দীর্ঘ ৩৫ বছর পর চাকসু নির্বাচন: ভোটের প্রভাবক অনাবাসিক ও নারী শিক্ষার্থীরা

দীর্ঘ ৩৫ বছরের অপেক্ষার পালা শেষ করে আগামীকাল বুধবার (১৫ অক্টোবর) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রচার-প্রচারণা শেষ করেছেন প্রার্থীরা। এখন উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট গ্রহণের অপেক্ষা। এর মাধ্যমে দীর্ঘসময় পর গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে যাচ্ছেন চবি শিক্ষার্থীরা। প্রশাসনের পক্ষ থেকেও সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
একইদিন আবাসিক হল ও হোস্টেল সংসদ নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হবে। এবারের নির্বাচনের অনাবাসিক ও নারী শিক্ষার্থীদের ভোট বড় ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে। এজন্য সকল প্যানেল ও প্রার্থীদের ইশতেহার ও প্রতিশ্রুতিতে এসব ভোটার সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো প্রাধান্যও পেয়েছে।
চাকসু নির্বাচন কমিশনের তথ্যমতে, সপ্তম চাকসু নির্বাচনে প্রার্থীর সংখ্যা ৯০৬ জন। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় সংসদে ৪১৩ জন, হল ও হোস্টেল সংসদে ৪৯৩ জন। ছাত্রদল, বাম সংগঠন, ইসলামী ছাত্রশিবির, ইসলামী ছাত্র আন্দোলনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠন মিলে নির্বাচনে মোট ১৩টি প্যানেল ঘোষণা হয়েছে। এর বাইরে ৩৮৫ জন শিক্ষার্থী স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করছেন। এবারের চাকসু নির্বাচনের মোট ভোটার ২৭ হাজার ৫১৮ জন। এর মধ্যে ছাত্র ১৬ হাজার ৮৪ জন, ছাত্রী ১১ হাজার ৩২৯ জন।
শিক্ষার্থীদের ভোটাধিকার প্রয়োগের অনুরোধ জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার। আজ মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) সকালে গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, "এটি শিক্ষার্থীদের অধিকার। শিক্ষার্থীরা যেন নির্ভয়ে, নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারেন, আমরা সব ধরনের ব্যবস্থা করেছি। তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছি। শাটল ট্রেনের শিডিউল বাড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি শহর ও ক্যাম্পাসে যাতায়াতের জন্য বাসও থাকবে।"

ভোটের প্রভাবক অনাবাসিক ও নারী শিক্ষার্থীরা
স্বায়ত্তশাসিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে কাগজে-কলমে পূর্ণাঙ্গ আবাসিক হওয়ার কথা ছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু এখন প্রায় ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী আবাসিক হলের বাইরে থাকেন। নির্বাচনে এই অনাবাসিক শিক্ষার্থীরাই প্রভাবক হিসেবে ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে। অবশ্য সব প্যানেলের ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ইশতেহার ও প্রচারণায় আবাসনের প্রতিশ্রুতি প্রাধান্য পেয়েছে। ফলে অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের ভোট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণে। এজন্য প্রার্থীরা ক্যাম্পাসের পাশাপাশি আশপাশের কটেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেশন, শাটল ট্রেন ও ষোলশহর স্টেশনে প্রচার-প্রচারণার ব্যস্ত সময় পার করছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী ২৮ হাজার ৫১৫ জন। ১৪টি আবাসিক হলে আসন আছে ৬ হাজার ৩৬৯। তবে দ্বৈত আবাসন হিসেবে ব্যবহার করলে ১০ হাজার শিক্ষার্থীর আবাসন নিশ্চিত হয় না। ক্যাম্পাসের আশপাশে প্রায় ৫ থেকে ৬ হাজার শিক্ষার্থী বসবাস করেন। আরো ১০ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী থাকেন শহরে।
গত ১ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী জোবরা গ্রামবাসীর সঙ্গে চবি শিক্ষার্থীদের তুমুল সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে কয়েকশ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। তখন আবাসন সংকট নিয়ে নিরসনের দাবি আরো জোড়ালো হয়। বিষয়টির সঙ্গে যাতায়াত সমস্যা ও শিক্ষার্থী নিরাপত্তাও সম্পর্কিত। এর আগে ১৯৯০ সালের নির্বাচনে মোট ভোটার ছিলেন ১০ হাজার ৫২৬। তখন মাত্র ছয়টি আবাসিক হল ছিল। তখন অনাবাসিক শিক্ষার্থীর সংখ্যাও ছিল কম।

অন্যদিকে চাকসু নির্বাচনে মোট ২৭ হাজার ৫১৮ ভোটারদের মধ্যে ১১ হাজার ৩২৯ জন নারী শিক্ষার্থী। সাধারণত নারী শিক্ষার্থীরা তুলনামূলক রাজনীতির বাইরে থাকেন। ফলে বিশাল সংখ্যক এই নীরব ভোটাররাও নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণে ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে। নারী শিক্ষার্থীবান্ধব ক্যাম্পাস বিনির্মাণ এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের বিষয়টি প্রার্থীদের প্রচারণায় প্রাধান্য পেয়েছে। নারী শিক্ষার্থীদের আবাসিক হলগুলোকে কেন্দ্র করেও প্রচারণা মুখর ছিল। নারী ভোটারদের টানতে নানা কৌশলও অবলম্বন করেছেন প্রার্থীরা।

চট্টগ্রাম শহর ক্যাম্পাসে যাতায়াত করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস। তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আবাসন সংকটের পাশাপাশি যাতায়াত সমস্যা যারা নিশ্চিত করবে, আমরা তাদের বেছে নেব। শাটল ট্রেনেও শিক্ষার্থী সংকুলান হয় না। পর্যাপ্ত বাস পাওয়া যায় না। এ সমস্যার সমাধান প্রয়োজন। যাতায়াত নিয়ে নারী শিক্ষার্থীরা বেশি বিপাকে পড়েন।"
ছাত্রদল প্যানেলের সহসভাপতি (ভিপি) প্রার্থী সাজ্জাদ হোসেন হৃদয় দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "অতীতেও আমরা দেখেছি অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের প্রতি প্রশাসন বৈষম্যমূলক আচরণ করেছে। তাদের আবাসন নিশ্চিত করতে পারছে না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। মিল সিস্টেম চালুর করার মাধ্যমে হলের খাবার থেকে অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের বঞ্চিত করা হয়েছে। তাদের অতিথি বলে সম্মোধন করে, দিবসগুলোতে ফিস্টের (উৎসবে ভালো কাবার) টোকেন বিক্রির ক্ষেত্রে অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের থেকে দ্বিগুণ টাকা আদায় করা হয়েছে। আমরা নির্বাচিত হলে এই সংস্কৃতি দূর করব। আবাসন নিশ্চিত করতে প্রশাসনকে চাপ দেব। আর নারী শিক্ষার্থীদের প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব রয়েছে। আমরা নিরাপদ ক্যাম্পাস বিনির্মাণে কাজ করব।"

ছাত্রশিবির প্যানেলের সহসভাপতি (ভিপি) প্রার্থী ইব্রাহিম হোসেন রনি টিবিএসকে বলেন, "আবাসন সংকট দূর করতে আমরা স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করেছি। শাহজালাল ও শাহ আমানত হলের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের বাকি ১০টি হলে এক্সটেনশন (টিনের শেড) বা হাফ-বিল্ডিং নির্মাণ করা গেলে— প্রতি হলে ২০০-৩০০ জন করে অনেক শিক্ষার্থীর আবাসন সমস্যার নিরসন হবে। আর দীর্ঘমেয়াদে প্রশাসন থেকে নতুন হল নির্মাণ আদায় করা হবে। আর নারী শিক্ষার্থীদের মাতৃত্বকালীন ছুটি, কমন রুম, রিডিং রুম, ক্যাফেটেরিয়ায় তাদের জন্য স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করা, পর্দা কর্নার, নামাজের স্থান নিশ্চিতসহ নারীবান্ধব ক্যাম্পস বিনির্মাণের পদক্ষেপ থাকবে। সর্বোপরি নিরাপদ ক্যাম্পাস নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা থাকবে।"

পাঁচ ব্যালটে বৃত্ত ভরাট করতে হবে ভোটারদের
বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষদ, বিভাগ থেকে আবাসিক, ক্যাম্পাসের ঝুপড়ি থেকে শাটল— প্রচার-প্রচারণায় মুখর ছিল এতদিন। মতবিনিময় থেকে শুরু করে গান, সাংস্কৃতিক পরিবেশনা— ব্যতিক্রমধর্মী প্রচারণায় ভোটারদের টানতে প্রচেষ্টা ছিল প্রার্থীদের। সোমবার রাতে প্রচারণা আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়েছে। এবার ভোটের অপেক্ষার পালা।
নির্বাচন কমিশনের তথ্যমতে, শান্তিপূর্ণ ভোটগ্রহণ, সুশৃঙ্খল ও নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করতে চবি প্রশাসন ইতোমধ্যে নির্দেশিকা প্রকাশ করেছে। ভোটের দিন ক্যাম্পাসে এলাকায় বহিরাগত প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ওইদিন কাটা পাহাড় (বাণিজ্য অনুষদের সামনে), ৩ নম্বর গোডাউন (প্রফেসর ইউনুস ভবনের পূর্বে) এবং শহীদ মিনারের দক্ষিণ আর্চওয়ে দিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে পারবেন শিক্ষার্থীরা। প্রবেশের সময় পরিচয়পত্র কার্ড সঙ্গে রাখতে হবে।

প্রত্যেক ভোটারকে নির্দিষ্ট ভোটকেন্দ্রে গিয়ে আইডি কার্ড দেখিয়ে প্রবেশ ও ব্যালট গ্রহণ করতে হবে। ভোটকক্ষে প্রবেশের পর নির্বাচন কর্মকর্তা ভোটারের পরিচয় যাচাই করে ব্যালট পেপারে স্বাক্ষর করবেন। প্রতিজন ভোটারকে মোট পাঁচটি ব্যালট পেপার দেওয়া হবে। এর মধ্যে চারটি চাকসুর জন্য এবং একটি হল সংসদের জন্য। ভোটাররা গোপন কক্ষে গিয়ে নির্ধারিত কলম ব্যবহার করে পছন্দের প্রার্থীর নামের পাশে থাকা বৃত্ত সম্পূর্ণভাবে ভরাট করবেন। চাকসুতে মোট ২৬টি পদে ও হল সংসদে মোট ১৪টি পদে ভোট দিতে পারবেন।

এরমধ্যে চাকসুর নির্বাহী সদস্য পদে সর্বোচ্চ পাঁচটি, হল সংসদে সর্বোচ্চ তিনটি এবং হোস্টেল সংসদে সর্বোচ্চ তিনটি ভোট এবং বাকি পদগুলোতে একটি করে ভোট দেওয়া যাবে। কোনো পদের জন্য নির্ধারিত সংখ্যার বেশি ভোট দিলে – কেবল সেই পদের ভোট বাতিল হবে; অন্যগুলো বৈধ থাকবে বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। ভোট প্রদান সম্পন্ন করার পর নিজ হাতে ভ্যালেট পেপারের নম্বর অনুযায়ী পৃথক নির্দিষ্ট বাক্সে ফেলতে হবে। চাকসুর জন্য চারটি ব্যালট, হল বা হোস্টেল সংসদের একটি ব্যালট পেপার থাকবে।

চাকুসর প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক ড. মনির উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, "নির্বাচনে মোট ৬০টি ভোট কক্ষে ৭০০ গোপন বুথ থাকবে। প্রতিটি ভোট কক্ষে পাঁচটি মোট ৩০০ স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স থাকবে। ২০০ সিসিটিভি ক্যামেরা থাকবে। ১৫টি বড় স্ক্রিনে ভোট কেন্দ্রের কার্যক্রম দেখানো হবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নিরবিচ্ছন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের কথা বলা হয়েছে। এছাড়া ব্যাকআপ হিসেবে ক্যামেরার সঙ্গে ইউপিএস সংযোগ থাকবে। সব রেকর্ড থাকবে। ভোটগ্রহণ শেষ কেন্দ্রগুলো গণনা হবে।"