'চোখের সামনেই লুট': শেখ হাসিনার আমলে শত শত কোটি ডলার অর্থ পাচার নিয়ে এফটির তথ্যচিত্র
যুক্তরাজ্যভিত্তিক দৈনিক ফিন্যান্সিয়াল টাইমস (এফটি) বৃহস্পতিবার 'বাংলাদেশের হারানো বিলিয়ন: চোখের সামনেই লুট' শিরোনামে নতুন একটি তথ্যচিত্র প্রকাশ করেছে। এতে শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনামলে ব্যাপক দুর্নীতি, অর্থ পাচার এবং অর্থ উদ্ধার সংক্রান্ত তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
এফটির তথ্যচিত্রে বলা হয়েছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে প্রায় ২৩৪ বিলিয়ন ডলার—বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২৮ লাখ ৫৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা—দেশ থেকে পাচার হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এই অর্থ কীভাবে বাইরে নেওয়া হয়েছে এবং তা ফেরত আনা সম্ভব কি না, তা অনুসন্ধান করতেই এফটি বিক্ষোভকারী, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছে।
পুরো তথ্যচিত্রজুড়ে নানা দিক তুলে ধরেছেন ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের দক্ষিণ এশিয়া ব্যুরোপ্রধান জন রিড, কৃষি ও পণ্যবাজারবিষয়ক প্রতিবেদক (যিনি একসময় বাংলাদেশে সাংবাদিকতা করেছেন) সুজ্যানা স্যাভিজ, দুর্নীতি পর্যবেক্ষক সংস্থা স্পটলাইট অন করাপশন-এর ডেপুটি ডিরেক্টর হেলেন টেলর এবং ওয়েস্ট মিনস্টার লবি দলের রিপোর্টার রাফে উদ্দিন। আছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই সমন্বয়ক রাফিয়া রেহনুমা হৃদি ও রেজওয়ান আহমেদ রিফাদের বক্তব্যও।
আন্দোলনের সূচনা ও সরকারের পতন
তথ্যচিত্রের শুরুতেই বলা হয়, ২০২৪ সালের গ্রীষ্মে শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত জনঅসন্তোষের বিস্ফোরণ ঘটে, যার সূত্রপাত হয় সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলন থেকে। সমালোচকদের মতে, স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা, বিরোধীদের গণহারে কারাবন্দী করা এবং নজিরবিহীন দুর্নীতি এই পতনকে ত্বরান্বিত করেছিল। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নেন।
জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, এই আন্দোলনে প্রায় ১,৪০০ মানুষ নিহত হয়েছেন এবং হাজার হাজার মানুষ আহত বা নিখোঁজ হয়েছেন, যদিও প্রকৃত সংখ্যা এখনো অজানা।
ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের (এফটি) দক্ষিণ এশিয়া ব্যুরো চিফ জন রিড বলেন, হাসিনার দল আওয়ামী লীগের সদস্যদের স্বজনদের সুবিধা দিতে একটি কোটা ব্যবস্থা চালু করার পরই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
'বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে'র অন্যতম সমন্বয়ক রাফিয়া রেহনুমা হৃদি জানান, প্রথমদিকে পুলিশের সাথে কোনো সরাসরি সংঘর্ষ ছিল না। তিনি বলেন, 'কিন্তু ১৪ই জুলাই পুলিশ রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে।'
আন্দোলনের আরেকজন সমন্বয়ক রিজওয়ান আহমদ রিফাত বলেন, পুলিশ এবং ক্ষমতাসীন দলের সশস্ত্র কর্মীরা 'সরাসরি গুলি, স্নাইপার শট এবং হেলিকপ্টার থেকে শেল নিক্ষেপ করে' বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালায়। তিনি জানান, তিনিও 'লাঠি আর পাথর হাতে রাস্তায় ছিলেন'।

পরিস্থিতির নাটকীয় মোড় আসে ৫ই আগস্ট, যখন পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালাতে অস্বীকার করে। এরপরই শেখ হাসিনা দেশ ছাড়তে বাধ্য হন।
সুজ্যানা স্যাভিজ বলেন, 'শেখ হাসিনার সমর্থকরা সহিংসতার সাথে তার জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। এনিয়ে তারা বেশ কয়েকটি তত্ত্ব তুলে ধরেন। এর মধ্যে একটা হলো—আওয়ামী লীগের একজন সিনিয়র নেতার মতে, ইসলামপন্থীরা আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠনের সদস্য হিসেবে সহিংসতায় উসকানি দিয়েছিল, যা পরবর্তীতে শেখ হাসিনার পতনের কারণ হয়। যদিও এই দাবির সমর্থনে আমি কোনো প্রমাণ দেখিনি।'
নজিরবিহীন দুর্নীতি ও যুক্তরাজ্যে অর্থ পাচার
যুক্তরাজ্যের হোয়াইট চ্যাপেল স্টেশনে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাতেও স্টেশনের নাম খোদাই করা আছে এমন চিত্র দেখানো হয় ভিডিওতে। এর প্রসঙ্গ ধরে সুজানা স্যাভিজ বলেন, 'এটি প্রমাণ করে বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের সম্পর্ক কত পুরনো। মূলত ঔপনিবেশিক যুগে, যখন বাংলাদেশ ভারতের অংশ ছিল, তখন থেকেই এই যোগাযোগ শুরু। দুই দেশের মধ্যে যাতায়াত ও সংযোগ এত দৃঢ় যে, যুক্তরাজ্য বাংলাদেশিদের জন্য স্বাভাবিক বিনিয়োগের জায়গা হয়ে ওঠে। অবশ্য, যুক্তরাজ্য বিশ্বের যে কোনো বিনিয়োগকারীর জন্যই আকর্ষণীয়। তবে যাদের আগে থেকেই সংযোগ রয়েছে, তাদের জন্য এ সুযোগ আরও বেশি।'
শেখ হাসিনা ও তার ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারের অভিযোগ জনগণের ক্ষোভ আরও বাড়িয়ে তোলে। অভিযোগ রয়েছে, বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের একটি বড় অংশ যুক্তরাজ্যে, বিশেষ করে আবাসন খাতে বিনিয়োগ করা হয়েছে।
দুর্নীতিবিষয়ক সংস্থা 'স্পটলাইট অন করাপশন'-এর ডেপুটি ডিরেক্টর হেলেন টেলর বলেন, 'ক্লেপ্টোক্রেসি এবং বড় দুর্নীতি একটি বৈশ্বিক সমস্যা, এবং যুক্তরাজ্য এই সমস্যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।' তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, যুক্তরাজ্যের বিশাল আর্থিক খাত এবং আকর্ষণীয় সম্পত্তির বাজার অর্থ পাচারকারীদের জন্য বিশেষভাবে আকর্ষণীয়।
ওয়েস্ট মিনস্টার লবি দলের রিপোর্টার রাফে উদ্দিন বলেন, 'আমরা যখন যুক্তরাজ্যের রাজনৈতিক দল ও তাদের বড় দাতাদের যোগসূত্র অনুসন্ধান করছিলাম, তখনই বাংলাদেশ শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। তখনই আমাদের কাছে বিষয়টি বৈশ্বিক খবর হিসেবে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কারণ, হাসিনা ও তাঁর পরিবার নিজেরাও আন্তর্জাতিকভাবে বিস্তৃত। তাঁর বোন শেখ রেহানা যুক্তরাজ্যের নাগরিক, আর রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক লেবার পার্টির এমপি ছিলেন—কিছুদিন আগেই তিনি স্টারমার সরকারের মন্ত্রী পদে দায়িত্ব পালন করেছেন।'
তথ্যচিত্রে বলা হয়, টিউলিপ সিদ্দিকসহ শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার পরিবারের কয়েকজন সদস্য বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ দুর্নীতির যে তদন্ত করছে, তাতে অবকাঠামো প্রকল্প থেকে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে অভিযুক্ত। দুই পরিবারের কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে ঢাকায় রাষ্ট্রীয় জমি বেআইনি প্রভাব খাটিয়ে দখলের অভিযোগে মামলাও চলছে।
এ ছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে টিউলিপ সিদ্দিককে ঘিরে অনেক প্রশ্ন উঠেছে, এতে তার মন্ত্রিত্বের উপযুক্ততা নিয়ে সংশয় দেখা দেয়, যখন অভিযোগ ওঠে—তার পরিবার নাকি দরিদ্র একটি দেশ থেকে অর্থ পাচার করেছে।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন টিউলিপ সিদ্দিক। তার পক্ষ থেকে জানানো হয়, 'বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ তার সাথে কখনও এ ব্যাপারে যোগাযোগ করেনি, আদালতের সমনও তার কাছে পৌঁছায়নি এবং পূর্বাচলে কোনো জমিও তার মালিকানায় নেই।'
আরও জানানো হয়, 'তার আইনি দলের বারবার অনুরোধের পরেও, এ সংশ্লিষ্ট কোনো প্রমাণ দেখানো হয়নি। বরঞ্চ, কোনো আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ ব্যতীতই কর্তৃপক্ষ গণমাধ্যমে বক্তব্য প্রদান করেছে।
'এ কথিত বিচার প্রহসন ছাড়া কিছু নয়। সিদ্দিক কোনো ভুল করেননি। ভবিষ্যতে যদি কখনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ হাজির করা হয়, তখনই তিনি তার জবাব দেবেন', আরও বলা হয় তার পক্ষ থেকে।
এ ব্যাপারে সজীব ওয়াজেদ ও সায়েমা ওয়াজেদের মন্তব্য নিতে চাইলেও তাদের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি বলে জানায় এফটি।
সুজানা স্যাভিজ বলেন, 'আমি বহু বছর বাংলাদেশে থেকেছি এবং সেখানকার সংবাদ কাভার করেছি। সে সময় যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশি অর্থ পাচার নিয়ে অসংখ্য টিপস পেয়েছিলাম। পরে শেখ হাসিনার পতনের পর আমি সহকর্মী রাফে উদ্দিনের সঙ্গে আলোচনা শুরু করি—এসব তথ্য কীভাবে তদন্ত করা যায়।'
রাফে উদ্দিন বলেন, 'একজন সূত্র আমাকে কিছু সম্পত্তির কাগজপত্র ও নিবন্ধনের নথি পাঠান। এর মধ্যে একটি নথি বিশেষভাবে দৃষ্টি কাড়ে। সেটি হলো লন্ডনের কিংস ক্রস এলাকায় একটি ফ্ল্যাট, যা টিউলিপ সিদ্দিক ২০০০–এর দশকের শুরুর দিকে পেয়েছিলেন। তখন তার বয়স ২২ বছরের বেশি হওয়ার কথা নয়। ওই ফ্ল্যাটটি সিদ্দিককে হস্তান্তর করেছিলেন এক ডেভেলপার, যার সঙ্গে বাংলাদেশের সাবেক শাসনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের তথ্য পাওয়া যায়।'

এখান থেকেই টিউলিপ সিদ্দিককে ঘিরে তদন্ত আরও গতি পায়, যা আংশিকভাবে চলতি বছরের শুরুর দিকে তাঁর পদত্যাগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
তথ্যচিত্রে এ বিষয়ে টিউলিপ সিদ্দিকের বক্তব্যও প্রচার করা হয়। তিনি সেখানে বলেন, 'এটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত একটি প্রচেষ্টা, আমাকে হয়রানি করার চেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়। আমি কোনো ভুল করেছি—এমন প্রমাণ নেই।'
এফটি'র এক অনুসন্ধানে দেখা যায়, শেখ হাসিনা সরকারের ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর একারই যুক্তরাজ্যে ৩০০টির বেশি সম্পত্তি রয়েছে। অথচ বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া কোনো ব্যক্তি বছরে ১২,০০০ ডলারের বেশি অর্থ দেশের বাইরে নিতে পারেন না। যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি (এনসিএ) এরই মধ্যে ৩৫০টি সম্পত্তি চিহ্নিত ও জব্দ করেছে, যা এফটি'র অনুসন্ধানের সাথে মিলে যায়। সাইফুজ্জামান চৌধুরী এ বিষয়ে এফটি'র কোনো প্রশ্নের জবাব দেননি।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হিসাব অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনা সরকারের শাসনামলে প্রতি বছর দেশ থেকে ১৬ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত পাচার হয়ে থাকতে পারে।
সুজানা স্যাভিজ বলেন, বাংলাদেশের শাসনক্ষমতা মূলত দুই প্রধান দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তবে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনে শেখ হাসিনা পুনর্নির্বাচিত হন, যা দেশের গতিপথ সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তন করে।
তথ্যচিত্রে নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের (এসওএএস) অর্থনীতির অধ্যাপক মোশতাক খানের বক্তব্যও প্রচার করা হয়। বদিউল আলম মজুমদার বলেন, 'হাসিনার শাসনে লুটপাট ছিল ব্যাপক।'
মোশতাক খান বলেন, 'উন্নয়নশীল দেশে দুর্নীতির সাধারণ ধারা হলো—শাসক দলকে তার সমর্থকদের মধ্যে অর্থ বিলাতে হয়, তা না হলে তারা ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারে না। তবে এটি কোনোভাবেই উচিত নয়। রাজনৈতিক দল যদি রাষ্ট্রকে কব্জা করে, তা হলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। আমার মনে হয়, শাসনামলের শেষ দিকে আওয়ামী লীগ অর্থনীতি ও নিজেদের দল—দুয়ের নিয়ন্ত্রণই হারিয়ে ফেলেছিল।'
ব্যাংকিং খাতে লুটপাট ও অর্থ পাচারের কৌশল
দক্ষিণ এশিয়া ব্যুরোপ্রধান জন রিড বলেন, শেখ হাসিনা সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা দেশের শক্তিশালী সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই-এর সহায়তায় ব্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেয়।
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান তথ্যচিত্রের এ পর্যায়ে জানান, ২০১৭ সালে তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। তিনি বলেন, 'আমার গাড়িটি ডিজিএফআই সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়। ডিজিএফআই প্রধান জেনারেল আকবর আমাকে বলেন যে সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ চায় আমি যেন পদত্যাগ করি।' সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ বলতে তিনি প্রধানমন্ত্রীর দিকেই ইঙ্গিত করেন।
'আমরা এমন গল্পও শুনেছি—কিছু ব্যাংক পরিচালককে গোয়েন্দারা অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে যেত, শেয়ার হস্তান্তরের কাগজে সই করিয়ে পদত্যাগে বাধ্য করত—আর সেই শেয়ার যেত পুরোনো শাসকদের ঘনিষ্ঠদের হাতে', বলেন জন রিড।
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এ নিয়ে বলেন, 'তারা যা করেছে অবিশ্বাস্য—বন্দুকের মুখে বোর্ডকে সরিয়ে দিয়ে নিজেদের বোর্ড বসিয়ে দেয়। এরপর নিজেদের লোকদের নামে ঋণ ইস্যু করে। সবাই জানত যে এই ঋণ আর ফেরত দিতে হবে না।'

এই দখলের পর ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ মারাত্মকভাবে বেড়ে যায়। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে এই হার ইতিমধ্যেই উচ্চ ছিল, আর ইসলামী ব্যাংকের মতো ব্যাংকের ক্ষেত্রে তা দখলের পর আরও বৃদ্ধি পায়।
সম্পদ উদ্ধার টাস্কফোর্সের একজন পরামর্শদাতা হিসেবে পরিচয় দিয়ে ইফতি ইসলাম বলেন, 'কোনো পরিবার এক ব্যাংকের ১০ শতাংশের বেশি অংশীদার হতে পারবে না। কিন্তু বাস্তবে কিছু গোষ্ঠী একাধিক ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করে নিজেদের স্বার্থে ঋণ প্রদান করতেন। এসব ঋণ প্রায়শই কাল্পনিক প্রতিষ্ঠান বা এমন ব্যক্তিদের দেওয়া হতো যাদের কাছে কোনো জামিন বা অর্থ ফেরত দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না।
সুজ্যানা স্যাভিজ এরপর জানান, এস. আলম গ্রুপের মালিক মোহাম্মদ সাইফুল আলমের বিরুদ্ধে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার বা তার বেশি অর্থ বাংলাদেশ থেকে বের করে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে, যা অন্তর্বর্তী সরকার তদন্ত করছে। যদিও এস. আলম গ্রুপ এই অভিযোগকে 'সম্পূর্ণ অসত্য' বলে দাবি করেছে।
ইফতি ইসলাম বলেন, 'অর্থ পাচারের জন্য মূলত 'ওভার-ইনভয়েসিং' (আমদানিতে বেশি মূল্য দেখানো) এবং 'আন্ডার-ইনভয়েসিং' (রপ্তানিতে কম মূল্য দেখানো) পদ্ধতির ব্যবহার করা হতো। এছাড়া একটি অনানুষ্ঠানিক অর্থ স্থানান্তর ব্যবস্থাও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।'
সুজানা এ ব্যাপারে বলেন, 'হুন্ডি, যা অন্য দেশে হাওয়ালা নামে পরিচিত, এটিও অবৈধ অর্থপাচার বা মানি লন্ডারিং-এর জন্যও কাজে লাগতে পারে। বাংলাদেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া কোনো ব্যক্তি বছরে ১২ হাজার ডলারের বেশি টাকা দেশে বাইরে নিতে পারবে না। বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে দেখা গেছে, ব্যাংক ঋণ মঞ্জুর হলে সংশ্লিষ্ট সবাই তাদের অংশ নিয়ে নেয়, ঋণটি কখনো ফেরত দেওয়া হয় না। এরপর সেই অর্থ পাচারের জন্য হুন্ডি নেটওয়ার্ক ব্যবহৃত হয়।'
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এ সময় জানান, 'এক হিসাব অনুযায়ী—ব্যাংকিং খাত ও ব্যবসায়িক খাত মিলিয়ে মোট ২৩৪ বিলিয়ন ডলার লুটপাট হয়েছে বিভিন্ন উপায়ে। এটি সম্ভবত কোনো দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অর্থপাচার।'
জন রিড জানান, বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন যাচাই করছে, সাবেক শাসন-ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা বড় অবকাঠামো প্রকল্পগুলো থেকে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন কি না। এর মধ্যে একটি হলো পদ্মা সেতু, যেটিতে দুর্নীতির আশঙ্কায় বিশ্বব্যাংক ঋণ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। আরেকটি হলো দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র।

তথ্যচিত্রে একজন আওয়ামী লীগ মুখপাত্রের বক্তব্যও লিখিত আকারে প্রকাশ করা হয়। তিনি বলেন, 'বাংলাদেশ থেকে ২৩৪ বিলিয়ন ডলার লুট হয়েছে বলে অভিযোগ সম্পূর্ণ হাস্যকর। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ২৩৪ বিলিয়ন ডলারের কোনো চুরি ঘটলে রাষ্ট্র ও অর্থনীতি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে যেত। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে যা ঘটেছে তা হলো—দেশের অর্থনীতি ৪৫০ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, 'শেখ হাসিনা এবং তার নিকটবর্তী মহল ও পরিবারের সদস্যরা সব ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেন। যদি কখনও নির্দিষ্ট দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়, তা তাঁরা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে প্রতিহত করবেন।'
ড. মোশতাক খান বলেন, 'এসব বিষয় একেবারেই গোপন ছিল না। পত্রপত্রিকা ও মিডিয়ায় এ নিয়ে প্রচুর আলোচনা হতো। দুর্নীতি ছিল প্রকাশ্য এবং চোখের সামনে; তবু কারও কিছু করার ক্ষমতা ছিল না। অধিকাংশ মানুষ আতঙ্কিত ছিলেন, তারা জানতেন, কথা বললে নিজেকে হারাতে হতে পারে। ব্যাপক গুম, গুপ্ত কারাগারে আটকে রাখা, রহস্যজনক হত্যা—এসব ঘটত। দুর্নীতির কথা সবাই জানত, তবু চুপ থাকতেই হলো।'
নতুন সরকার ও সম্পদ পুনরুদ্ধারের চ্যালেঞ্জ
শেখ হাসিনার পতনের পর নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। তার সরকারের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো পাচার হওয়া সম্পদ পুনরুদ্ধার এবং দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার।
তিনি বলেন, 'আমাদের সময় সীমিত, কারণ এটি একটি অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু আমাদের এই প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে।'
এই লক্ষ্যে আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তা আহসান এইচ মনসুরকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এবং অ্যাসেট রিকভারি টাস্ক ফোর্সের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আহসান মনসুর বলেন, 'আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর দেখি, অন্তত ১১টি ব্যাংকের আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়ার মতো তারল্য ছিল না। আমাকে অবিলম্বে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে এবং ব্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিতে হয়েছে।'
তিনি আরও জানান, 'আর্থিক ব্যবস্থা সচল রাখতে আমাদের ২৩০ বিলিয়ন টাকা (২.৩৮ বিলিয়ন ডলার) ঢালতে হয়েছে। এখন কিছু ব্যাংককে "নির্বাচিত পুনর্গঠন" করতে হবে, নতুন বিনিয়োগকারী খুঁজে আনতে হবে, এগুলো একীভূত বা একত্রিত করে সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে পরিচালনা করতে হবে।'
জন রিড এ সময় বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর অনুমান করেন যে এস আলম গ্রুপ ডিজিএফআইয়ের (বাংলাদেশের একটি নিরাপত্তা সংস্থা) সহায়তায় ১০ বিলিয়ন ডলার বাইরে সরিয়ে নিয়েছে।

আর সুজানা বলেন, 'এস আলম গ্রুপও দাবি করেছে, অন্তর্বর্তী সরকারের কারণে তাদের ব্যাংকগুলোতে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে—ঋণ দেওয়ার সুযোগ বন্ধ করা হয়েছে এবং ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা টিম পরিবর্তন করা হয়েছে। তাই এস আলম গ্রুপ এই পরিস্থিতিতে নিজেকে ভুক্তভোগী মনে করছে।'
এবিষয়ে এস আলম গ্রুপের একজন প্রতিনিধির বক্তব্য হলো, 'অন্তর্বর্তী সরকার জনসাধারণের সামনে নিজেদের "সম্পদ পুনরুদ্ধারকারী" হিসেবে প্রদর্শন করার জন্য ব্যাপক সংবাদ প্রচারণা চালাচ্ছে। তবে এমন কোনো কার্যক্রমকে সমর্থনকারী চূড়ান্ত আদালতের কোনো সিদ্ধান্ত এ পর্যন্ত নেই।'
'অন্তর্বর্তী সরকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো পুরো বাংলাদেশের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনা, যাতে তারা সরকারের নীতিমালা বাস্তবায়নে সুবিধা প্রদান করতে পারে', আরও বলেন তিনি।
আর এস আলম পরিবারের একজন সদস্য বলেন, 'অন্তর্বর্তী সরকার স্বেচ্ছাচারীভাবে "দুর্নীতি দমন অভিযান" বলে আড়াল করে বাংলাদেশের অনেক বড় ব্যবসায়িক গ্রুপের সম্পদ হঠাৎ জব্দ করেছে, তা কোনো নোটিশ ছাড়াই, শুনানি ছাড়াই এবং কোনো ক্ষতিপূরণ ছাড়াই।'
অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর নির্বাচনের চাপ
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে শুরুতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জনপ্রিয়তা বেশ বড় ছিল। তিনি বাংলাদেশে এবং আন্তর্জাতিকভাবে অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচিত হতেন। তবে এখন পরিস্থিতি কিছুটা জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জন রিড বলেন, ড. ইউনূসের ওপর দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার চাপ বাড়ছে। তিনি [ইউনূস] বলেছেন, নির্বাচন ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হবে, তবে আগে বাংলাদেশের দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কার করতে হবে।
এই প্রসঙ্গে ইউনূস বলেন, 'আমাদের যতটা সম্ভব সংস্কার করতে হবে। আমরা আবার এমন কোনো ফ্যাসিবাদী শাসন চাই না—যেখানে সরকারি কর্মকর্তা, বিচার বিভাগসহ সবকিছুকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়।'
জন রিডের ভাষ্যে, বিএনপি ছিল শেখ হাসিনার সময় সবচেয়ে বড় বিরোধী দল, তাদের জেতা প্রায় নিশ্চিত। সুজ্যানা স্যাভিজ যুক্ত করেন, 'ওপরের স্তরে সরকার পরিবর্তন হয়েছে হলেও, নিচের স্তরে এখনও বিশাল আমলাতন্ত্র আছে, যারা খুব একটা বদল হয়নি।'
আওয়ামী লীগের মুখপাত্রের এ নিয়ে বক্তব্য হলো, 'বাংলাদেশে প্রকৃত দুর্নীতি হচ্ছে ইউনূসের নির্বাচিত নয় এমন সরকার। এই সরকার আগামী বছরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে অংশগ্রহণ থেকে বঞ্চিত করেছে, ফলে কোটি কোটি ভোটার তাদের ভোটাধিকার হারাচ্ছেন। কারণ তারা সঠিকভাবে আশঙ্কা করছে যে বর্তমান শাসকরা স্থায়ীভাবে ক্ষমতা দখল করতে চাইছে।'
পাচারকৃত অর্থ উদ্ধার ও সংস্কারের ভবিষ্যৎ
ইফতি ইসলাম বলেন, 'যখন কেউ শত শত মিলিয়ন বা বিলিয়ন ডলার চুরি করে, তখন তিনি বিশ্বের সেরা আর্থিক কাঠামোবিদ, আর্থিক পরামর্শক এবং আইনজীবীদের ভাড়া করতে পারেন, যারা তার টাকা সরানো ও লুকাতে সাহায্য করে। সম্পদ উদ্ধার টাস্কফোর্সের বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি হলো—যারা এই সম্পদ লুট করেছে, তারা বহু আগে থেকেই পরিকল্পনা করে রেখেছে। টাকা কোথায় গেছে তা না জানলে তা ফেরত আনা সম্ভব নয়।'
জন রিড বলেন, 'বাংলাদেশ দক্ষ জনবল সংকটে ভুগছে, যারা প্রাথমিক আইনি এবং তথ্য ভিত্তি তৈরি করবে, যাতে টাকা ফেরত আনার মামলা এগোনো যায়।'
সুজানার ভাষ্যে, 'সম্পদ উদ্ধার সংক্রান্ত সমস্যাগুলোর একটি হলো—এতে প্রায়শই সমঝোতা করতে হয়। মূলত, সেই ধনকুবের বা যিনি টাকা চুরি করে দেশে থেকে বাইরে পাঠিয়েছেন, তার সঙ্গে চুক্তি করা লাগে। তখন ভারসাম্য বজায় রাখা লাগে—একদিকে টাকা ফেরত আনা, অন্যদিকে বাংলাদেশিদের কাছে যা গ্রহণযোগ্য তা নিশ্চিত করা।'
ইফতি ইসলাম বলেন, 'ফৌজদারি মামলায় প্রমাণের মানদণ্ড অনেক উঁচু। তাই এই ভারসাম্য ঠিক রাখা বড় চ্যালেঞ্জ।'
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, 'মানুষ বলে, সব টাকা ফেরত আনা সম্ভব নয়। আমরা যেটুকু করতে পারি, সেটুকুই করব। তবে তার জন্য কঠিন প্রমাণ সংগ্রহ করতে হবে, পথ অনুসরণ করতে হবে, এবং সংশ্লিষ্ট বিদেশি সরকারের সহযোগিতা পেতে হবে।'

সুজানা স্যাভিজ বলেন, 'যদি ইউনূস প্রশাসন অন্যান্য দেশের সরকারগুলোকে—যেমন যুক্তরাজ্যে এনসিএ যা করেছে—তেমন পদক্ষেপ নিতে রাজি করাতে পারে, তাহলে চাকা ঘুরতে শুরু করবে এবং থামানো কঠিন হবে। তবে বড় প্রশ্ন হলো, যারা শেখ হাসিনার আমলে অর্থ বিদেশে নিয়ে গেছে, তারা ভবিষ্যতের সরকারের ওপর কতটা প্রভাব বিস্তার করবে। তার ওপরেই নির্ভর করবে দেশের দুর্নীতি কতটা ব্যাপক হবে।'
জন রিডের মতে, 'বাংলাদেশের 'বিপ্লব' একটি টার্নিং পয়েন্ট বলে মনে হলেও, এমনও হতে পারে যে দেশ আবার এমন এক অবস্থায় ফিরে যাবে, যেখানে একদল রাজনৈতিক শক্তির হাতে অতিরিক্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকবে। তফাত শুধু, এবার তা আওয়ামী লীগ নয়, বিএনপি হতে পারে।'
মোশতাক খান বলেন, 'রাস্তায় নেমে আসা মানুষের আকাঙ্ক্ষা অনেক বেশি ছিল। সেই জায়গায় পৌঁছাতে সময় লাগবে। কিন্তু মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার এখন আলোচনার কেন্দ্রে, এবং আমি মনে করি যে কেউ ক্ষমতায় আসুক না কেন, এটিকে পেছনে ঠেলে দেওয়া খুব কঠিন হবে।'
আন্দোলনকারী রিজওয়ান আহমদ রিফাত তাদের সবচেয়ে বড় ভয় প্রকাশ করে বলেন, 'আমাদের ভয় হলো, আমরা হয়তো আমাদের শহীদদের কাছে করা প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারব না। এটাই এখন সবচেয়ে বড় ভয়।'
তথ্যচিত্র থেকে রূপান্তর: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন