বিমানবন্দরের অগ্নি-নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন

যুক্তরাজ্যের এভিয়েশন নিরাপত্তা মূল্যায়নে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়ার মাত্র এক সপ্তাহ পরই বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) এখন কঠোর সমালোচনার মুখে; হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর প্রশ্ন উঠেছে তাদের অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা নিয়ে।
বিমানবন্দরের একমাত্র কার্গো হ্যান্ডলার—বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন, অগ্নিনিরাপত্তা পরিস্থিতি মূল্যায়নে সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। বিমানের ফ্লাইট সেফটি প্রধানের নেতৃত্বে থাকা এই কমিটি ১৫টি মূল প্রশ্নের আলোকে শাহজালাল বিমানবন্দরের সামগ্রিক অগ্নিনিরাপত্তা কাঠামো পর্যালোচনা করবে।

তদন্তে দেখা হচ্ছে—আগুন শনাক্তকরণ ও স্প্রিংকলার ব্যবস্থা কার্যকর ছিল কি না, কার্গো এলাকায় ফায়ার হাইড্র্যান্ট পয়েন্ট ছিল কি না, এবং অগ্নিনির্বাপণ যানগুলোর সক্ষমতা পর্যাপ্ত ছিল কি না।
যদিও বেবিচক দাবি করছে বিমানবন্দরটি আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থার (আইকাও) মানদণ্ড অনুযায়ী পরিচালিত হয়, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর জানিয়েছে, কার্গো এলাকায় কার্যকর অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না।
"বিমানবন্দরের কার্গো এলাকায় অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ অকার্যকর। সেখানে ফায়ার ডিটেকশন ও স্প্রিংকলার সিস্টেম কার্যকর অবস্থায় নেই। প্রয়োজনীয় শনাক্তকরণ ও স্প্রিংকলার সিস্টেমও স্থাপন করা হয়নি," দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-কে বলেন ফায়ার সার্ভিসের জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা।
তিনি আরও জানান, "ভবনটিতে কোনো ফায়ার জোন, এক্সিট রুট বা ধোঁয়া নির্গমন ব্যবস্থা (স্মোক ভেন্টিলেশন) নেই। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী, এসব নিরাপত্তা ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়নি। পুরো স্থাপনাটি অনেকটা স্থানীয় গুদামঘরের মতো—খোপ খোপ ভাগ করা। ফলে সেখানে আগুন লাগলে তা নেভানো অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। ধোঁয়ার কারণে ভেতরে কেউ টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়।"
তবে শাহজালাল বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এসএম রাগীব সামাদ এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেন, "আমাদের তথ্য অনুযায়ী, গুদামের ভেতরে প্রায় ১৩২টি ফায়ার এক্সটিংগুইশার ছিল এবং সেগুলো সক্রিয় ছিল। কিন্তু যখন আগুনের সূত্রপাত হয়, সেখানে তখন কেউ উপস্থিত ছিল না, তাই দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি।"
বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মোস্তফা মাহমুদ সিদ্দিক-ও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের বক্তব্যকে সমর্থন করে বলেছেন, "আমরা আইকাও -এর স্ট্যান্ডার্ড মেনেই চলছিলাম, এটা আপনি যাচাই করে দেখতে পারেন। আগুন শনাক্তের ৩০ সেকেন্ডের মধ্যেই সিভিল এভিয়েশনের ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায়।"
অবশ্য তিনি স্বীকার করেন যে, "যেখানে আগুনের সূত্রপাত হয় ওই শেডটির সামনে ও পেছনে স্প্রিংকলার সিস্টেম ছিল না, তবে মিনিমাম ফায়ার সেফটি যন্ত্রপাতি ছিল। বাংলাদেশে যেসব এয়ারপোর্ট আগে তৈরি হয়েছে, সেগুলোর বেশিরভাগেই পুরোনো লেআউটে তৈরি হওয়ায় আধুনিক ফায়ার সিস্টেম নেই। তবে আইকাও এর ন্যূনতম স্ট্যান্ডার্ডটা আমরা পূরণ করেছি এবং তা অনুমোদিতও।"
কে ছিল কুরিয়ার শেডের দায়িত্বে?
বেবিচক জানিয়েছে, কার্গো ভিলেজের একটি কুরিয়ার শেড থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়, যে আগুন ২৬ ঘণ্টা পরে সম্পূর্ণভাবে নেভানো সম্ভব হয়। বিমানবন্দর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সূত্রে জানা গেছে, এতে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
কিন্তু বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ, বিমান বা কাস্টমস—কেউই সেই শেডটির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিতে রাজি হয়নি।
বেবিচক চেয়ারম্যান মোস্তফা মাহমুদ সিদ্দিক টিবিএস-কে বলেন, "যেখান থেকে আগুনের সূত্রপাত, সেটি ছিল একটি কুরিয়ার অফিস। অনেকে বুঝতে পারেননি জায়গাটি আসলে কাদের নিয়ন্ত্রণে। বাস্তবে এই কুরিয়ার অফিস নিয়ন্ত্রণ করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন, কাস্টমস এবং সংশ্লিষ্ট কুরিয়ার সার্ভিস। বিল্ডিংটি বেবিচকের মালিকানায়, কিন্তু ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বিমানের।"
"এয়ারপোর্টে যত স্থাপনা আছে সবই সিভিল এভিয়েশনের। তবে দৈনন্দিন ব্যবস্থাপনায় থাকে বিমান, কাস্টমস, এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থা। কুরিয়ার শেডটি সিভিল এভিয়েশন বরাদ্দ দিয়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনকে, যা তারা ব্যবহারের জন্য কুরিয়ার কোম্পানিগুলোকে ভাড়া দেয়। গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্ব বিমানের।"
"আমরা সিভিল এভিয়েশনের পক্ষ থেকে ফায়ার সিস্টেম সরবরাহ করি। তবে এর রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবহার বিমানের কিংবা সংশ্লিষ্ট সংস্থার ওপর নির্ভর করে, বিশেষ করে যেখানে কাস্টমস বা কুরিয়ার কোম্পানিগুলোর সরাসরি কার্যক্রম রয়েছে," তিনি বলেন।
বেবিচক চেয়ারম্যান বলেন, "তবে অফিসটি শুক্রবার ও শনিবার বন্ধ থাকায়—সেখানে সিকিউরিটি লোক থাকলেও ভেতরে লোক ছিল না। বাইরে থেকে এক্সেস কন্ট্রোল করা থাকলেও অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো তখন জানা সম্ভব হয়নি। এসব এখন তদন্তে জানা যাবে।"
বাংলাদেশ বিমানের মুখপাত্র বোসরা ইসলাম টিবিএস-কে বলেন, "কাগজপত্র অনুযায়ী ২০১৩ সালের পর থেকে এগুলো আমাদের তত্ত্বাবধানে নেই। তবে যেহেতু এখন প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, আমরা বলব যে সেটা তদন্তে বেরিয়ে আসবে। পাঁচ কর্মদিবস সময় দেয়া হয়েছে কমিটিকে। ততক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে।
ঢাকা কাস্টম হাউসের যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেন, "আমাদের রেগুলার কাজ ওইদিন দেড়টার মধ্যে শেষ হয়ে যায়। তাই আগুন লাগার বিষয়ে আমাদের কোনো দায় থাকার সুযোগ নেই। তাহলে বেবিচক কীভাবে আমাদের ব্লেম দিচ্ছে। ওই জায়গাটি ক্যাবের অধীনেই রয়েছে বলে আমরা জানি।"
ফায়ার হাইড্রেন্ট কোথায় ছিল?
প্রশ্ন উঠেছে, বিমানবন্দরে প্রতিটা স্থাপনার সামনে এবং পিছনে (ভবনের বাইরে) ফায়ার হাইড্রেন্ট পয়েন্ট নেই কেন? বিশেষ করে কার্গো গুদাম এলাকায়। বিমানবন্দরের সূত্র জানায়, শুধুমাত্র বোয়িং-৭৭৭ রেসকিউ অপারেশনের জন্য মাত্র তিনটি ফায়ারফাইটিং গাড়ি আছে এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষের। তাই প্রশ্ন উঠছে, কেন কার্গোগুদাম এবং টার্মিনালের কথা বিবেচনা করে সক্ষমতা তৈরি করা হয়নি?
কার্গো গুদামে হাইড্রেন্ট পয়েন্ট না থাকার বিষয়টি স্বীকার করে শাহজালাল বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন রাগীব সামাদ বলেন, "কার্গো গুদাম এলাকায় ফায়ার হাইড্রেন্ট পয়েন্ট ছিল না। এটা থাকা উচিত ছিল। এখন যেহেতু কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণ অনেক বেড়েছে, সেই বিবেচনায় প্রতিটি বিল্ডিংয়ের সামনেই একটা হাইড্রেন্ট থাকা উচিত।"
তিনি বলেন, "ফায়ার হাইড্রেন্ট পয়েন্ট টার্মিনালের ভিতরে রয়েছে। সেখান থেকেই পাইপ লাগিয়ে তাৎক্ষণিক পানি সরবরাহ করা হয়েছে ফায়ার সার্ভিসকে। এছাড়া আমাদের ওভারহেড হাইড্রেন্ট সিস্টেমও রয়েছে, যেখান থেকে ফায়ার ফাইটিং গাড়ি পানি রিফিল করে থাকে। এগুলো কার্যকর ছিল এবং আগুন নেভানোর সময় ব্যবহৃতও হয়েছে। তবে একাধিক ইউনিট একসঙ্গে কাজ করায় রিফিল করতে কিছুটা সময় লেগেছে।"
পর্যাপ্ত ফায়ার ফাইটিং গাড়ি না থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, "টার্মিনাল-৩ প্রকল্পের আওতায় নতুন ফায়ার ফাইটিং গাড়ি আসার কথা রয়েছে। তবে এখনো সেগুলো হস্তান্তর হয়নি এবং আমাদের কিছু পর্যবেক্ষণ থাকায় আমরা টেকওভার করিনি। বিমানবন্দরের ফায়ার ফাইটিং টিমের শুধু শুধু ডামি উড়োজাহাজ বানিয়ে তাতে নিজেরা আগুন দিয়ে— সেই আগুন নেভানোর প্রশিক্ষণ আছে।"
তদন্ত কমিটি প্রশ্ন তুলেছে, এত উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে কেন অভিজ্ঞ ফায়ার সার্ভিস সদস্যদের নিযুক্ত করা বা ডেপুটেশনে আনা হয় না।
এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া কর্মকর্তা তালহা বিন জাসিম বলেন, "আমরা বিমানবন্দরের জন্য লাইসেন্স বা ফিটনেস সার্টিফিকেট দিই না, এগুলো বেবিচকের দায়িত্ব। তাই সব প্রশ্নের উত্তর আমাদের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়।"
বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক বলেন, "আমাদের নিজস্ব ফায়ার টিম রয়েছে, যারা প্রস্তুত থাকে। তবে ফায়ার সার্ভিসও দেশের যেকোনো জায়গার মতো সাড়া দেয়। যদি ফায়ার সার্ভিস এটিকে তাদের কেপিআইয়ের আওতায় আনতে চায়, তাহলে সদর দপ্তরের সঙ্গে সমন্বয় করে নতুন প্রস্তাব হিসেবে এটা বিবেচনা করা যেতে পারে।"
সর্বশেষ নিরাপত্তা অডিট কবে হয়েছিল?
সর্বশেষ ফায়ার সেফটি অডিট কবে সম্পন্ন হয়েছে এবং তার ফলাফল কী ছিল— এবিষয়টি নিয়েও কাজ করছে তদন্ত কমিটি।
এ বিষয়ে বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক বলেন, "আমি সুনির্দিষ্ট তারিখ জানি না, তবে ফায়ার অডিট নিয়মিতই হয়। টার্মিনালের ভেতরে প্রতিদিন আমাদের ফায়ার টিম বিভিন্ন দপ্তর ও কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেয়। কিচেন ও লাউঞ্জগুলোকেও অগ্নি-সুরক্ষার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় নিয়মিত। গত জুন মাসে কার্গো ও কুরিয়ার এলাকাতেও ফায়ার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল।"
অগ্নিনির্বাপণের জন্য ব্যবহৃত হাইড্রেন্ট, স্প্রিংকলার ও ফোম সিস্টেম কি নিয়মিত পরীক্ষার আওতায় ছিল কি-না? সর্বশেষ টেস্টের রেকর্ড কোথায়- এসব প্রশ্নও সামনে রেখেছে তদন্ত কমিটি।
এপ্রসঙ্গে নির্বাহী পরিচালক জানান,"অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রগুলো রেগুলার টেস্ট করা হয় এবং নিয়মিত ব্যবহারের উপযোগী রাখা হয়। আমাদের জানামতে, এগুলো সবই নিয়মমাফিক হচ্ছে এবং রেকর্ড রাখা হচ্ছে।"
অগ্নিসুরক্ষা নকশা (ফায়ার সেফটি ডিজাইন প্ল্যান) সর্বশেষ কবে আপডেট করা হয়েছে, বিমানবন্দরের কার্গো গুদামগুলোতে দহনযোগ্য উপাদান সংরক্ষণের সীমা বা বিধি আছে কি? থাকলে তা মানা হচ্ছিল কি-না; আমদানি কার্গো ভিলেজ ভবনটি কে ডিজাইন করেছে এবং এটি ফায়ার সেফটি সার্টিফিকেশন কবে ইস্যু হয়েছিল, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী এয়ারপোর্ট ইমার্জেন্সি প্ল্যান ও ফায়ার প্রিভেনশন পলিসি হালনাগাদ করার কোনো উদ্যোগ আছে কিনা—এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে তদন্ত কমিটি।
এছাড়া, বিমানবন্দরগুলোর অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিতে বেবিচক কী নতুন পদক্ষেপ নিচ্ছে, তাদের বার্ষিক বাজেট থেকে কত টাকা অগ্নিনিরাপত্তা উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণে বরাদ্দ থাকে— এসব বিষয়ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।