রিয়েল-টাইম ট্রান্সফার ও বিনিয়োগ সুবিধাই রেমিট্যান্সের বাজারে নেতৃত্ব দেবে: বিশেষজ্ঞরা

বাংলাদেশে রেমিট্যান্স খাতে আসছে বড় ধরনের পরিবর্তন। কাগজনির্ভর ধীর প্রক্রিয়া থেকে অতি দ্রুত ডিজিটাল ট্রান্সফারে পরিবর্তিত হচ্ছে এ খাত। আর্থিক বিশ্লেষক ও শিল্প সংশ্লিষ্টদের মতে, যারা রিয়েল-টাইম রেমিট্যান্স সেবা এবং নতুন ধরনের বিনিয়োগ সুবিধা দিতে পারবে, তারাই এ বাজারে আধিপত্য ধরে রাখতে পারবে।
সত্তর থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত বাংলাদেশি প্রবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রধান মাধ্যম ছিল ডিমান্ড ড্রাফ্ট (ডিডি)। কাগজনির্ভর এ প্রক্রিয়ায় ডাকযোগে ড্রাফ্ট দেশে আসত এবং ব্যাংক-ক্লিয়ারিং শেষে স্বজনদের হাতে টাকা পৌঁছাতে সময় লাগত ১৫–২০ দিন।
কিন্তু প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে প্রবাসীদের চাহিদায় এসেছে বড় পরিবর্তন। এখন তারা চান রেমিট্যান্স রিয়েল টাইমে পৌঁছাক—সরাসরি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বা মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) মাধ্যমে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সামনের দিনে যেসব প্রতিষ্ঠান দ্রুততম সময়ে রেমিট্যান্স পৌঁছে দিতে সক্ষম হবে, তারাই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকবে এবং বাজারে নেতৃত্ব দেবে। একইসঙ্গে প্রবাসীরা চাইছেন নতুন সুবিধা—যেমন বিনিয়োগ টুলস ও সঞ্চয়ের সুযোগ। এসব ফিচারের মাধ্যমে তারা প্রেরিত অর্থ বিনিয়োগ করে ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা মোকাবিলা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারবেন।
গাজীপুরের একটি রিসোর্টে বৃহস্পতিবার (২৫ সেপ্টেম্বর) 'দ্য চেইঞ্জিং ল্যান্ডস্কেপ অ্যান্ড ইমার্জিং অপরচুনিটিজ অব বাংলাদেশের রেমিট্যান্স' শীর্ষক এক কর্মশালায় এসব মতামত তুলে ধরেন বক্তারা। দিনব্যাপী এ কর্মশালার আয়োজন করে এমএফএস প্রতিষ্ঠান বিকাশ। এতে অংশ নেন বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা।
কর্মশালায় তিনটি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম অধিবেশনে বক্তব্য দেন বিকাশের প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা আলী আহম্মেদ।
তিনি বলেন, "আগে ব্যাংকের প্রতিনিধিরা বিদেশে গিয়ে শ্রমিকদের হিসাব ও লেনদেন বাড়াতে কাজ করতেন। এখন বিভিন্ন এমএফএস ও অর্থ স্থানান্তর প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রবাসী আয় পাঠানোর পুরো প্রক্রিয়া ডিজিটাল হয়েছে। এই কর্মশালা থেকে আগামী এক বছরের জন্য একটি পথনকশা তৈরির চেষ্টা থাকবে।"
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিকাশের বাণিজ্যিক বিভাগের প্রবাসী আয় শাখার প্রধান মোহাম্মদ জাহিদুল আহসান। তিনি বলেন, "দেশের প্রায় দেড় কোটি মানুষ বিশ্বের ১৭৬টি দেশে আছেন। তবে সব চিত্র ইতিবাচক নয়। এখনো ৫০ শতাংশের বেশি শ্রমিক অদক্ষ। ফলে প্রবাসী আয় প্রত্যাশিত হারে বাড়ছে না। অধিকাংশ তরুণ মনে করছেন, দেশে কিছু করতে না পারলে বিদেশে গিয়ে ভালো কিছু করতে পারবেন।"
প্যানেল আলোচনায় ব্র্যাক ব্যাংকের কর্মকর্তা শাহরিয়ার জামিল বলেন, "আগে প্রবাসী আয় মানেই ছিল 'ক্যাশ ওভার দ্য কাউন্টার'। গ্রাহকদের দূর থেকে ব্যাংক শাখা কিংবা এনজিও কার্যালয়ে গিয়ে টাকা তুলতে হতো। এতে সময় ও খরচ দুটোই বেশি ছিল। বর্তমানে দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ প্রবাসী আয় ডিজিটাল মাধ্যমে আসে। তবু নগদ অর্থে প্রবাসী আয় পাঠানোর চাহিদা পুরোপুরি কমেনি।"
ট্রাস্ট ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধান জহুরুল করিম চৌধুরী বলেন, "বৈদেশিক মুদ্রার সংকটকালে প্রবাসী আয়ের গুরুত্ব নতুনভাবে সামনে এসেছে। তবে তদারকি ও নীতিনির্ধারণের কারণে অনেক সময় ব্যাংকের প্রবাসী আয় গ্রহণে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।"
দ্বিতীয় অধিবেশনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিকাশের বিপণন শাখার মহাব্যবস্থাপক জয়ন্ত সেন। তিনি জানান, প্রবাসী আয়নির্ভর পরিবারগুলোর ৯২ শতাংশ এখন স্মার্টফোন ব্যবহার করে এবং এর মধ্যে ৭৭ শতাংশ ইন্টারনেট সংযুক্ত।
তৃতীয় অধিবেশনে বক্তব্য দেন ফিনটেক স্টার্টআপ ট্যাপট্যাপ সেন্ডের হেড অব গ্রোথ সুদর্শন শুভাশীষ দাস। তিনি বলেন, "এখন মানুষ টাকা পাঠাতে চান দ্রুত, সহজ ও কম খরচে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই রেমিট্যান্স খাতে নতুন সুবিধা নিয়ে এসেছে।"
এছাড়া, কর্মশালায় মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের নন রেসিডেন্ট ব্যাংকিং ডিভিশনের প্রধান খন্দকার আসিফ খালেদসহ অন্যান্য ব্যাংকের কর্মকর্তারা বক্তব্য দেন।