ভোটের নিরাপত্তায় সোমবার আইন প্রয়োগকারী ও গোয়েন্দা প্রধানদের সঙ্গে বসছে ইসি
ফেব্রুয়ারিতে আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সোমবার (২০ অক্টোবর) আগারগাঁওয়ে তাদের সচিবালয় কার্যালয়ে সব আইন প্রয়োগকারী ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানদের সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে বসবে।
ইসি সূত্র জানিয়েছে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিন ও অন্যান্য কমিশনাররা এই বৈঠকে অংশ নেবেন। বৈঠকে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা, ভোটকেন্দ্রের সুরক্ষা এবং দেশব্যাপী শান্তিপূর্ণ নির্বাচনী পরিবেশ বজায় রাখাসহ মোট ১৩টি এজেন্ডা থাকবে।
কমিশন এই বৈঠকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, বর্ডার গার্ড, কোস্ট গার্ড, আনসার ও ভিডিপি, ডিজিএফআই, এনএসআই, এনটিএমসি, র্যাব ও স্পেশাল ব্রাঞ্চ/সিআইডি-র শীর্ষ কর্মকর্তাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছে।
সেইসঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে প্রতিনিধিদের নিয়ে ২২ অক্টোবর 'মাঠ প্রশাসন সমন্বয় কমিটির সভা করতে যাচ্ছে ইসি।
ইসি সচিব আখতার আহমেদ গত মঙ্গলবার বলেন, ইসির নির্দেশনা অনুযায়ী রোডম্যাপ ধরে প্রস্তুতি চলছে। প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কেনাকাটার কাজ শেষ হয়েছে। পর্যবেক্ষক সংস্থার বিষয়ে আপত্তি আবেদনগুলো যথাসময়ে নিষ্পত্তি হবে। দল নিবন্ধনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এক সপ্তাহের মধ্যে হয়ে যাবে। নিবন্ধন অ্যাপ অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে বা নভেম্বরের শুরুতে উদ্বোধন হবে।
গত ১১ অক্টোবর চট্টগ্রামে মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনিক ও আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের সাথে এক মতবিনিময় সভায় সিইসি নাসির উদ্দিন বলেন, আসন্ন নির্বাচন আয়োজনে নিরাপত্তাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
১৩টি অগ্রাধিকারমূলক বিষয় কী কী?
আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক সভার এজেন্ডায় ১৩ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে রয়েছে—ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নিরাপত্তা, ভোটকেন্দ্রের সুরক্ষা ও নির্বাচনি এলাকায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন; আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর কর্মকাণ্ডে সমন্বয় সাধন ও সুসংহতকরণ; সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা ও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা; অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার রোধ ও নিয়ন্ত্রণ; এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুল ও মিথ্যা তথ্যের প্রচারণা রোধে কৌশল নির্ধারণ; নির্বাচনে বিদেশি সাংবাদিক ও প্রাক-নির্বাচনি পর্যবেক্ষকদের নিরাপত্তা সহযোগিতা প্রদান; পোস্টাল ভোটিং ব্যবস্থাপনা; নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে সশস্ত্রে বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন পরিকল্পনা; অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ন্ত্রণ; অঞ্চল, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের নির্বাচন অফিসের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ; পার্বত্য/দুর্গম এলাকায় নির্বাচনি দ্রব্যাদি পরিবহন এবং ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের জন্য হেলিকপ্টার সহায়তা প্রদান; গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মতামত/পরামর্শের আলোকে শান্তিশৃঙ্খলা বিষয়ক কার্যক্রম গ্রহণ; ড্রোন ক্যামেরা ব্যবহার নিষিদ্ধকরণ।
বড় উদ্বেগ ভোটারদের নিরাপত্তা
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ইনোভিশন কনসাল্টিংয়ের সাম্প্রতিক 'পিপলস ইলেকশন পালস সার্ভে: রাউন্ড ২–পার্ট ২' শীর্ষক এক জরিপে সারা দেশের ১০ হাজার ৪১৩ জন ভোটারকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, কেন তারা ভোটদানে বিরত থাকতে পারেন। তাদের মধ্যে ৩২.৬৫ শতাংশ ভোটার নিরাপত্তার বিষয়টিকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
ইসির নির্বাচনি পরিকল্পনায় আইনশৃঙ্খলাকে অগ্রাধিকার
ইসি গত ২৮ আগস্ট নির্বাচনি রোডম্যাপ প্রকাশ করে। সেখানে ২৪টি গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাপনাকে অন্যতম অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে ২০ অক্টোবর প্রথম বৈঠক হবে। এরপর তফসিল ঘোষণার ১৫ দিন আগে আরও একটি সভা অনুষ্ঠিত হবে, যেখানে বাহিনীগুলোর মোতায়েন পরিকল্পনা, সমন্বয় ও দিকনির্দেশনা চূড়ান্ত করা হবে।
এছাড়া নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে মাঠ প্রশাসন, মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স এবং নিয়োজিত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের দায়িত্ব পালনের বিষয়ে দিনব্যাপী প্রশিক্ষণের আয়োজনের পরিকল্পনাও আছে ইসির।
তফসিল ঘোষণার সার্বিক প্রস্তুতি, ঋণখেলাপি-সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ, ভোটকেন্দ্র থেকে বিশেষ খামে ফলাফল পাঠানো, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ ইত্যাদি বিষয়ে ৩১ অক্টোবরের মধ্যে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করবে কমিশন।
তফসিল ঘোষণার ২০ দিন আগে ইলেক্টোরাল ইনকোয়ারি কমিটি গঠন ও জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগে আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করার পরিকল্পনাও রয়েছে।
জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে সুষ্ঠুভাবে ভোট আয়োজনে গত ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে বিভিন্ন মহলের সঙ্গে সংলাপ শুরু করে ইসি। ইতিমধ্যে সুশীল সমাজ, শিক্ষাবিদ, ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার প্রতিনিধি, নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও নারী নেতৃত্বের সঙ্গে সংলাপ করেছে কমিশন। সুশীল সজাজের প্রতিনিধিরা বলেছেন, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি মানুষের আস্থা কমেছে। নির্বাচনের আগে এই আস্থা ফেরানো জরুরি।
সংলাপের এক আলোচনায় অতিথিদের প্রশ্নের উত্তরে নির্বাচন কমিশনার ও আইনশৃঙ্খলা সমন্বয় কমিটির প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, গত নির্বাচনগুলোতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শক্তিশালী অবস্থান থেকে নির্বাচন খারাপ করার কাজ করেছে। এবার হয়তো তারা অতটা শক্তিশালী থাকবে না, তবে ভালো নির্বাচনের জন্য কাজ করবে।
তিনি আরও বলেন, 'গত ১৫-১৬ বছরে যে সাংগঠনিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন হয়েছে, তা রাতারাতি বদলানো সম্ভব নয়। তবে আমাদের সক্ষমতাগুলো কাজে লাগিয়ে রোভার স্কাউটসহ স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগের মাধ্যমে নিরাপত্তা জোরদার করার চেষ্টা চলছে।'
ইসির সাবেক ভারপ্রাপ্ত সচিব মো. জাকারিয়া বলেন, ইসির নিজস্ব কর্মকর্তা মাত্র আড়াই হাজার, কিন্তু নির্বাচনে প্রয়োজন প্রায় ১০ লাখ জনবল। তাই নিয়োগে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা জরুরি।
ভোটার সংখ্যা ১২ কোটি ৭৫ লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে
ইসি সূত্রে জানা গেছে, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা ১২ কোটি ৭৫ লাখ হতে পারে। গত সংসদ নির্বাচনে ১২ কোটির বেশি ভোটারের জন্য ৪২ হাজারেরও বেশি ভোটকেন্দ্র ছিল। এবার ভোটকেন্দ্র না বাড়িয়ে কীভাবে সমন্বয় করা যায় সে বিষয়ে পরিকল্পনা নিচ্ছে ইসি সচিবালয়।
৩১ আগস্ট ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে চূড়ান্ত সম্পূরক ভোটার তালিকা প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তখন জানানো হয়, দেশে মোট ভোটার ১২ কোটি ৬৩ লাখ ৭ হাজার ৫০৪ জন। তবে এ ভোটারে সংখ্যা আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে, কারণ জাতীয় নির্বাচনের আগে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত যারা ১৮ বছর বয়সে পৌঁছাবেন, তাদেরও তালিকাভুক্ত করা হবে। ভোটের আগে চূড়ান্ত সংখ্যা তখনই নির্ধারিত হবে।
ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত ১৬ হাজার ভোটকেন্দ্র
নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কীভাবে দায়িত্ব পালন করবে বৈঠকে সে বিষয়ে আলোচনা হওয়ার কথা সম্প্রতি (জুলাই) তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
প্রেস সচিব বলেন, ৮ লাখের মতো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন হবে। এর মধ্যে ৫ লাখ ৭০ হাজার হচ্ছেন আনসার এবং ১ লাখ ৪১ হাজার হচ্ছেন পুলিশের সদস্য। এর মধ্যে ৪৭ হাজার পুলিশ সদস্য ভোটকেন্দ্রে থাকবেন। মূল্যায়নে দেখা গেছে, প্রায় ১৬ হাজার ভোটকেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।'
চলতি মাসে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের জানান, নির্বাচনে মাঠ পর্যায়ে প্রায় ৮০ হাজারের বেশি সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হবে।
২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটার ছিল ১১ কোটি ৯৭ লাখ, ভোটকেন্দ্র ৪২ হাজারের বেশি এবং ভোটকক্ষ ছিল ২ লাখ ৬১ হাজারের বেশি। ৬৬ জন রিটার্নিং অফিসার ও ৫৯২ জন সহকারী রিটার্নিং অফিসার এই প্রক্রিয়া তদারকি করেন।
