জুলাই যোদ্ধা কারা?

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৫ আগস্ট বিকেলে যশোরের একটি অভিজাত হোটেলে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এতে একজন বিদেশিসহ অন্তত ২৬ জনের মৃত্যু হয়। অভিযোগ রয়েছে, নিহতদের অনেকেই হামলায় অংশ নিতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন। খবর বিবিসির।
নিহতদের মধ্যে ২৪ জনের নাম অন্তর্ভুক্ত হয় অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষিত জুলাই শহীদের তালিকায়। এ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে একজনের নাম বাতিল করে বাকি নামগুলো যাচাই শুরু করেছে প্রশাসন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই হোটেলটি ছিল যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য শাহীন চাকলাদারের মালিকানাধীন। হামলার পর ভবনটি ভাঙচুর ও লুটপাটের পর আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
সেদিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী একাধিক গণমাধ্যমকর্মী জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের খবরে শহরজুড়ে মিছিল বের হয়। অনেক নেতার বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনাও ঘটে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক স্থানীয় সাংবাদিক বলেন, 'দড়াটানা থেকে গাড়িখানা মোড়ে আসা একটি মিছিলে কয়েকজন মোটরবাইকে ছিলেন। হোটেলের সামনে পৌঁছে কয়েকজন ভিতরে ঢুকে পড়ে। এরপর বাইরে থাকা লোকজনও ভেতরে ঢুকে চেয়ার-টেবিল নিয়ে বের হতে থাকে।'
তিনি আরও জানান, 'আগুন লাগার পর প্রথমে ফায়ার সার্ভিসকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। পরে ভেতরে নিজেদের লোক আটকা পড়েছে শুনে কয়েক ঘণ্টা পর তাদের প্রবেশের সুযোগ দেওয়া হয়।'
এখন প্রশ্ন উঠেছে, এমন ঘটনায় নিহত বা আহতদের জুলাই যোদ্ধা বা শহীদ হিসেবে গণ্য করা কতটা যুক্তিযুক্ত।
শুধু যশোর নয়, জুলাই অভ্যুত্থানে নিহত ও আহতদের তালিকায় থাকা অনেক নাম নিয়েই সম্প্রতি বিতর্ক দেখা দিয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, অনেকেই আন্দোলনে অংশ না নিয়েও তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন এবং সরকারি নানা সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন।
এই সুবিধার মধ্যে রয়েছে নিহতদের পরিবারকে এককালীন ৩০ লাখ টাকা ও মাসিক ২০ হাজার টাকা ভাতা, বিনামূল্যে ফ্ল্যাট, আহতদের জন্য ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত মাসিক ভাতা, অঙ্গহানির ক্ষেত্রে এক থেকে পাঁচ লাখ টাকা অনুদান, চিকিৎসা সহায়তা ও চাকরিতে অগ্রাধিকার।
যশোরের জেলা প্রশাসক মো. আজহারুল ইসলাম জানান, প্রশ্ন ওঠার পর হোটেল অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের বিষয়েও নতুন করে যাচাই চলছে।
নানা সমালোচনার পর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় জেলা প্রশাসকদের চিঠি পাঠিয়ে জুলাই যোদ্ধা ও শহীদদের তালিকা পুনরায় যাচাইয়ের নির্দেশ দিয়েছে।
সরকার নিজেই এই তালিকা তৈরি করলেও এখন বলছে, আন্দোলনে অংশ না নিয়েও যাদের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের কিছুদিন পর থেকেই আহত ও নিহতদের তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয়।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ৮৩৪ জনের নাম শহীদের তালিকায় গেজেট করে, পরে আরও ১০ জনের নাম যুক্ত হয়। ৩০ জুন প্রকাশিত সর্বশেষ গেজেট অনুযায়ী, শহীদের সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৪৪ জন। তবে আন্দোলনে সরাসরি যুক্ত না থাকা ও চারজনের নাম দ্বিগুণভাবে প্রকাশিত হওয়ায় ৩ আগস্ট আটজনের নাম বাতিল করা হয়। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, শহীদের সংখ্যা ৮৩৬ জন।
অন্যদিকে আহতদের প্রথম তালিকায় ছিল ১২,০৪৩ জনের নাম। পরে আরও ১,৭৫৭ জন যুক্ত হওয়ায় মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ১৩,৮০০।
সরকারি যাচাই-বাছাইয়ের পরও অভিযোগ রয়েছে, আন্দোলনে অংশ না নেওয়া অনেকের নাম এখনো তালিকায় রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক ফারুক ই আজম বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে শহীদদের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। জুলাই যোদ্ধা ও শহীদদের তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের কাজ এখনো চলছে।
তিনি জানান, 'জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার ও জুলাই যোদ্ধাদের কল্যাণ ও পুনর্বাসন অধ্যাদেশ, ২০২৫'-এ স্পষ্টভাবে বলা আছে, জুলাই যোদ্ধা বলতে বোঝায় তৎকালীন সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা ক্ষমতাসীন দলের হামলায় আহত ছাত্র-জনতাকে। আর শহীদ বলতে বোঝায় সেই হামলায় নিহতদের। 'এর বাইরে কারো তালিকায় থাকার সুযোগ নেই,' বলেন তিনি।
তবে অভিযোগ রয়েছে, এই সংজ্ঞার বাইরেও অনেকের নাম তালিকায় রয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানের পর থেকেই এসব নাম নিয়ে বিতর্ক চলছে। সমালোচনার মুখে এর আগে ১০ জনের নামও বাতিল করা হয়েছিল।
গত ২২ জুন জেলা প্রশাসকদের তালিকা পুনরায় যাচাইয়ের নির্দেশ দেয় মন্ত্রণালয়। চিঠিতে বলা হয়, শহীদ পরিবারকে সঞ্চয়পত্র ও আহতদের অনুদান ও চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু আন্দোলনে যুক্ত না থাকা ব্যক্তিদের নাম তালিকায় আসার অভিযোগ পাওয়া গেছে। তালিকা পুনরায় যাচাইয়ের নির্দেশে বলা হয়, প্রকৃত শহীদ ও আহতদের নাম নিশ্চিত করতে হবে।
সমালোচনা অব্যাহত থাকায় মঙ্গলবার মন্ত্রণালয় জানায়, ভুয়া জুলাই শহীদ ও যোদ্ধাদের নাম যাচাই করে তাদের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হবে এবং প্রয়োজন হলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টা. ফারুক ই আজম বলেন, 'এটা চলমান প্রক্রিয়া। জুলাই শহীদদের প্রত্যেকের বিষয়ে পৃথকভাবে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। একইভাবে জুলাই যোদ্ধাদের বিষয়েও যাচাই চলছে।'
তিনি আরও জানান, যারা মিথ্যা তথ্য দিয়ে এই তালিকায় নাম তুলেছেন, তাদের সব আর্থিক সহায়তা ফেরত নেওয়া হবে।