পটুয়াখালী যেভাবে জলাবদ্ধ শহর থেকে জলবায়ু-সহনশীলতার মডেল হয়ে উঠল
এক দশক আগেও প্রতি বর্ষায় জলাবদ্ধ হয়ে পড়ত পটুয়াখালী শহর। কাদা, উপচে পড়া নর্দমা আর বিপজ্জনক হাঁটার পথ ছিল সেখানকার দৈনন্দিন চিত্র। সামান্য বৃষ্টিতেই রাস্তায় হাঁটু পানি জমে যেত; এতে যান চলাচল স্থবির হয়ে পড়ত, ব্যাঘাত ঘটত জনজীবনে।
তবে আজকের পটুয়াখালী যেন নতুন রূপ পেয়েছে। রাস্তাঘাট এখন পরিচ্ছন্ন ও পাকা, বৃষ্টির পানি দ্রুত নেমে যায়, পথচারী ও সাইকেল আরোহীদের জন্য আলাদা লেন থাকায় নিরাপত্তাও নিশ্চিত হয়েছে। এই পরিবর্তন কেবল অবকাঠামোগত উন্নয়নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়—এটি শহরের বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার মানেও বাস্তব উন্নতি এনেছে।
শহরের কেন্দ্রস্থলে লাইসু ও তার স্ত্রী গত সাত-আট বছর ধরে ডাব বিক্রি করছেন। তিনি বলেন, 'আগে বর্ষাকালে কাদা আর পানির জন্য ডাব বিক্রি করা খুবই মুশকিল ছিল। এখন নতুন রাস্তাঘাট হওয়ায় এবং লোকচলাচল বাড়ায় বিক্রি বহুগুণ বেড়ে গেছে। এতে আমাদের সংসার চালানো অনেক সহজ হয়েছে।'
তাদের এই গল্প একটি বৃহত্তর প্রবণতারই প্রতিফলন—শহরের অবকাঠামোগত উন্নয়নের সঙ্গে পটুয়াখালীজুড়ে ক্ষুদ্র ব্যবসাও বিকশিত হয়েছে।
টেকসই উন্নয়নের বাস্তবায়ন
এই রূপান্তরের পেছনে রয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথভাবে বাস্তবায়িত দশকব্যাপী উদ্যোগ কোস্টাল টাউনস এনভায়রনমেন্টাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রজেক্ট (সিটিইআইপি)।
বাংলাদেশের দক্ষিণের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোকে নিয়মিতই ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, অতিবর্ষণ ও লবণাক্ততার অনুপ্রবেশের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হয়। ২০১১ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, মৌসুমী বৃষ্টির সময় উপকূলীয় শহরগুলোর প্রায় ৬০ শতাংশ এলাকা ৫ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত জলাবদ্ধ থাকত। দুর্বল নিষ্কাশন ব্যবস্থা, পানিতে উচ্চ লবণাক্ততা ও বিশুদ্ধ পানির সীমিত সরবরাহের কারণে সমস্যাটি আরও প্রকট আকার ধারণ করেছিল।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪ সালে সিটিইআইপি প্রকল্প চালু করা হয়। করোনা মহামারির কারণে কিছুটা বিলম্ব হলেও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) সফলভাবে এই প্রকল্পটির নেতৃত্ব দিয়েছে। এর প্রধান লক্ষ্য ছিল জলবায়ু-সহনশীল পৌর অবকাঠামো গড়ে তোলার পাশাপাশি নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা।
দৃশ্যমান পরিবর্তন
এ প্রকল্পের আওতায় জলবায়ু-সহনশীল রাস্তা, ফুটপাত, রাস্তার সৌন্দর্যবর্ধন, আলোকসজ্জা ও উন্নত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নির্মাণ করা হয়েছে।
প্রকল্পটিতে মোট ব্যয় হয়েছে ১০৩.৩৯ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে এডিবি দিয়েছে ৮৫.৯১ মিলিয়ন ডলার ও বাংলাদেশ সরকার দিয়েছে ১৬.০১ মিলিয়ন ডলার। এছাড়াও বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন, স্ট্র্যাটেজিক ক্লাইমেট ফান্ড ও ইউএসসিআইআরটিএফ থেকে অতিরিক্ত সহায়তা পাওয়া গেছে।
আট উপকূলীয় শহরে রাস্তা, ড্রেনেজ, পানি সরবরাহ, পয়ঃনিষ্কাশন, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র, বাজার, সেতু, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও বস্তি উন্নয়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাস্তব সুফল এনেছে সিটিইআইপি। এর মধ্যে পটুয়াখালী পৌরসভা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যেখানে প্রায় ৫৫.৭ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে।
এই প্রকল্পের আওতায় জলবায়ু-সহনশীল নকশা অনুসরণ করে ৩৩.৩৩ কিলোমিটার সড়ক ও ১২.২৫ কিলোমিটার ড্রেন নির্মাণ করা হয়েছে। রাস্তাগুলো বন্যার পানির স্তরের চেয়ে উঁচুতে নির্মাণ করা হয়েছে এবং টেকসই উপকরণ দিয়ে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যেন আগামী ৫০ বছরের সম্ভাব্য জলবায়ুগত প্রভাব মোকাবিলা করতে পারে। এতে ইউনিব্লক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, যাতে নদীর বালি ব্যবহৃত হয়। এ প্রযুক্তি দূষণ কমানোর পাশাপাশি রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ও হ্রাস করে।
বৈপ্লবিক নিষ্কাশন ব্যবস্থা
একটি সমন্বিত নিষ্কাশন মহাপরিকল্পনা দ্রুত বৃষ্টির পানি অপসারণ নিশ্চিত করে। পৌরসভা এখন এই ব্যবস্থাটি স্বতন্ত্রভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করে। জলাবদ্ধতা ৭০ শতাংশের বেশি কমে গেছে। আগের বন্যাপ্রবণ এলাকাগুলোতেও এখন কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পানি নেমে যায়। ফলে ডেঙ্গু ও অন্যান্য পানিবাহিত রোগের প্রকোপ অনেকটা কমে গেছে।
বর্ষার বন্যা ব্যবস্থাপনা ও সারা বছর পানির স্তর ঠিক রাখার জন্য বিভিন্ন খাল ও পুকুর খনন করা হয়েছে, যা স্থানীয় তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণেও সাহায্য করছে। অনেক পরিবার এখন এই পানি ব্যবহার করে ছোট পরিসরে মাছ চাষ করছে, যার ফলে তাদের আয় ও পুষ্টি দুটোই বাড়ছে।
সুশাসন শক্তিশালীকরণ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি
সিটিইআইপি স্থানীয় সুশাসনকেও উন্নত করেছে। ডিজিটাল বিলিং, অনলাইন ট্যাক্স পেমেন্ট ও নাগরিক অংশগ্রহণ ব্যবস্থার সহায়তায় পটুয়াখালী পৌরসভায় রাজস্ব আদায় ৬০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৯৫ শতাংশ হয়েছে। পৌরসভা এখন স্বাধীনভাবে রাস্তা রক্ষণাবেক্ষণ, ড্রেন পরিষ্কার ও খাল ব্যবস্থাপনা করছে, যা দীর্ঘমেয়াদি টেকসই উন্নয়নের ভিত্তি স্থাপন করেছে।
মানুষ এর প্রভাব স্পষ্টভাবে অনুভব করছেন। স্থানীয় বাসিন্দা সেলিনা বেগম বলেন, 'আগে সামান্য বৃষ্টিতেই রাস্তায় পানি জমে যেত। এখন শহর পরিষ্কার; মেয়েরা নিরাপদে হাঁটতে পারে, বাচ্চারা স্কুলে যেতে পারে। এটাই সবচেয়ে বড় পরিবর্তন।'
এডিবি কর্মকর্তারা জানান, পানিবাহিত রোগ ৭৬.৭ শতাংশ কমেছে, ডায়রিয়ায় আক্রান্তের হার ৯ শতাংশ থেকে কমে ২.১ শতাংশ হয়েছে। জলাবদ্ধতা কমে যাওয়ায় মানুষের কর্মঘণ্টা বেড়েছে, সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি কমেছে এবং পরিবারের গড় আয় ১৫ হাজার ৮০০ টাকা থেকে বেড়ে ২০ শতাংশ ৬৮৫ টাকা হয়েছে, অর্থাৎ ৩০.৯ শতাংশ বেড়েছে।
সাফল্যের ধারাবাহিকতা
সিটিইআইপির সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে কোস্টাল টাউনস ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স প্রজেক্ট (সিটিসিআরপি) চালু করেছে এলজিইডি। এর লক্ষ্য ২৫০ মিলিয়ন ডলার বাজেটে ২২টি উপকূলীয় শহরে জলবায়ু-সহনশীল অবকাঠামো প্রতিষ্ঠা করা। এছাড়াও নিরাপদ পানি, আধুনিক স্যানিটেশন ও দক্ষ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে ক্লাস্টার টাউনস ওয়াটার সাপ্লাই অ্যান্ড স্যানিটেশন প্রজেক্ট-এর (২০২৭) পরিকল্পনাও রয়েছে।
এডিবির কান্ট্রি ডিরেক্টর হো ইয়ুন জেওং ব্যক্তিগতভাবে প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এডিবি এই শহরগুলোকে সহায়তা করতে পেরে গর্বিত এবং এই প্রকল্পগুলো বাসিন্দাদের জীবন ও স্থানীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
তিনি আরও বলেন, 'ছোট বিনিয়োগও বড় ধরনের উন্নয়ন ঘটাতে পারে। নগর উন্নয়ন প্রকল্পগুলো একটি সমন্বিত পদ্ধতি অনুসরণ করে, যা অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতি একসাথেই নিশ্চিত করে। উপকূলীয় শহরগুলোর জলবায়ু সহনশীলতা উন্নয়ন প্রকল্পগুলো লবণাক্ততা ও জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এডিবি ভবিষ্যতেও উপকূলীয় ছোট প্রকল্পগুলোর ওপর মনোযোগ অব্যাহত রাখবে।'
দেশের জন্য টেকসই উন্নয়নের মডেল হতে পারে পটুয়াখালী। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে, ভবিষ্যতে তাপমাত্রা ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং ঘূর্ণিঝড়ের কারণে জলবায়ু ঝুঁকি আরও তীব্র হবে। তাই টেকসই অবকাঠামো ও জলবায়ু-সহনশীল নগর পরিকল্পনা অপরিহার্য।
