সংশোধিত এডিপিতে এমআরটি লাইন–১-এর বরাদ্দ কমলো ৯১%, লাইন–৫-এ কমেছে ৬০%
বড় দুই মেট্রোরেল প্রকল্পের উন্নয়ন বরাদ্দ রেকর্ড পরিমাণে কমিয়েছে সরকার। এর মধ্যে এমআরটি লাইন-১–এর বরাদ্দ সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (আরএডিপি) কমেছে ৯০ শতাংশেরও বেশি।
কর্তৃপক্ষ বলছে, দরপত্র প্রক্রিয়া থেমে থাকা, প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি এবং অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে প্রকল্প ব্যয় পুনর্মূল্যায়নের চলমান প্রক্রিয়ার কারণে এ কাটছাঁট করা হয়েছে।
এদিকে, এমআরটি লাইন–৫-এর উত্তরাংশের বরাদ্দও প্রায় ৬০ শতাংশ কমানো হয়েছে। একই সঙ্গে ঢাকা বিমানবন্দর সম্প্রসারণ, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরসহ অন্যান্য বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্পের ব্যয় চাহিদা আগের পূর্বাভাসের তুলনায় কমে যাওয়ায় বরাদ্দও কমানো হয়েছে।
প্রকল্প কর্তৃপক্ষের মতে, আন্তর্জাতিক দরপত্রে জটিলতা ও সীমিত অগ্রগতির কারণে চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ দেওয়া অর্থ ব্যবহারের সুযোগ কমে গেছে।
এদিকে ব্যয় বৃদ্ধি, চুক্তির ধীরগতি এবং পরিকল্পনায় দুর্বলতা নিয়ে উদ্বেগের মাঝেই অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন বড় প্রকল্প পুনর্মূল্যায়নের নির্দেশ দিয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলোকে।
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশে মেট্রোরেলের নির্মাণব্যয় বিশ্বের অন্যান্য শহরের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। এ কারণেই জাইকার সঙ্গে প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিক ব্যয় পর্যালোচনা শুরু করা হয়েছে। এই পর্যালোচনা সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত দরপত্র প্রক্রিয়া আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে।
এদিকে, পরিবহন খাতে বড় ধরনের কাটছাঁট হলেও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের বরাদ্দ অপরিবর্তিত রয়েছে। তবে দ্রুত অগ্রগতির কারণে ঢাকা–আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের বরাদ্দ বাড়ানো হতে পারে।
সংশোধিত বরাদ্দ চূড়ান্ত করতে পরিকল্পনা কমিশন চলতি মাসের মধ্যেই কাজ শেষ করবে এবং জানুয়ারির শুরুতে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের বৈঠকে তা অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে বলে জানা গেছে।
পুনর্মূল্যায়নে স্থবির প্রকল্প
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বেশ কয়েকটি প্রকল্পের ব্যয় পুনর্বিবেচনা করা হচ্ছে। এর ফলে এমআরটি লাইন–১ এবং লাইন–৫ (উত্তরাংশ) প্রকল্পের কার্যক্রম প্রায় স্থবির হয়ে আছে।
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) কর্মকর্তারা বলেন, চলমান ও সম্পন্ন প্রকল্পগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে—বাংলাদেশে মেট্রোরেলের নির্মাণ ব্যয় সবচেয়ে বেশি। ভারতের তুলনায় এ ব্যয় পাঁচ গুণ বেশি। এমনকি সৌদি আরবের রিয়াদ ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইতেও প্রতি কিলোমিটারের নির্মাণ ব্যয় বাংলাদেশের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম, যদিও তারা আরও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে।
এই কারণে চলমান মেট্রোরেল প্রকল্পগুলোর ব্যয় পুনর্মূল্যায়ন করা হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে প্রথমবারের মতো জাইকার সঙ্গে প্রকল্প ব্যয় পর্যালোচনার আলোচনা শুরু করছে ডিএমটিসিএল।
এই পর্যালোচনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত দরপত্র প্রক্রিয়া স্থগিতই থাকবে। ফলে চলতি অর্থবছরে উল্লেখযোগ্য ব্যয় হওয়ার সুযোগ নেই, আর এ কারণেই বরাদ্দের বড় একটি অংশ ফেরত পাঠানো হবে।
এমআরটি লাইন–১ প্রকল্প
চলতি অর্থবছরের এডিপিতে বিমানবন্দর–কমলাপুর এমআরটি লাইন–১ প্রকল্পের বরাদ্দ ছিল ৮,৬৩১.৪৩ কোটি টাকা। তবে সংশোধিত এডিপিতে প্রস্তাবিত বরাদ্দ মাত্র ৮০১ কোটি টাকা। ফলে এ প্রকল্পের বরাদ্দ কমেছে প্রায় ৯০.৭২ শতাংশ।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো যে চাহিদা পাঠায়, তার ভিত্তিতেই আরএডিপি বরাদ্দ নির্ধারণ করা হয়। যেহেতু এ প্রকল্পের জন্য বাস্তবায়নকারী সংস্থা কোনো অর্থ চাইনি, তাই কমিশন বরাদ্দ কমানোর প্রস্তাব করেছে।
এমআরটি লাইন–৫ উত্তরাংশ
চলমান এমআরটি লাইন–৫ উত্তরাংশ (হেমায়েতপুর–বাটারা) প্রকল্পের বরাদ্দও প্রায় ৬০.২৩ শতাংশ কমানো হচ্ছে। এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ১,৪৯০.৬৫ কোটি টাকা, যা সংশোধিত এডিপিতে কমিয়ে ৫৯২.৮০ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে।
এমআরটি লাইন–১ এবং লাইন–৫ উত্তরাংশ প্রকল্পের পরিচালক মো. আফতাব হোসেন খান টিবিএসকে বলেন, দরপত্র প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়ায় এখনই বরাদ্দের অর্থ ব্যবহার করা যাচ্ছে না। "আন্তর্জাতিক দরপত্রে বিভিন্ন জটিলতা ও ধাপ রয়েছে, এবং ডিএমটিসিএল এসব নিয়ে কাজ করছে। দরপত্রে বিলম্ব হওয়ায় ব্যয়ের সুযোগ কমে গেছে, ফলে আরএডিপিতে বরাদ্দ ফেরত যাচ্ছে।"
দেশের চলমান তিনটি মেট্রোরেল প্রকল্প নির্মিত হচ্ছে জাইকার অর্থায়নে। এর মধ্যে এমআরটি-৬ (উত্তরা–কমলাপুর) প্রায় সমাপ্তির পথে। জাইকার অর্থায়নে বাস্তবায়িত ৫৩,৯৭৭ কোটি টাকার এমআরটি লাইন–১ এবং ৪১,২৩৮.৫৫ কোটি টাকার এমআরটি লাইন–৫ উত্তরাংশ বর্তমানে দরপত্র পর্যায়ে রয়েছে।
এমআরটি লাইন–৬
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, চলমান আরেক মেট্রোরেল প্রকল্প—এমআরটি লাইন–৬ (দিয়ারবাড়ি–কমলাপুর)—এর বরাদ্দও প্রায় ৩২৪ কোটি টাকা কমানো হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের এডিপিতে এ প্রকল্পের বরাদ্দ ছিল ১,৩৪৭.৪৪ কোটি টাকা।
দিয়ারবাড়ি–মতিঝিল অংশে ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে, আর মতিঝিল–কমলাপুর অংশের সম্প্রসারণ কাজ চলছে।
এমআরটি লাইন–৬ প্রকল্পের পরিচালক মো. আব্দুল ওহাব টিবিএসকে বলেন, চাহিদা পর্যালোচনা করে তারা দেখেছেন চলতি বছরে পুরো এডিপি বরাদ্দের প্রয়োজন হবে না। তাই এর একটি অংশ ফেরত দেওয়া হচ্ছে।
তিনি জানান, "মতিঝিল–কমলাপুর সম্প্রসারণের কাজের প্রায় ৭২ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে, এবং ২০২৭ সালের জানুয়ারিতে এ অংশটি চালু আশা করা হচ্ছে।"
মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প
সরকারের আরেক অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত মেগা প্রকল্প—মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প—সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দের ৭৩.৩২ শতাংশ ফেরত দিচ্ছে।
গত অক্টোবরেই একনেক প্রকল্পটির ব্যয় ১৭,৭৭৭ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৪,৩৮১ কোটি টাকায় উন্নীত করে। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত প্রকল্প ব্যয় হয়েছে মাত্র ২,১৬৮.৯১ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে প্রকল্পটির এডিপি বরাদ্দ ছিল ৪,০৬৮ কোটি টাকা, যা আরএডিপিতে কমিয়ে ১,০৮৫ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে।
বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্প
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সংশোধিত এডিপিতে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পের বরাদ্দ ৭০.৫২ শতাংশ কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের এডিপিতে এর বরাদ্দ ছিল ১,০৩৯.২৪ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা জানান, এ বছর পুরো বরাদ্দের প্রয়োজন ছিল না বলেই অর্থ ফেরত দেওয়া হচ্ছে। ২১,৩৯৯ কোটি টাকার এ প্রকল্পে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ১০,৫৩৩ কোটি টাকা।
বিআরটি প্রকল্প
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা আরও জানান, গত জুলাইয়ে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে 'গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট' (এয়ারপোর্ট–গাজীপুর বিআরটি) প্রকল্পের ব্যয় ও সময় বৃদ্ধি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হয়। মূলত দুর্বল পরিকল্পনা ও গুরুতর নকশাগত ত্রুটির কারণে এটি প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।
এর ফলে এ প্রকল্পের এডিপি বরাদ্দও ফেরত যাচ্ছে। এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ৪২৫ কোটি টাকা, যা আরএডিপিতে কমিয়ে ১৬৮.৬০ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে।
হাইওয়ে উন্নয়ন প্রকল্প
ধীরগতির কারণে সড়ক ও জনপথ বিভাগের দুটি মেগা প্রকল্প—হাটিকুমরুল-রংপুর মহাসড়ক চার লেনে উন্নয়ন (সাসেক–২) এবং ঢাকা-সিলেট চার লেনে উন্নয়ন—সংশোধিত এডিপিতে যথাক্রমে ১৬.৫৫ শতাংশ ও ৩ শতাংশ বরাদ্দ হ্রাস পাচ্ছে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের বরাদ্দ অপরিবর্তিত রয়েছে। চলতি অর্থবছরের এডিপিতে প্রকল্পটির বরাদ্দ ১০,০১১.৭৮ কোটি টাকা। পরিকল্পনা কমিশন জানিয়েছে, এই বরাদ্দের কোনো অংশ কমানোর প্রস্তাব করা হয়নি।
ঢাকা–আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প
সেতু বিভাগের মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে ঢাকা–আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পে বরাদ্দ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ৩,৩৪২ কোটি টাকা, যা সংশোধিত এডিপিতে বাড়িয়ে ৪,৪৭৭ কোটি টাকা করার প্রস্তাব রয়েছে।
সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি বাড়ায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিল পরিশোধসহ চলমান কাজের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে অতিরিক্ত বরাদ্দের প্রয়োজন হয়েছে।
৩০ হাজার কোটি টাকার কাটছাঁট
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, প্রস্তাবিত বরাদ্দ আগামী ৩১ ডিসেম্বরের বর্ধিত সভায় প্রাথমিক অনুমোদন পাবে এবং জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে এনইসি সভায় চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে।
অর্থ বিভাগ ইতোমধ্যে পরিকল্পনা কমিশনে আরএডিপির সামগ্রিক আকার নির্ধারণ করে চিঠি পাঠিয়েছে। সেখানে সরকারি অর্থায়ন ও বৈদেশিক ঋণ—দুই খাত মিলিয়ে ৩০ হাজার কোটি টাকা কাটছাঁটের প্রস্তাব রয়েছে। সরকারি অর্থায়ন ১,৪৪,০০০ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ১,২৮,০০০ কোটি টাকা করা হচ্ছে। বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানের বরাদ্দ ৮৬,০০০ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ৭২,০০০ কোটি টাকা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান ও সিইও ড. এম মসরুর রিয়াজ বলেন, সরকার ইতোমধ্যেই সংকোচনমূলক বাজেট বাস্তবায়ন করছে, যার ফলে উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্দ কমে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, "সরকারি ব্যয় ও এডিপি বরাদ্দে নিম্নমুখী সংশোধন এখন প্রায় নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এই ধীরগতি ইতোমধ্যেই সামগ্রিক অর্থনীতিতে চাপ তৈরি করছে—বিশেষ করে নির্মাণ খাতে, যা সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল।"
তিনি আরও বলেন, "সরকারি প্রকল্পে সরাসরি কর্মসংস্থান তুলনামূলকভাবে কম এবং স্বল্পমেয়াদি হলেও বড় প্রভাবটি পড়ে সংশ্লিষ্ট শিল্পগুলোর চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে। সরকারি বিনিয়োগের গতি কমলে কর্মসংস্থানের ওপর এর মাল্টিপ্লায়ার ইফেক্টও হ্রাস পায়, ফলে সরকারি ব্যয়ের সামগ্রিক কর্মসংস্থান তৈরির সক্ষমতা কমে যায়।"
