সরকার মসজিদ, মন্দির, মাজার রক্ষায় ব্যর্থ; নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি ‘সম্প্রীতি যাত্রা’র
দেশের বিভিন্ন জেলায় একের পর এক হামলায় মসজিদ, মন্দির, আখড়া, মাজারসহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তী সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে বলে দাবি করেছে নাগরিক সমাজ নিয়ে গঠিত নতুন প্ল্যাটফর্ম 'সম্প্রীতি যাত্রা'।
শনিবার (২০ সেপ্টেম্বর) দুপুর ১২টার দিকে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাগর-রুনি মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানায় প্ল্যাটফর্মটি। এ সময় দুর্বৃত্তদের হামলা ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে নাগরিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হয়।
তাদের অভিযোগ, সরকার হামলাকারী জনতাকে 'চাপ সৃষ্টি করা গোষ্ঠী' হিসেবে আখ্যা দিয়ে এসব আক্রমণকে বৈধতা দিচ্ছে, ফলে সহিংসতা ও নিপীড়নকে স্বাভাবিক করে তোলা হচ্ছে।
'মসজিদ-মন্দির-আখড়া-মাজার ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সুরক্ষায় সম্প্রীতি যাত্রার আহ্বান এবং আসন্ন দুর্গাপূজা উপলক্ষে ঝুঁকি মূল্যায়ন ও করণীয়' শীর্ষক অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সাংস্কৃতিক কর্মী ও শিল্পী বীথি ঘোষ। সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী মীর হুযাইফা আল-মামদূহ।
তিনি সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার উল্লেখ করে বলেন, 'কুমিল্লায় মাইকিংয়ের পর এক মাজারে হামলা হয়েছে এবং রাজবাড়ীতে কবর থেকে লাশ তুলে পোড়ানোর মতো ঘটনাও ঘটেছে।'
হুযাইফা বলেন, 'বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্যের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু দীর্ঘ দুই দশকের বেশি সময় ধরে পরিকল্পিতভাবে এই সম্প্রীতি নষ্ট করার প্রচেষ্টা চলছে। সাম্প্রতিক সময়ে মন্দির, মাজার, আখড়া, এমনকি বাউল আসরে হামলা বেড়েছে। হিন্দু সম্প্রদায়, সুফি, বাউল, আদিবাসীসহ নানা প্রান্তিক গোষ্ঠী একযোগে ঝুঁকির মুখে পড়েছে।'
তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে সংখ্যালঘুদের বসতবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, উপাসনালয় ও মাজার টার্গেটে পরিণত হতে পারে।
২৯ জেলা ঝুঁকিপূর্ণ
২০১৪ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে তৈরি করা এক 'ঝুঁকি মানচিত্র' তুলে ধরে হুযাইফা জানান, আসন্ন দুর্গাপূজা উপলক্ষে ২৯টি জেলা সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঝুঁকিতে রয়েছে।
এর মধ্যে ঢাকা, রংপুর, যশোর, চাঁদপুর ও নোয়াখালীকে 'উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। পাশাপাশি গাজীপুর, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, দিনাজপুর, খুলনা, কুষ্টিয়া, সুনামগঞ্জ, বরিশাল ও নেত্রকোনাসহ ২৪ জেলা 'মধ্যম ঝুঁকিতে' এবং বাকি জেলাগুলোকে 'স্বল্প ঝুঁকিপূর্ণ' ধরা হয়েছে।
বাকি ৩৫ জেলাকেও তারা ঝুঁকিমুক্ত বলছেন না, পরিস্থিতি বিবেচনায় তাদের কাছে সেসব জেলা 'নিন্ম ঝুঁকিপূর্ণ'।
এ সময় তিনি জানান, দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত সংস্কার এবং সম্প্রীতি জোরদারের লক্ষ্যে 'সম্প্রীতি যাত্রা'র আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলো।
হুযাইফা বলেন, 'সাম্প্রদায়িক উসকানি ও বিভ্রান্তি রোধে আমরা 'ফ্যাক্টচেকিং টিম' যুক্ত করছি। এছাড়াও আমরা ঝুঁকিপূর্ণ জেলাসমূহের স্থানীয় নাগরিক সমাজের সংগঠন, সংখ্যালঘুদের সংগঠন, সুফি ও মাজারভিত্তিক সংগঠন, বাউল ও ফকির সম্প্রদায়, আদিবাসী সংগঠন, নারী সংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠন, পেশাজীবী সংগঠন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর প্রগতিশীল অংশকে সংযুক্ত করেছি।'
তিনি মন্দির, শোভাযাত্রা, মাজার ও আখড়ার নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে প্রশাসন ও নাগরিকদের যৌথ প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান এবং অতীতের সব সাম্প্রদায়িক হামলার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করেন।
গবেষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক মাহা মির্জা বলেন, 'আমরা মনে করি অন্তর্বর্তী সরকার মব ঠেকানো থেকে শুরু করে মাজার পোড়ানো এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘু যে গোষ্ঠীগুলো আছে তাদের উপর যে নিপীড়নগুলো হয়েছে, সেগুলোর ব্যাপারে কার্যকরি পদক্ষেপ নিতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থান ছিল এক ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র কাঠামো ভাঙার আন্দোলন। অথচ আজ ভিন্ন ধর্ম, সংস্কৃতি ও মতের মানুষ ধর্মীয় ফ্যাসিস্টদের টার্গেটে রয়ে গেছে, আর রাষ্ট্র নীরব দর্শক।'
শিল্পী অরূপ রাহি বলেন, 'একটি মহল সাম্রাজ্যবাদী ও ফ্যাসিবাদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সামাজিক ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছে, যেখানে ধর্ম, বিশ্বাস ও সংস্কৃতির স্বাধীনতা দমিয়ে রাখা হচ্ছে। কেবল জনগণের ঐক্যই এর প্রতিরোধ গড়তে পারে।'
সাংস্কৃতিক কর্মী জমশেদ আনোয়ার তপন বলেন, 'আওয়ামী লীগ আমলে একটি সাম্প্রদায়িক হামলা বা নিপীড়নের ঘটনাও তদন্ত হয়নি, বিচার তো দূরের কথা। অন্তর্বর্তী সরকারও সেই নীতি ধরে রেখেছে, বরং আখড়া ও মাজারে হামলা বেড়েছে।'
