৩০০ আসনের অধিকাংশ চায় সম্ভাব্য শরিক দলগুলো, বিএনপি কত আসন ছাড় দেবে?
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শরিক দলের জন্য আসন ছাড়ের বিষয়টি নিয়ে ভাবছে বিএনপি। ইতোমধ্যে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা বিভিন্ন জোট ও দলকে সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকা দিতে বলা হয়েছে। কয়েকটি দল ও জোট ২১৭টি আসনের তালিকা জমা দিয়েছে, যার মধ্যে কিছু প্রার্থীকে ইতোমধ্যে 'গ্রিন সিগন্যাল'ও দিয়েছে বিএনপি।
এছাড়া আরও কয়েকটি দল বিএনপির সঙ্গে জোটে যুক্ত হতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তাদের দাবি প্রায় আরও ১১০টি আসন। সব মিলিয়ে আসন্ন নির্বাচনে বিএনপির কাছে শরিক হতে আগ্রহী দলগুলো মোট আসনের অধিকাংশই চাইছে। তবে বিএনপি সর্বোচ্চ ৪০ থেকে ৫০টি আসন ছাড় দেওয়ার কথা ভাবছে।
কে কত আসন চায়
জানা গেছে, শরিক দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্র মঞ্চ বিএনপির কাছে ১৩৮টি আসনের তালিকা দিয়েছে। লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) চেয়েছে ১৩টি, ১২-দলীয় জোট ২১টি, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট ৯টি, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম) ১০টি, গণফোরাম ১৫টি, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) ৫টি, এবং লেবার পার্টি ৬টি আসন চেয়ে তালিকা দিয়েছে।
কয়েকটি মধ্যপন্থী দল নিয়ে আলাদা জোট গঠনের চিন্তা করছে এবি পার্টি, তবে বিএনপির সঙ্গে নির্বাচনী জোটের সম্ভাবনাও তারা উড়িয়ে দিচ্ছে না। দলটির নেতারা জানিয়েছেন, বিএনপির সঙ্গে জোট করলে সরাসরি তারেক রহমানের সঙ্গে আলোচনা করেই তা চূড়ান্ত করতে চান তারা। সেক্ষেত্রে এবি পার্টি ৩০টি আসন দাবি করবে।
এদিকে গণঅধিকার পরিষদ এখনো জোটে যাওয়ার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি। দলটির সঙ্গে বিএনপি ও জামায়াত উভয়েরই যোগাযোগ চলছে। পাশাপাশি এককভাবেও নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা। বিএনপির সঙ্গে জোট হলে গণঅধিকার পরিষদও ৩০টি আসন চাইবে বলে জানা গেছে।
বিএনপি ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জোট এখনো দৃশ্যমান না হলেও পর্দার আড়ালে আলোচনা চলছে। জানা গেছে, গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া নতুন ছাত্র রাজনৈতিক দলকেও সঙ্গে নিতে আগ্রহী বিএনপি। এনসিপিও বিএনপির সঙ্গে জোটে যেতে আগ্রহী।
আসন ছাড়ের বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ বলেন, "শরিক ও মিত্র দলগুলোকে ৪০ থেকে ৫০টি আসন দেওয়া হবে।"
তবে বিএনপি এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি—জোট গঠন করবে, নাকি সমঝোতার ভিত্তিতে আসন ছাড়বে। দলটি জানিয়েছে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, "বিএনপি এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। সময় হলে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে নির্বাচনে সমমনাদের যেখানে যতটুকু ছাড় দেওয়া প্রয়োজন, সেখানে ততটুকু ছাড় দেওয়া হবে।"
"আমরা সব সময়ই বলেছি—বিএনপি জাতীয় সরকার গঠন করবে। তাই শুধু নির্বাচনে নয়, সরকার গঠনেও যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোর অংশগ্রহণ থাকবে," যোগ করেন তিনি।
এদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে থাকা সব রাজনৈতিক দলকে একত্র করে একটি বৃহত্তর জোট গঠনে কাজ করছে বিএনপি।
তিনি বলেন, "এর মাধ্যমে আমরা আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের সেতু একসঙ্গে অতিক্রম করতে চাই। ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্যই আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি।"
গতকাল বিএনপির যুব সংগঠন জাতীয়তাবাদী যুবদলের ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে দলের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তিনি এসব কথা বলেন।
যে ১২ জনকে 'গ্রিন সিগন্যাল' দিয়েছে বিএনপি
আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা না দিলেও শরিকদের মধ্যে ১২ জনকে সবুজ সংকেত দিয়েছে বিএনপি। আলোচনার মাধ্যমে আরও কিছু আসনে ছাড় দেবে দলটি। বাকি আসন নিয়ে আলোচনা ও দরকষাকষি চলছে। তফসিল ঘোষণার পর প্রার্থী মনোনয়নের যথাযথ প্রক্রিয়া শেষে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হবে।
তবে যাদের মনোনয়ন দেওয়া সম্ভব হবে না, তাদের সংসদের উচ্চকক্ষে মূল্যায়নের সুযোগ দেওয়ার পরিকল্পনা করছে বিএনপি।
পিরোজপুর-১ আসনে জাতীয় পার্টির (জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার, বগুড়া-২ আসনে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, ঢাকা-১৭ আসনে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ, লক্ষ্মীপুর-১ আসনে বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম, কিশোরগঞ্জ-৫ আসনে বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা, ঢাকা-১৩ আসনে এনডিএমের চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬ আসনে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, চট্টগ্রাম-১৪ আসনে এলডিপির চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদের ছেলে অধ্যাপক ওমর ফারুক, কুমিল্লা-৭ আসনে এলডিপির মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমেদ, নড়াইল-২ আসনে জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ও এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, পটুয়াখালী-৩ আসনে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর এবং ঝিনাইদহ-২ আসনে দলটির সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খানকে প্রার্থী হিসেবে সবুজ সংকেত দিয়েছে বিএনপি।
ছাড় দেওয়া আসনে জয় নিয়ে চিন্তিত বিএনপি
বিএনপি মনে করছে, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় শুধুমাত্র দলের ইচ্ছায় প্রার্থীদের জয়লাভ সম্ভব নয়—প্রতিটি প্রার্থীকে নিজ যোগ্যতা ও জনগণের ভোটের মাধ্যমে জয় পেতে হবে। ফলে শরিক দলগুলোর জন্য ছেড়ে দেওয়া আসনগুলো নিয়ে দলে এক ধরনের উদ্বেগ রয়েছে।
বিএনপির আশঙ্কা, এসব আসনের অধিকাংশ প্রার্থীর নিজ এলাকায় শক্তিশালী সাংগঠনিক ভিত্তি নেই, দলের অবস্থানও দুর্বল এবং তাদের নিজস্ব ভোট ব্যাংকও সীমিত। তাই এই আসনগুলোতে শরিকদের জয় অনেকাংশে স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর নির্ভর করবে।
বিএনপি মনে করছে, বিরোধী দলের প্রার্থীদের জনপ্রিয়তা বেশি হলে বিএনপির আনুষ্ঠানিক সমর্থন থাকা সত্ত্বেও শরিক প্রার্থীরা জয় পেতে ব্যর্থ হতে পারেন। এতে শরিকদের জন্য ছেড়ে দেওয়া আসন হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
অন্যদিকে, প্রতিটি আসনেই বিএনপির একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী রয়েছেন, যারা গত ১৭ বছর ধরে স্থানীয় রাজনীতিতে সক্রিয় থেকেছেন, দলের আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন এবং মামলা–হামলার সময়ে সংগঠনের পাশে ছিলেন। ফলে হঠাৎ করে জোটের নতুন প্রার্থী এলাকায় গেলে বিএনপির স্থানীয় নেতা–কর্মীরা তার পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নামবেন কি না, তা নিয়েও দলে শঙ্কা রয়েছে।
তবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ইতোমধ্যে সব স্তরের নেতা–কর্মীদের কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন, দলের মনোনীত প্রার্থীদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করার জন্য। পাশাপাশি বিএনপি আরও কিছু আসন ছাড়ের সম্ভাবনা নিয়েও পর্যালোচনা করছে।
অতীতে বিএনপির আসন ছাড়
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট ৩০০টি আসনেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। সে সময় ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে ১৯টি আসন ছেড়ে দিয়েছিল বিএনপি। এর মধ্যে গণফোরাম পেয়েছিল ৭টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) ৪টি, নাগরিক ঐক্য ৪টি এবং কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ৪টি আসন।
অন্যদিকে তৎকালীন ২০-দলীয় জোট মোট ৩৯টি আসনে ছাড় পেয়ে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে। এর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী পেয়েছিল ২২টি আসন। এছাড়া এলডিপি ৫টি, খেলাফত মজলিস ২টি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ৩টি, জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) ২টি, এবং বিজেপি, কল্যাণ পার্টি, এনপিপি, লেবার পার্টি ও পিপিবি প্রত্যেকে ১টি করে আসন পায়। সব মিলিয়ে ওই নির্বাচনে বিএনপি মোট ৫৮টি আসন শরিকদের জন্য ছেড়েছিল।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের শরিক জামায়াতে ইসলামকে ৩৯টি আসন ছেড়ে দিয়েছিল। জোটের অপর তিন শরিক—বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), ইসলামী ঐক্যজোট ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামকে দুটি করে আসন দেওয়া হয়েছিল।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে জোট ও আসন ভাগাভাগি নতুন নয়। বড় দলগুলোর সঙ্গে জোট বেঁধে ছোট দলগুলো অনেক সময় প্রধান দলের প্রতীকে নির্বাচন করেছে। এর আগে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের হাসানুল হক ইনু, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেননসহ অনেকে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করেছিলেন। তবে এবারের নির্বাচনে সেই সুযোগ থাকছে না।
কারণ, নির্বাচনী জোট হলেও এবার প্রার্থীদের নিজ নিজ দলের প্রতীকে নির্বাচন করতে হবে—এমন বিধান যুক্ত করে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের খসড়া অনুমোদন দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। যদিও এ সংশোধনীর বিরোধিতা করছে একাধিক রাজনৈতিক দল।
