গাজীপুরে চীনা প্রতিষ্ঠানের রক্ত আমাশয়ের টিকার ট্রায়াল করতে চায় আইসিডিডিআরবি

চীনের একটি প্রতিষ্ঠানের উদ্ভাবিদ রক্ত আমাশয় বা শিগেলা রোগের টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল গাজীপুরে করতে চায় আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি)। তবে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব, নীতিগত অস্পষ্টতা ও স্থানীয়দের উদ্বেগের কারণে পুরো বিষয়টি এখন পর্যন্ত ঝুলে আছে।
চীনের একটি প্রতিষ্ঠান রক্ত আমাশয় বা শিগেলা রোগের একটি টিকা উদ্ভাবন করেছে। টিকাটির কার্যকারিতা যাচাইয়ের জন্য তারা বাংলাদেশে একটি বড় আকারের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করতে চায়; এর জন্য আইসিডিডিআরবি-র সহযোগিতা চেয়েছে। আইসিডিডিআরবি এই ট্রায়ালের জন্য গাজীপুরকে বেছে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে।
এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গত ১৩ এপ্রিল আইসিডিডিআরবির পক্ষ থেকে সংস্থাটির জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. রুবান রাকিব গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের (জিসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে একটি চিঠি দেন। চিঠিতে ট্রায়াল পরিচালনার জন্য অনুমতি ও সহযোগিতা চাওয়া হয়।
চিঠিতে বলা হয়, আইসিডিডিআরবির তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশে ৬ মাস থেকে ৫ বছর বয়সি শিশুদের উপর ওপর এই টিকার প্রতিরক্ষামূলক কার্যকারিতা, ইমিউনোজেনিসিটি ও সুরক্ষা যাচাই করতে একটি নিয়ন্ত্রিত, ডাবল-ব্লাইন্ড, প্লেসিবো-নিয়ন্ত্রিত 'ফেজ থ্রি' ক্লিনিকাল ট্রায়াল পরিচালনা করা হবে। এটি চলবে প্রায় দুই বছরব্যাপী।
চিঠিতে আরও বলা হয়, চীনে ইতিমধ্যেই ২১ হাজার মানুষের ওপর এই টিকার বিভিন্ন ধাপের (ফেজ-১ থেকে ৩) পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে এবং এটি নিরাপদ ও কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।
গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মো. 'রহমত উল্লাহ জানান, আবেদনটি পাওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে জিসিসির মাসিক সমন্বয় সভায় আলোচনা করা হয়। কিন্তু আমরা স্বাস্থ্যবিষয়ক কোনো গবেষণা করি না। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমতি দেওয়ার এখতিয়ার আমাদের আছে কি না, তা নিশ্চিত হতে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে মতামত চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। জবাবে সরকারের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান পাল্টা চিঠি দিলেও তাতে সুস্পষ্ট কোনো মতামত প্রদান করা হয়নি।'
জিসিসি সূত্র জানায়, গত ১৫ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর এমএনসি এন্ড এ এইচ-এর কাছে মতামত চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়। জবাবে গত ২ জুন লাইন ডিরেক্টর আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, সম্প্রসারিত টিকাদান (ইপিআই) কর্মসূচিতে কেবল দেশে সরকারিভাবে প্রদত্ত টিকা দেওয়া হয়ে থাকে। শিগেলা টিকা ইপিআই তালিকাভুক্ত টিকার অন্তর্ভুক্ত নয়। টিকার ট্রায়ালের অনুমোদনের সঙ্গে ইপিআইয়ের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
চিঠিতে বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল (বিএমআরসি) ও ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদনসহ অন্যান্য প্রক্রিয়া অনুসরণের পরামর্শ দেওয়া হয়।
এরপর জিসিসির পক্ষ থেকে ২৪ জুন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিকল্পনা ও গবেষণা) এবং বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের পরিচালকের কাছে মতামত চেয়ে পৃথক চিঠি দেয়া হয়।
এরপর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিকল্পনা ও গবেষণা) ডা. আফরিনা মাহমুদ ২১ জুলাইয়ের জবাবে জানান, 'গবেষণাটি কমিউনিটি পর্যায়ে পরিচালিত হবে এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীন কোনো প্রতিষ্ঠান ব্যবহৃত হবে না। তাই অধিদপ্তরের কোনো আপত্তি নেই।'
তবে বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
পরে জিসিসির পক্ষ থেকে ১৯ আগস্ট স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিবের কাছে মতামত চেয়ে চিঠি দেয়া হয়। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বলে, বিষয়টি সিটি করপোরেশনের নিজস্ব এখতিয়ার। এ বিষয়ে নিজেদেরই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার কথা বলা হয়।
এদিকে গাজীপুরে স্থানীয় অভিভাবক ও নাগরিকদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। অনেকেই শিশুদের ওপর পরীক্ষামূলক টিকা প্রয়োগে আপত্তি জানাচ্ছেন। অপরদিকে, টিকার ট্রায়ালে আগ্রহীরাও বিভিন্নভাবে জিসিসি কর্তৃপক্ষকে চাপ দিচ্ছেন।
গাজীপুরের চিকিৎসক ও বিএনপি জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মাজহারুল আলম বলেন, 'যেকোনো টিকা আবিষ্কারের পর তার প্রয়োগের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন লাগে। এসব অনুমোদন ছাড়া শিশুদের শরীরে পরীক্ষামূলক টিকা প্রয়োগ বিপজ্জনক হতে পারে।'
গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সোহেল হাসান বলেন, 'আমরা বিষয়টি নিয়ে সচেতন আছি। অনেকে এ নিয়ে কথা বলছেন। আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করেছি, এ ধরনের একটি টিকা আপনি কি আপনার সন্তানের উপর পরীক্ষা করতে দিবেন? যদি আপনি রাজি না হন, তাহলে আমি কীভাবে আমার এলাকার অন্য কোনো শিশুর ওপর এটি প্রয়োগ করতে দেব?'
এ বিষয়ে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক ও ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার শরফ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, 'আমরা নীতিগতভাবে একমত হয়েছি, সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগ এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট মতামত না দিলে আমরা গাজীপুরে শিগেলা টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমতি দেব না।