অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে দেশে পরিবেশবান্ধব রড উৎপাদনে পথিকৃৎ জিপিএইচ ইস্পাত

বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো বিশ্বের সর্বাধুনিক কোয়ান্টাম ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস প্রযুক্তি ব্যবহার করে পরিবেশবান্ধব উপায়ে রড উৎপাদন করে কার্বণ নিঃসরণের পরিমাণ কমিয়েছে জিপিএইচ ইস্পাত।
এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি ইস্পাত উৎপাদনে কার্বন নিঃসরণ ও জ্বালানি খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে সক্ষম হয়েছে—যে খাতটি বিশ্বব্যাপী উচ্চ কার্বন নিঃসরণের জন্য পরিচিত।
শুধু কাঁচা লোহা আহরণের পরিবর্তে স্ক্র্যাপ লোহা পুনর্ব্যবহার করার মাধ্যমে প্রতি টন ইস্পাত উৎপাদনে ১.৬৭ টন কম কার্বন নিঃসরণ হচ্ছে। পাশাপাশি উৎপাদন প্রক্রিয়ায় প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার ফলে প্রাকৃতিক গ্যাস ও বিদ্যুতের ব্যবহার ৫০ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ১৫০ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত জিপিএইচ ইস্পাতের কারখানার বার্ষিক উৎপাদনক্ষমতা বর্তমানে ১০ লাখ টন। এখানকার উৎপাদিত ইস্পাত ইতোমধ্যে চীনে রপ্তানি হয়েছে।
২০২০ সালে প্রতিষ্ঠানটি কারখানায় বিশ্বের সর্বাধুনিক কোয়ান্টাম ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস (কিউ-ইএএফ) প্রযুক্তি সংযোজন করে—যা এশিয়ায় প্রথম এবং বিশ্বে দ্বিতীয়। এ প্রযুক্তি পরিবেশবান্ধব ও জ্বালানিসাশ্রয়ী হিসেবে পরিচিত। এই প্রকল্পে প্রায় ২,৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে জিপিএইচ ইস্পাত।
কার্বন নিঃসরণ হ্রাস ও জ্বালানি সাশ্রয়ে 'কোয়ান্টাম' প্রযুক্তির সফল প্রয়োগ
জিপিএইচ ইস্পাতের তথ্যমতে, কোয়ান্টাম ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস প্রযুক্তিতে কাস্টিং থেকে সরাসরি রোলিংয়ে বিলেট স্থানান্তরিত হওয়ায় তুলনামূলক কম তাপের প্রয়োজন হয়, ফলে প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় প্রায় আড়াই গুণ প্রাকৃতিক গ্যাস সাশ্রয় সম্ভব হচ্ছে।
ইস্পাতে স্ল্যাগের সংমিশ্রণ রোধের কারণে উৎপাদিত হয় অধিক বিশুদ্ধ ইস্পাত। স্ক্র্যাপ লোহা প্রি-হিট করার ফলে বিদ্যুৎ ব্যবহার ৫০ শতাংশ এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহার ৫০ শতাংশেরও বেশি হ্রাস পায়। এতে বছরে প্রায় ২৬.৪৬ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস সাশ্রয় হচ্ছে। এভাবে জিপিএইচ ইস্পাত কার্যকরভাবে বর্জ্য ও গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমাচ্ছে।
উচ্চমানের টেকসই রড উৎপাদনে অগ্রগতি
বর্তমানে এই প্রযুক্তিতে উৎপাদিত ৬০০–গ্রেডের উচ্চশক্তির রড 'জিপিএইচ কোয়ান্টাম' ব্র্যান্ডে বাজারজাত করছে প্রতিষ্ঠানটি। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এবং হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালসহ দেশের বিভিন্ন বড় প্রকল্পে ইতোমধ্যে জিপিএইচ ইস্পাতের রড ব্যবহার হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির কোয়ালিটি কন্ট্রোল, রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী মশিউর রহমান ভূঁইয়া বলেন, "জিপিএইচ ইস্পাত দেশে প্রথমবারের মতো উচ্চশক্তির ৬০০ গ্রেড রড উৎপাদন ও বাজারজাত করছে। জিপিএইচ কোয়ান্টাম বি৬০০সি-আর এবং বি৬০০ডি-আর রড নির্মাণকে আরও শক্তিশালী, টেকসই ও নিরাপদ করছে। এর ফলে কংক্রিটের শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং রডে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত সাশ্রয় সম্ভব হয়, যা নির্মাণ ব্যয় কমায়।"
তিনি আরও জানান, "ছোট কলাম ব্যবহারের মাধ্যমে বেশি ফ্লোর স্পেস পাওয়া যায় এবং উন্নত নমনীয়তার কারণে ভূমিকম্পে সহনশীলতাও বাড়ে। পাশাপাশি উন্নত টাই-ব্যান্ড নিরাপত্তা, সহজ ঝালাইযোগ্যতা ও কম রড ব্যবহারের ফলে কার্বন নিঃসরণও উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়।"
"সব মিলিয়ে জিপিএইচ কোয়ান্টাম রড ভবিষ্যতের টেকসই ও পরিবেশবান্ধব নির্মাণের সেরা সমাধান," যোগ করেন তিনি।
বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে টেকসই উদ্যোগ
ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে জিপিএইচ ইস্পাত ২০১৭ সাল থেকে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ প্রকল্প হাতে নেয়। ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের গবেষণার ভিত্তিতে ২০১৯ সালে কারখানার পেছনে পাহাড়ের পাদদেশে ৫৫ একর জায়গাজুড়ে ১৫ লাখ ঘনমিটার পানি ধারণক্ষমতার কৃত্রিম জলাধার নির্মাণ করা হয়।
সংরক্ষিত পানি পাইপলাইনের মাধ্যমে পানি শোধনাগারে নেওয়া হয় এবং শোধনের পর তা কারখানা ও দৈনন্দিন কাজে পুনর্ব্যবহার করা হয়। জলাধারের চারপাশের পাহাড়ে ঔষধি, ফলজ ও বনজ গাছসহ দুই লাখের বেশি বৃক্ষ রোপণ করে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলা হয়েছে। এতে স্থানীয় জীববৈচিত্র্য রক্ষা, বন্যপ্রাণীর আবাস সংরক্ষণ এবং জনগণের জীবিকায় ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
সংরক্ষিত পানিতে মাছ চাষও করা হচ্ছে। পাশাপাশি স্থানীয় মানুষকে জলবায়ু সহনশীলতা, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সচেতন করা হচ্ছে।
অন্যদিকে, উৎপাদনে ব্যবহৃত পানির অপচয় রোধে জিরো লিকুইড ডিসচার্জ (জেডএলডি) সিস্টেম ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে উৎপাদনে ব্যবহৃত ৯০ শতাংশ পানি পুনর্ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে—ফলে কোনো পানি অপচয় বা দূষণ ঘটছে না। সাধারণত ১,০০০ টন রড উৎপাদনে গড়ে প্রায় ১৪ লাখ লিটার পানি প্রয়োজন হয়।
বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে বিশ্বমানের প্রযুক্তি
বায়ুদূষণ কমাতে জিপিএইচ ইস্পাত কারখানায় স্থাপন করেছে বিশ্বমানের অফ-গ্যাস ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট, যা নির্গমনকে প্রতি ঘনমিটারে মাত্র ১০ মাইক্রোগ্রাম পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে। এই মাত্রা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের তুলনায় অনেক কম।
উন্নত এই প্ল্যান্ট নাইট্রোজেন অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইডসহ ক্ষতিকর গ্যাসীয় উপাদান কার্যকরভাবে আটকায়, ফলে বাতাস থাকে পরিচ্ছন্ন এবং পরিবেশ দূষণ রোধ হয়। প্রতিষ্ঠানটি আন্তর্জাতিক ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি)-এর নির্ধারিত মানদণ্ড পূরণ করেছে এবং একইসঙ্গে বাংলাদেশের ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশন (এনডিসি) রোডম্যাপে প্রত্যক্ষভাবে অবদান রাখছে।
নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ
প্রতিষ্ঠানটির তথ্যমতে, জিপিএইচ ইস্পাতের কারখানায় উৎপাদন বজায় রাখতে প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন হয়। কার্বন নিঃসরণ ও বিদ্যুৎ ব্যয় কমাতে কারখানার ছাদে স্থাপন করা হয়েছে ৬.০৫ মেগাওয়াট সোলার পিভি সিস্টেম, যা বছরে প্রায় ৮৯,০০০ টন কার্বন ডাই–অক্সাইড নির্গমন রোধ করছে।
এই সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করে জিপিএইচ রিনিউবেল পাওয়ার প্ল্যান্ট, যেখান থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ক্রয় করে জিপিএইচ ইস্পাত নিজস্ব ব্যবহারের জন্য গ্রহণ করছে।
২০২৪ সালের ২১ অক্টোবর প্রতিষ্ঠানটি তাদের সোলার রুফটপ প্রকল্প থেকে অর্জিত রিনিউবেল এনার্জি সার্টিফিকেট (আরইসি) ট্রেডিংয়ের রাজস্ব গ্রহণ করে। মাত্র আট মাসে এই প্রকল্প থেকে প্রায় ২০ লাখ টাকা রাজস্ব আয় হয়েছে। দেশের ইস্পাত শিল্পে প্রথমবারের মতো আরইসি ট্রেডিং চালু করে জিপিএইচ ইস্পাত নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার, টেকসই উন্নয়ন ও জলবায়ু–দায়িত্বশীলতায় এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
যেভাবে শুরু
২০০৬ সালে প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে যাত্রা শুরু করে জিপিএইচ ইস্পাত। ২০০৯ সালে এটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরিত হয় এবং ২০১২ সালে ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হয়। বর্তমানে কোম্পানিটির শেয়ারহোল্ডার সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি।
কোয়ান্টাম ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস প্রযুক্তির উদ্ভাবনী প্রয়োগ, নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ এবং পরিবেশ–বান্ধব উৎপাদন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জিপিএইচ ইস্পাত বাংলাদেশের স্টিল শিল্পে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
পরিষ্কার, জ্বালানি–দক্ষ ও পরিবেশের প্রতি দায়িত্বশীল শিল্পায়নের পথে নেতৃত্ব দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি—যা দেশের টেকসই উন্নয়ন ও জলবায়ু প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এক অগ্রযাত্রার প্রতীক।