পদ্মা ব্যাংকে আটকে থাকা ১৯.২৮ কোটি টাকা উদ্ধারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহায়তা চায় ন্যাশনাল টি কোম্পানি

অর্থসংকটে থাকা ন্যাশনাল টি কোম্পানি (এনটিসি)—পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত একটি আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠান—ঋণ পরিশোধ ও ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য প্লেসমেন্ট শেয়ার ইস্যু করে মূলধন সংগ্রহ করছে।
তবে কোম্পানিটির শেয়ার কিনতে বিনিয়োগকারীদের দেওয়া ১৯ কোটি ২৮ লাখ টাকা ফেরত দিচ্ছে না ২০১৯ সালে কার্যক্রম শুরু করা বেসরকারি খাতের পদ্মা ব্যাংক পিএলসি (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক)।
শেয়ার সাবস্ক্রিপশনের টাকা ন্যাশনাল টি কোম্পানিকে ফেরত দিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে ইতোমধ্যেই চিঠি দিয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। এর আগে কোম্পানিটি দফায় দফায় আলোচনা ও আশ্বাসের পরও টাকা না পাওয়ায় বিএসইসির সহযোগিতা চেয়ে চিঠি দিয়েছিল।
কোম্পানির ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে বিএসইসি বাংলাদেশ ব্যাংককে জানায়, 'বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অবগতির জন্য উপস্থাপন করা হলো এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানানো হলো।'
পদ্মা ব্যাংকের সিইও কাজী মো. তালহা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ব্যাংকে বর্তমানে কিছু সমস্যা চলছে। শেয়ার সাবস্ক্রিপশনের কিছু টাকা দেওয়া হয়েছে, বাকিটা ধাপে ধাপে দেওয়ার কথা বলেছিলাম, কিন্তু দিতে পারিনি। তারপরও যথাসাধ্য চেষ্টা করছি।"
তিনি আরও বলেন, "ব্যাংকের তারল্য সংকট রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কোনো সহায়তা না পাওয়ায় সমস্যা কাটছে না।"
শেয়ার সাবস্ক্রিপশনের টাকা কোথায় খরচ হলো—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, "ব্যাংকের বিভিন্ন শাখার মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ করা হয়েছে। যেহেতু টাকার সংকট রয়েছে, তাই শাখাগুলো সেই টাকা খরচ করেছে।"
কোম্পানি সূত্রে জানা যায়, মূলধন সংগ্রহে প্রথম ধাপের সাবস্ক্রিপশন শেষ হয় গত বছরের সেপ্টেম্বরে। এরপর বিনিয়োগকারীরা টাকা জমা দেওয়ার পর ন্যাশনাল টি কোম্পানি নতুন শেয়ার ইস্যু করে।
তবে নতুন শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে পরিশোধিত মূলধন ও শেয়ারের সংখ্যা বেড়ে গেলেও শেয়ার ইস্যুকারী ন্যাশনাল টি কোম্পানি এখনও সাবস্ক্রিপশনের টাকা পাচ্ছে না।
শেয়ার ইস্যু
ন্যাশনাল টি কোম্পানির শেয়ার সাবক্রিপশন শুরু হলে বিনিয়োগকারীরা পদ্মা ব্যাংকে জমা দেন ৪৪ কোটি ২৮ লাখ টাকা। পরবর্তীতে ব্যাংকটি পে-অর্ডারের মাধ্যমে ২৫ কোটি টাকা পরিশোধ করলেও অবশিষ্ট ১৯ কোটি ২৮ লাখ টাকা ফেরত দেয়নি।
ঋণ পরিশোধ ও ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল যোগানে বিদ্যমান শেয়ারহোল্ডারদের কাছে শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে ২৭৯ কোটি টাকা মূলধন সংগ্রহ করছে ন্যাশনাল টি কোম্পানি। এ মূলধনের একটি অংশ ঋণ পরিশোধে এবং অবশিষ্টাংশ ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল হিসেবে ব্যবহার করা হবে। চা বাগান পরিচালনাকারী এ কোম্পানির ৫১ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা সরকারের এবং বাকিটা প্রাতিষ্ঠানিক ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে।
বিএসইসির সহায়তা চাইল এনটিসি
পদ্মা ব্যাংকে জমা থাকা অবশিষ্ট ১৯ কোটি ২৮ লাখ টাকা ফেরত পেতে গত ২০ আগস্ট বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কাছে সহযোগিতা চেয়ে চিঠি দেয় ন্যাশনাল টি কোম্পানি।
ওই চিঠিতে বলা হয়, প্লেসমেন্ট শেয়ার সাবক্রিপশন বাবদ প্রথম পর্যায়ে গুলশান কর্পোরেট শাখায় ৪৪ কোটি ২৮ লাখ টাকা (কমিশন চার্জ বাদে) জমা পড়ে। পরবর্তীতে বোর্ড সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী টাকাটি পূবালী ব্যাংকে স্থানান্তরের নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু পদ্মা ব্যাংক কেবল ২৫ কোটি টাকা ফেরত দেয়, বাকি টাকা ফেরত দিতে গড়িমসি করছে।
সংকটে পদ্মা ব্যাংক
পদ্মা ব্যাংকের কয়েকজন কর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্যাংকটি এখন মারাত্মক তারল্য সংকটে ভুগছে। নতুন কোনো আমানত আসছে না; বরং পুরোনো গ্রাহকদের আমানত ফেরত দিতেও ব্যর্থ হচ্ছে ব্যাংক।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মী জানান, "এখন ব্যাংকের সব নজর ঋণ উদ্ধারের দিকে। কোনো ঋণগ্রহীতা টাকা দিলে সেটিই গ্রাহক ও শাখা পর্যায়ের খরচে ব্যবহার করা হয়। কখনও কখনও জরুরি প্রয়োজনে গ্রাহকদের দুই-তিন হাজার বা পাঁচ হাজার টাকা দেওয়া হয়।"
তিনি আরও বলেন, "নানান অনিয়মের কারণে ব্যাংকটি এমনিতেই সংকটে ছিল। তবে এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে মার্জারের আলোচনা শুরু হওয়ার পর অবস্থা আরও খারাপ হয়। আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর থেকে নতুন আমানত আসা একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে।"
"মার্জারের সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর গ্রাহকরা হুমড়ি খেয়ে টাকা তুলতে শুরু করেন। কয়েক দিনের মধ্যেই ছোট-বড় আমানতকারীরা কোটি কোটি টাকা তুলে নেন। এতে ব্যাংকটি মারাত্মক বিপদে পড়ে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও কোনো সহায়তা আসেনি। এই পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীদের টাকাও ফেরত দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না," যোগ করেন তিনি।
আর্থিক অবস্থা
পদ্মা ব্যাংকের স্থূল খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ১০৮ কোটি টাকা, যা মোট ঋণ ও অগ্রিমের ৯০.৫৫ শতাংশ। ব্যাংকটির মোট ঋণ বিতরণ ছিল ৫ হাজার ৬৪১ কোটি টাকা। এরমধ্যে এসএমই খাতে ঋণ ২ হাজার ২৬ কোটি টাকা এবং ট্রেড সার্ভিস খাতে ঋণ ১ হাজার ৮৫৯ কোটি টাকা।
২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর সমাপ্ত অর্থবছরের রিস্ক-বেইজড ক্যাপিটাল অ্যানুয়াল ডিসক্লোজার প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
একই সময়ে ব্যাংকের সমন্বিত ভিত্তিতে অর্জিত লোকসান দাঁড়ায় ৫ হাজার ৩৪৯ কোটি টাকা।
পদ্মা ব্যাংকে ৪০টির বেশি সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানত ২,০০০ কোটি টাকা
পদ্মা ব্যাংকে প্রায় ৪৩টি সরকারি প্রতিষ্ঠানের মোট আমানত রয়েছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট একাই রেখেছে ৮৯৯ কোটি টাকা।
এছাড়া ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি), সাধারণ বীমা করপোরেশন, জীবন বীমা করপোরেশন, তিতাস গ্যাস এবং বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেরও আমানত রয়েছে।
সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানত ফেরতের বিষয়ে সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারকের সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় পদ্মা ব্যাংককে একটি বিস্তারিত পূর্ণাঙ্গ রোডম্যাপ দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।