নারী সাংবাদিকের ‘আত্মহত্যা’: বিচার বিভাগীয় তদন্ত চায় নিপীড়নের বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর
অনলাইন নিউজপোর্টাল 'ঢাকা স্ট্রিম' এর গ্রাফিক ডিজাইনার স্বর্ণময়ী বিশ্বাসের 'আত্মহত্যা'র ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি করেছে নিপীড়নের বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর নামের একটি প্লাটফর্ম।
আজ শুক্রবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এ দাবি জানানো হয়।
প্লাটফর্মটির পক্ষে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আনিকা তাবাসসুমের সই করা বিবৃতিতে আরও কয়েকটি দাবি জানানো হয়। সেগুলো হলো-
- স্বর্ণময়ী বিশ্বাসের আত্মহত্যা ও আলতাফ শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে উত্থাপিত যৌন নিপীড়নের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার বিভাগীয় তদন্ত করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে;
- বিচার বিভাগীয় তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন সাপেক্ষে পিএইচডি গবেষণারত আলতাফ শাহনেওয়াজের বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং
- জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারাবাহিক আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ অর্জন 'শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে মহামান্য হাইকোর্ট কর্তৃক প্রদত্ত নীতিমালা'-কে অনতিবিলম্বে আইনে রূপান্তর করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে সফল প্রয়োগের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারকে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
বিবৃতিতে বলা হয়, স্বর্ণময়ী বিশ্বাসের আত্মহত্যার ঘটনায় আমরা মর্মাহত, হতবিহ্বল ও ক্ষুব্ধ। এ ঘটনার পূর্বাপর ভয়াবহতায় আমরা রীতিমতো স্তম্ভিত। আমরা তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই এবং তার এই আত্মহত্যার ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করি।
বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে আমরা জেনেছি, গত ১৩ জুলাই ঢাকা স্ট্রিমের সম্পাদক ও প্রকাশক বরাবর স্বর্ণময়ী বিশ্বাসসহ মোট সাতজন নারী (যেখানে ২১ জন পুরুষও সংহতি ও সমর্থন জানিয়ে সই করেছেন) নয়টি গুরুতর প্রসঙ্গ তুলে ধরে ঢাকা স্ট্রিমের বাংলা কনটেন্ট এডিটর আলতাফ শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন। কিন্তু, প্রতিষ্ঠানের অত্যন্ত প্রভাবশালী পদাধিকারী আলতাফ শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে 'বার্তাকক্ষ থেকে প্রত্যাহার করা'র নামেমাত্র সাজা ছাড়া আর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি ঢাকা স্ট্রিম, যা 'শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে মহামান্য হাইকোর্ট কর্তৃক প্রদত্ত নীতিমালা'র সুষ্পষ্ট লঙ্ঘন।
নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো কর্মীর বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ এলে অভিযুক্তকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করতে হয়। কিন্তু, জানা যাচ্ছে যে যারা এই অভিযোগ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাদের কয়েকজনকেই উল্টো 'অপরাধী' সাব্যস্ত করে বিনা নোটিশে চাকুরিচ্যুত করা হয়েছে। আমরা ঢাকা স্ট্রিম কর্তৃপক্ষের এই অন্যায্য ও অগণতান্ত্রিক আচরণের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।
এছাড়া নীতিমালা অনুযায়ী, কমপক্ষে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি অভিযোগ কমিটি গঠন করতে হয়, যার অধিকাংশ সদস্য হবেন নারী ও সম্ভব হলে কমিটির প্রধান হবেন একজন নারী এবং অন্তত দুজন সদস্য হতে হবে অন্য প্রতিষ্ঠানের, যারা জেন্ডার বিষয় ও যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে কাজ করেন। ঢাকা স্ট্রিম তদন্ত কমিটি করেছে দুজনের এবং দুজনই তাদের প্রতিষ্ঠানের। এটিও হাইকোর্টের নীতিমালার অবমাননা।
এছাড়া ঢাকা স্ট্রিম গত ১৯ অক্টোবর তাদের আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে ওই যৌন নিপীড়নের অভিযোগ ও স্বর্ণময়ীর আত্মহত্যা প্রসঙ্গে যে বক্তব্য দিয়েছে, তা আদতে নিপীড়কের পক্ষেই তাদের অবস্থান তুলে ধরেছে। তারা হাইকোর্টের সুস্পষ্ট সংজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও যৌন নিপীড়নকে 'অসৌজন্যমূলক আচরণ' কিংবা স্বর্ণময়ীর আত্মহত্যাকে 'অকাল মৃত্যু' বা 'মর্মান্তিক মৃত্যু' উল্লেখ করে যে ভাষিক কৌশল নিয়েছে এবং হাইকোর্টের নীতিমালার নির্দেশনা যে প্রক্রিয়ায় অমান্য করেছে, তা ঘটনার গভীরতাকে লঘু করে দেখানোর অপচেষ্টা ছাড়া অন্য কিছু নয়। এই অপচেষ্টার দায় মিডিয়াটির সম্পাদক ও প্রকাশক ইফতেখার মাহমুদ এবং মানবসম্পদ ও প্রশাসন বিভাগের ব্যবস্থাপক পি এম সজল আহমেদের ওপরেও বর্তায়।
বেদনাদায়ক বাস্তবতা হলো, স্বর্ণময়ীর আত্মহত্যার কারণেই আলতাফ শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে পূর্ববর্তী যৌন নিপীড়নের অভিযোগ ও সেই প্রেক্ষিতে বাংলা স্ট্রিমের অনান্তরিক পদক্ষেপ প্রকাশ্যে এসেছে। আবার এ কথাও সত্য, আইনি সুরাহা ছাড়া সিদ্ধান্তেও আসা যায় না যে, স্বর্ণময়ীর এই আত্মহত্যার পেছনে কর্মস্থলে উল্লিখিত যৌন নিপীড়নের সম্পৃক্ততা আছে নাকি নেই। কিন্তু, বিভিন্ন মাধ্যমে আমরা জানতে পারছি, স্বর্ণময়ীকে নিয়ে খুবই কুৎসিত মন্তব্য করেছিলেন আলতাফ শাহনেওয়াজ, যা প্রচণ্ড পিতৃতান্ত্রিক নিপীড়নমূলক কর্তৃত্ববাদী আচরণ হিসেবে একজন নারীকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করার সম্ভাব্য কারণ হয়ে উঠতে পারে। ফলে, এই ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত হওয়া অনিবার্য বলে আমরা মনে করি।
পরিশেষে আমরা বলতে চাই, নিপীড়ক যে-ই হোক এবং নিপীড়ন যেখানেই ঘটুক, ঐতিহাসিক কারণেই ন্যায়বিচারের পক্ষাবলম্বন করার এক অনিবার্য দায়বদ্ধতা আছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কমিউনিটির। সেই দায়বদ্ধতার জায়গা থেকেই 'নিপীড়নের বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর' ব্যানারে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংক্ষুব্ধ সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা স্বর্ণময়ী বিশ্বাসের আত্মহত্যা ও ঢাকা স্ট্রিমের নারী কর্মীদের যৌন নিপীড়নের অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিচার বিভাগীয় তদন্ত সাপেক্ষে ন্যায়বিচার দাবি করছি।
নিপীড়নের বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগরের পক্ষে বিবৃতিতে অনলাইনে স্বাক্ষর করেন বিভিন্ন ব্যাচ ও বিভাগের ৭৭ জন সাবেক-বর্তমান শিক্ষার্থী। তারা হলেন, সানজিদা নূর, আনিকা তাবাসসুম, অদ্রি অংকুর, ফাইজান আহমেদ অর্ক, সরদার ইসফার সাদী, সিমান্ত বর্ধন, ইমরান হাসান শুভ, মায়িশা মনি, ফারজানা ইয়াসমিন, মনীষা হক, ফাইজা মেহজাবিন প্রিয়ন্তী, অমর্ত্য রায়, এহতেশাম শাহরিয়ার শিকদার, আবিদা ফেরদৌসী, যারিন তাসনীম, তাসবিবুল গনি নিলয়, রাকিবুল রনি, মাধুরী গোস্বামী, গ্যাব্রিয়েল পাংখোয়া, মারিয়া ভূঁইয়া, অলিউর সান, আবিদ সরকার, তামান্না আজিজ তুলি, সৌগত বসু, দীপাঞ্জন সিদ্ধান্ত কাজল, পল্লব আহমেদ, শাওন কৈরী, তন্ময় ধর, নাঈম উল হাসান, নিষাদ আদনান, ফারিহা রহমান, আকিল আশরাফ প্রমুখ।
