জুলাইয়ের পলাতক আসামিরা: ইন্টারপোলে অগ্রগতি না থাকায় বিচারেই জোর দিচ্ছে পুলিশ
জুলাই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে অন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ যাদের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির অনুরোধ জানিয়েছিল, তাদের বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই ইন্টারপোল থেকে এখনও ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি। গত এক বছরে আন্তর্জাতিক এই পুলিশ সংস্থা মাত্র ৪টি রেড নোটিশ জারি করেছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।
মোট ২৮ জনের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির আবেদন করেছিল বাংলাদেশ—যাদের মধ্যে রয়েছেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের বেশ কয়েকজন মন্ত্রী এবং সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা। জুলাই অভ্যুত্থানের মুখে তারা দেশত্যাগ করেছেন।
ইন্টারপোল ও পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, রেড নোটিশ জারির শর্ত পূরণ না হওয়ায় অন্তত ২৪ জনের নাম এখনো 'মোস্ট ওয়ান্টেড' তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
পুলিশ সদর দপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শেখ হাসিনাসহ ওই ২৪ জনের বিরুদ্ধে রেড নোটিশের আবেদন এখনো বিবেচনাধীন রয়েছে। অন্যদিকে, বাকি ৪ জনকে ঘিরেও তৈরি হয়েছে কিছু বিভ্রান্তি।
সিঙ্গাপুরভিত্তিক এক ইন্টারপোল কর্মকর্তা বলেন, "রেড নোটিশ জারির সবগুলো অনুরোধ একইসঙ্গে পাঠানো হয়েছিল এবং সেগুলোর কারণও একই ছিল। তাই ৪ জনের জন্য আলাদাভাবে রেড নোটিশ জারি হয়েছে—বিষয়টি খুবই অস্বাভাবিক। যদি সত্যিই এমনটি হয়ে থাকে, তাহলে সম্ভবত ওই চারটি মামলা ২০২৪ সালের আগস্টের আগেকার সময়ের।"
তিনি আরও বলেন, "ইন্টারপোল কোনো ব্যক্তির নামে রেড নোটিশ জারি করলে তা সংশ্লিষ্ট দেশকে সবসময় জানায়, এমনকি সেটি প্রকাশ্যে না আনলেও।"
এ বিষয়ে জানতে ইন্টারপোলের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে সংস্থাটি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড'কে কোনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য বা প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
তবে ইন্টারপোলের ওই কর্মকর্তা বলেন, সাধারণত আবেদন জমা দেওয়ার তিন সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশ পুলিশ ইন্টারপোলের কাছ থেকে জবাব পায়। এক বছর পার হয়ে যাওয়ার পরও কোনো সাড়া না পাওয়ার মানে কার্যত ইন্টারপোল ওই ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির সম্ভাবনাকে বাতিল করেছে।
তিনি আরও জানান, "বাংলাদেশ পুলিশের অনুরোধে ইন্টারপোল সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অবস্থান শনাক্ত করেছিল এবং সেই তথ্যও পুলিশকে দিয়েছে।"
তিনি ব্যাখ্যা করেন, "ইন্টারপোল হয়তো মনে করছে মামলাগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, অথবা আশঙ্কা করছে, অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করা হলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। এক বছর পেরিয়ে গেছে—মানে ইন্টারপোল কার্যত ওই আবেদনটি প্রত্যাখ্যান করেছে, এবং এখন এ সিদ্ধান্ত বদলানোর সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে।"
তিনি আরও জানান, ইন্টারপোল খুব কম ক্ষেত্রেই আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো আবেদন প্রত্যাখ্যান করে। সাধারণত তারা আবেদনটি ফেলে রাখে এবং কিছুই করে না। তবে যেসব আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তারা ব্যবস্থা নেয়, সেগুলোর ক্ষেত্রে খুব দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হয়—সাধারণত ১৬–১৭ দিনের মধ্যেই।
"আবেদনটি যদি জরুরি পর্যালোচনার জন্য পাঠানো হয়, তাহলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তা দেখা হয়। আর যদি তারা মনে করে বিষয়টি ততটা জরুরি নয়, তাহলে ফ্রান্সের কমিটি সেটি পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে প্রায় দুই থেকে তিন সপ্তাহ সময় নেয়," যোগ করেন তিনি।
ঢাকার কর্মকর্তারা কী বলছেন
ঢাকায় পুলিশ সদর দপ্তরের সূত্র জানায়, জমা দেওয়া রেড নোটিশ আবেদনগুলোর তালিকায় রয়েছেন—ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ, ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, সাবেক সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, মন্ত্রী এ কে এম মজাম্মেল হক, তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাসান মাহমুদ, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাবেক ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, এবং এস আলম গ্রুপের সাইফুল আলমসহ তার আরও চার ভাইবোন।
যাদের বিরুদ্ধে রেড নোটিশের আবেদন করা হয়েছে, তাদের মধ্যে একজন হলেন সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ। তার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে। অন্যদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। গত বছরের নভেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর পুলিশকে এসব আবেদন করার অনুরোধ জানান।
সপ্তাহ দুই আগে টিবিএসের সঙ্গে আলাপকালে পুলিশের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া ও পিআর) শাহাদাত হোসেন বলেন, "ইন্টারপোল আমাদের জানিয়েছে, গত এক বছরে মোট ৪ জনের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করা হয়েছে।"
এক বছরেও রেড এলার্ট জারি না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, "ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি) ঢাকা–এর মাধ্যমে বাংলাদেশ পুলিশ যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ইন্টারপোলে সব প্রয়োজনীয় নথিপত্র ইতোমধ্যে পাঠিয়েছে।"
তিনি আরও বলেন, "বিলম্বের কারণ ইন্টারপোলের নিজস্ব নীতি ও পর্যালোচনা প্রক্রিয়া, যা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আবেদনগুলো প্রত্যাখ্যান করা হয়নি; বিষয়গুলো এখনো ইন্টারপোলের সক্রিয় বিবেচনায় আছে। বাংলাদেশ পুলিশ ইন্টারপোলের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে এবং ইতিবাচক সাড়া পাওয়ার আশা করছে।"
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, রেড নোটিশের আবেদন প্রক্রিয়ায় সব আইনি ধাপ অনুসরণ করা হয়েছে; এখন পরবর্তী ধাপ হলো সরকারি পর্যায়ে (গভর্মেন্ট-টু-গভর্মেন্ট) যোগাযোগের মাধ্যমে বিষয়টি এগিয়ে নেওয়া।
সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া ও পিআর) শাহাদাত হোসেন বলেন, "রাজনৈতিক মামলায় ইন্টারপোল খুব কমই রেড নোটিশ জারি করে। সে কারণেই গভর্মেন্ট-টু-গভর্মেন্ট পর্যায়ের যোগাযোগ জরুরি।"
তিনি আরও বলেন, "অন্যান্য অপরাধের ক্ষেত্রে রেড নোটিশ জারি করা এবং পলাতক আসামিদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব—যেমন সম্প্রতি আমরা দুবাই থেকে একজন অভিযুক্তকে দেশে ফিরিয়ে এনেছি।"
পুলিশের দাবি অনুযায়ী, চলতি বছরের এপ্রিলে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করে ইন্টারপোল। ২২ এপ্রিল পুলিশের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) এনামুল হক সাগর জানান, রেড নোটিশ জারি হয়েছে। কিন্তু এরপর ৫ মাস পেরিয়ে গেলেও এখনও ইন্টারপোলের 'মোস্ট ওয়ান্টেড' তালিকায় বেনজীর আহমেদের নাম দেখা যায়নি।
পুলিশ কর্মকর্তা শাহাদাত হোসেন বলেন, "ইন্টারপোলের কিছু অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া আছে। তারা অনানুষ্ঠানিকভাবে আমাদের জানিয়েছে যে, রেড নোটিশ জারি করা হয়েছে।"
তবে ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটের রেড নোটিশ তালিকায় বেনজীর আহমেদের নাম পাওয়া যায়নি। আর বেনজীর আহমেদ ছাড়া, বাকি তিনজন কারা জানতে চাইলে প্রশ্নটি এড়িয়ে যান ওই কর্মকর্তা।
রেড নোটিশ জারির ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো বিবেচনা করে ইন্টারপোল
পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রাজনৈতিক মামলার ক্ষেত্রে ইন্টারপোল সাধারণত অত্যন্ত সতর্কভাবে পদক্ষেপ নেয়। তারা যাচাই করে দেখে, কোনো দেশের অনুরোধটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কি না বা প্রতিশোধমূলক কি না। এ কারণেই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের ক্ষেত্রে রেড নোটিশ খুব কমই জারি করা হয়।
অন্যদিকে, সরকারি কর্মকর্তা (পুলিশ, প্রশাসন) বা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি খুবই সাধারণ ঘটনা। বাংলাদেশও অনেক আবেদন জমা দিয়েছে; তবে এখন পর্যন্ত সাবেক পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি হলেও কোনো রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে তা জারি হয়নি।
রেড নোটিশ মানে কী?
রেড নোটিশ জারি মানেই গ্রেপ্তার বা দেশে ফেরানো নয়। এটি নির্ভর করে অভিযুক্ত ব্যক্তি যে দেশে আছেন, সেই দেশের স্থানীয় আইন এবং বাংলাদেশের সঙ্গে এ সংক্রান্ত দ্বিপক্ষীয় চুক্তি আছে কি না, তার ওপর।
পুলিশ কর্মকর্তারা বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেন, কোনো বাংলাদেশি পলাতক যদি ইউরোপের কোনো দেশে অবস্থান করে, তাহলে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি হলেও তাকে ফেরানো সম্ভব হবে কিনা তা নিশ্চিত নয়। কারণ বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে সেই দেশের আইনি কাঠামো ও বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের ওপর।
পুলিশের পরবর্তী পদক্ষেপ কী
পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম টিবিএসকে বলেন, "আমাদের দায়িত্ব হলো আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আবেদন করা। এখন আমরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এমন দেশগুলোর সঙ্গে কাজ করছি, যাদের সঙ্গে আমাদের অপরাধী প্রত্যর্পণ চুক্তি আছে—যেমন ভারত ও থাইল্যান্ড।"
"তবে যদি ইন্টারপোল রেড নোটিশ জারি না করে, তাহলে আর আমরা কী করতে পারি? তাই এখন আমাদের গুরুত্ব প্রত্যর্পণের চেয়ে বিচারের প্রক্রিয়ার দিকেই বেশি," যোগ করেন তিনি।
