে যে, কাজটি সঠিক মানদণ্ড মেনে করা হয়নি।'
এমআরটি লাইন-৬-এ একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি এড়াতে বিয়ারিং প্যাড ও এর বেজ-এর বিস্তারিত নকশা ও স্থাপন পদ্ধতি পর্যালোচনা করার পরামর্শও দিয়েছিল আগের তদন্ত কমিটি। দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা হিসেবে ডিএমটিসিএল নেটওয়ার্কের অন্যান্য এমআরটি লাইনেও, বিশেষ করে বাঁক ও ঢালু অংশগুলোতে, একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি এড়াতে মূল কারণ অনুসন্ধান এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়।
গত বছরের ঘটনার সম্ভাব্য কারণগুলোর মধ্যে কয়েকটি কাঠামোগত বিষয় চিহ্নিত করা হয়। যেমন, ট্রেন চলাচলের কারণে গার্ডারের বারবার বিচ্যুতি, কেন্দ্রবিমুখী বলের প্রভাব এবং ট্র্যাক, বাঁকানো অংশ ও ট্র্যাকের কাঠামোর ওপর তাপমাত্রার পরিবর্তনের প্রভাব।
তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রকৃতপক্ষে পি৪৩০-এর যেদিকে বিয়ারিং খুলে পড়েছে, সেই একই দিকে পি৪২৮ ও পি৪২৯-এর বিয়ারিংগুলোতেও সামান্য 'শিয়ার ডিফরমেশন' দেখা গেছে। এটি ট্র্যাক বিশেষজ্ঞ, কাঠামো ও এবং সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারের বিশ্লেষণ করা উচিত বলে সুপারিশ করা হয় প্রতিবেদনে।
ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, রাবার বিয়ারিংয়ের উপাদানের মধ্যে নির্দিষ্ট কোনো একটি উপাদান—যা ওজোনজনিত ক্ষয় মোকাবিলার জন্য ব্যবহার করা হয়—উপরিভাগের স্লিপ-রেজিস্ট্যান্স কমিয়ে দিতে পারে।
বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান টিবিএসকে বলেন, 'পরপর একই স্থানে দুটি বিয়ারিং প্যাডের দুর্ঘটনা প্রায় একই ধরনের কারণে ঘটতে পারে। এর মূল কারণ নকশাগত ত্রুটি ও বাঁক—যা গত দুর্ঘটনার সময়েও আমরা বলেছি। কিন্তু তদন্ত কমিটি হওয়ার পরে সুপারিশ কিংবা তাদের কার্যক্রম আমরা জানতে পারিনি। যদি তখন সুপারিশ অনুযায়ী কাজ হতো, তাহলে একই স্থানে এধরণের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে না।'
গত বছরের কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল কি না জানতে চাইলে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফারুক আহমেদ বলেন, 'আমরা তদন্ত কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী তখনই বিয়ারিংগুলো পর্যবেক্ষণ করেছি এবং বিশেষজ্ঞদের দিয়েও চেক করানো হয়েছে। তখন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তির ডিফেক্ট লায়ালিটি [ত্রুটিজনিত দায়] অনুযায়ী ঠিক করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। একইসাথে আমাদের টিম নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করেছে এবং তাতে এই অংশে কোনো সমস্যা পাওয়া যায়নি।'
আগের তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন ডিএমটিসিএলের পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) আব্দুল বাকী মিয়া। তিনিও টিবিএসকে বলেন, ডিএমটিসিএল তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুসারেই কাজ করেছে।
ওই কমিটির আরেক সদস্য নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, 'আমাদের রিপোর্ট দেওয়ার পরে সুপারিশ অনুযায়ী কিছু কাজ সম্পন্ন হয়েছিল। [রোববার] যে জায়গায় দুর্ঘটনা হয়েছে, সেখানেও কিছুদিন আগে রুটিন চেকআপ হয়েছে।'
আগের ঘটনার জন্য দায়ীদের চিহ্নিত করা হয়নি
নির্মাণ চুক্তি অনুযায়ী, ওয়ারেন্টি বা গ্যারান্টির মেয়াদ থাকা অবস্থায় যেকোনো ত্রুটি ঠিকাদারকে নিজ খরচে প্রতিস্থাপন বা মেরামত করতে হবে।
অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, তদন্ত প্রতিবেদনে স্বল্প সময়ের মধ্যে বিয়ারিং প্যাড প্রতিস্থাপনের সুপারিশ করা হলেও এর খরচ কে বহন করবে—ঠিকাদার নাকি ডিএমটিসিএল—তা স্পষ্টভাবে বলা হয়নি।
তিনি বলেন, 'যদি ডিএমটিসিএল এই খরচ বহন করে, তবে এটি ভুল সংস্কৃতি তৈরি করবে, যেখানে নিম্নমানের কাজের জন্য কেউ দায়ী থাকবে না। তাই ঠিকাদারের কাছ থেকে প্রতিস্থাপন ও আনুষঙ্গিক ক্ষতিপূরণ আদায় করা অত্যাবশ্যক।'
তিনি মনে করেন, সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে জবাবদিহির আওতায় আনলে ঠিকাদার ও তদারকি সংস্থাগুলো ভবিষ্যতে আরও সতর্কভাবে কাজ করতে এবং উচ্চ মানদণ্ড বজায় রাখতে বাধ্য হবে।
শামসুল হক আরও বলেন, 'তদন্ত কমিটি কেবল "কী করতে হবে", তার পরামর্শ দেওয়ায় সীমাবদ্ধ থাকলে অবহেলাজনিত কাজ করার সংস্কৃতি দূর হবে না। কমিটির উচিত ছিল সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেওয়া যে, এই নিম্নমানের কাজের জন্য কারা দায়ী।'
গত বছর এমআরটি নিজেদের মধ্য থেকেই তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল, এমনকি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকেও কমিটিতে রেখেছিল। কমিটিতে কোনো স্বতন্ত্র সদস্য ছিলেন না।
গত বছরের সাত সদস্যের কমিটির মধ্যে পাঁচজনই ছিলেন ডিএমটিসিএলের; বাকি দুজন ছিলেন পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এনকেডিএম অ্যাসোসিয়েশনের।
খোদ তদন্ত কমিটি নিয়েই সন্দেহ প্রকাশ করে অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, 'এমআরটির ঠিকাদার কিংবা ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত কিংবা পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতার কারণেই এই দুর্ঘটনা; কিন্তু তাদের নিয়েই গত বছর কমিটি হয়েছিল। এক্ষেত্রে সঠিক কারণ এবং পরবর্তী ব্যবস্থা কী নেবে, সেটা তাদের মতো করে তৈরি করাটাই স্বাভাবিক। এ কারণেই দুর্ঘটনার মূল কারণ ও ত্রুটিগুলো জনসম্মুখে আসেনি।'
রোববারের দুর্ঘটনার পর সেতু বিভাগের সচিব মোহাম্মদ আবদুর রউফকে আহ্বায়ক করে ছয় সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটিতে সদস্য হিসেবে রয়েছেন বুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক এবিএম তৌফিক হাসান, মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. জাহিদুল ইসলাম, ডিএমটিসিএলের (লাইন-৬) প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুল ওহাব ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) একজন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী। আর উপসচিব আসফিয়া সুলতানা কমিটিতে সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন।
