গায়েবানা জানাজা ও কফিন মিছিলেও হামলা করেছিল আওয়ামী সন্ত্রাসীরা: জবানবন্দিতে নাহিদ

জুলাই আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সারাদেশে ছাত্র-জনতার ওপর যে দমন-পীড়ন চালানো হয়েছিল, তা ছিল পরিকল্পিত ও রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিচালিত। সে সময় ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীরা নির্বিচারে গুলি চালিয়েছিল। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে গায়েবানা জানাজা ও কফিন মিছিলেও হামলা করেছিল।
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আজ বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ দেওয়া জবানবন্দিতে জাতীয় নাগরিক কমিটির (এনসিপি) আহ্বায়ক ও জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া নাহিদ ইসলাম এসব কথা বলেন। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের এই মামলায় ৪৭তম সাক্ষী হিসেবে তিনি সাক্ষ্য দেন।
নাহিদ বলেন, 'গত বছরের ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের ওপর হামলা হয়। হাসপাতালে আহত শিক্ষার্থীদের ওপরও হামলা হয়। ১৬ জুলাই আবু সাঈদ, ওয়াসিমসহ ছয়জন শহিদ হওয়ার পরদিন ১৭ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ে গায়েবানা জানাজা ও কফিন মিছিলেও হামলা চালানো হয়। একইদিন হলে থেকে শিক্ষার্থীদের জোর করে বের করে দেওয়া হয়।'
গত বছরের জুলাইয়ে 'কমপ্লিট শাটডাউন' কর্মসূচির কথা উল্লেখ করে নাহিদ বলেন, আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের ১৭ জুলাই রাতে দেশব্যাপী 'কমপ্লিট শাটডাউন' কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। আমাদের ভাই-বোনদের হত্যার প্রতিবাদে আমরা দেশের শিক্ষার্থীসহ সর্বস্তরের জনগণকে কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানাই। ১৮ জুলাই সারাদেশের ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে আসেন। বিশেষ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদরাসার শিক্ষার্থীরা সেদিন রাজপথে ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আমরা আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারীরা জীবনের হুমকির মুখে পড়ি। এজন্য গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে চলে যাই।
তিনি বলেন, 'ঢাকার বাড্ডা, উত্তরা, মিরপুর, যাত্রাবাড়ীসহ সারাদেশে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। সেই সঙ্গে ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরাও হামলায় অংশ নেয়। এসময় বহু মানুষ শহিদ ও আহত হন।'
নাহিদ আরও বলেন, 'সেদিন রাতে সারাদেশে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। একইভাবে ১৯ জুলাই আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। এতে অনেক ছাত্র-জনতা হতাহত হন। তবে ১৯ জুলাই আমরা বুঝতে পারি ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে গেছে সরকার। কারণ, আন্দোলনের কিংবা আহত-নিহতদের কোনো খবর মিডিয়ায় প্রচার হচ্ছিল না।'
ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে এ প্রসঙ্গে নাহিদ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, 'অনেক মিডিয়া হয়তো এর বাইরে ছিল বা চেষ্টা করেছে। আমরা পরবর্তী সময়ে এসব শুনতে পেয়েছি। কিন্তু ১৮ বা ১৯ জুলাই আমরা এসব দেখতে পাইনি। মিডিয়া বারবার দেখাচ্ছিল আন্দোলন স্থগিত হবে, সরকারের সঙ্গে বসবে, এমন নানা বিভ্রান্তিমূলক তথ্যে শিরোনাম করা হয়েছিল। আমরা মিডিয়া বা সাংবাদিকদের কাছে যে তথ্য পাওয়ার আশায় ছিলাম কিংবা এত হত্যাযজ্ঞ চলছে, তা টেলিভিশনে আসছিল না। সেই প্রেক্ষাপট থেকে বলেছি মিডিয়াকে সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে গেছে সরকার।'
জবানবন্দিতে নাহিদ আরও বলেন, '১৭ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করার পর আন্দোলনকারীদের ওপর চাপ প্রয়োগের চেষ্টা হয়। নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়, সরকারের সঙ্গে আপস না করলে দমন-পীড়ন আরও বাড়বে। তবে আন্দোলনকারীরা স্পষ্ট জানিয়ে দেন, রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে সরকারের সঙ্গে কোনো সংলাপ হবে না।'
তিনি বলেন, 'তৎকালীন সরকার ছিল ফ্যাসিবাদী। তিনবার নির্বাচনে ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে ক্ষমতা দখল করেছে এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয়করণ করেছে। ২০১৮ সালেই তাদের সন্দেহ হয়েছিল যে শেখ হাসিনা সরকার প্রকৃতপক্ষে কোটা সংস্কার বা বাতিল করতে চায়নি, বরং সময় সুযোগ বুঝে তা ফিরিয়ে আনতে চাইছিল। আর ২০২৪ সালের নির্বাচনের পর সেটিই বাস্তবায়িত হয়।'
নাহিদের ভাষ্য অনুযায়ী, কোটা সংস্কার প্রশ্নটি আদালতের নয়, রাজনৈতিক। তাই আন্দোলনকারীদের কাছে স্পষ্ট ছিল, রাজপথেই অবস্থান ধরে রেখে দাবি আদায় করতে হবে। আদালতের প্রতি তাদের আস্থা ছিল না বলেও জানান জুলাই আন্দোলনের এই নেতা।
ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামীম ও প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, নাহিদ ইসলাম আংশিক জবানবন্দি দিয়েছেন। আগামীকাল বৃহস্পতিবার বাকি জবানবন্দি রেকর্ড করবেন ট্রাইব্যুনাল।