শিশু বিকাশ কেন্দ্রে চিকিৎসক কমানোর পরিকল্পনা, ব্যাহত হতে পারে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের চিকিৎসা

জন্মের ১৫ দিন পর থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিকাশ কেন্দ্রে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত ১ বছর ৬ মাসি বয়সী শিশু উসাইদ আব্দুল্লাহর। ১০ টাকা টিকিটে নিয়মিত ছেলেকে শিশু বিকাশ কেন্দ্রে দেখিয়ে সন্তুষ্ট উসাইদের বাবা হাফেজ ওমর ফারুখ।
তবে উসাইদের মতো বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের চিকিৎসা ঝুঁকিতে পরতে যাচ্ছে, কারণ ৩৫টি শিশু বিকাশ কেন্দ্রের চিকিৎসক ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসাসেবার লক্ষ্য নিয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৮ সালে শিশু বিকাশ কেন্দ্র প্রকল্প চালু হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর (এইচপিএনএসপি) কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত 'হসপিটাল সার্ভিস ম্যানেজমেন্ট (এইচএসএম)' শীর্ষক কার্যক্রম পরিকল্পনার আওতায় ২৪টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ১১টি জেলা সদর হাসপাতালে শিশু বিকাশ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে।
এসব শিশু বিকাশ কেন্দ্রে ০-১৬ বছর বয়সী অটিজম, ডাউন সিনড্রোম, নিউরোডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার, সেরিব্রাল পালসি, এডিএইচডি, খিঁচুনি এবং মৃগীরোগ, বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ও শেখার অক্ষমতা, দেরিতে কথা বলা এবং বাক সমস্যায় আক্রান্ত শিশুদের সেবা দেওয়া হয়।

প্রতিটি কেন্দ্রে একজন শিশু বিশেষজ্ঞ, ডেভেলপমেন্টাল থেরাপিস্ট এবং শিশু মনোবিজ্ঞানী নিয়োজিত থাকেন, যারা প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত কাজ করেন। প্রতিদিন ১ হাজারের বেশি শিশু চিকিৎসা গ্রহণ করে এবং ২০০৮ সালের আগস্ট থেকে গত জুলাই পর্যন্ত মোট ২ লাখ ৪৩ হাজার ৯৩৪ জন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুকে চিকিৎসা করা হয়েছে। ২০০৮-২০০৯ সালে রোগীর সংখ্যা ছিলো ৯৯১০ জন, ২০২২-২০২৩ সালে সংখ্যাটি ছিলো ৫৬ হাজার ১৭২ জন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, গত বছরের জুনে ৪র্থ সেক্টর কর্মসূচি শেষ হওয়ার পর থেকে শিশু বিকাশ কেন্দ্রগুলোর চিকিৎসক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বেতন পাচ্ছেন না। তার পরও কেন্দ্রের কর্মীরা বেতন ছাড়াই চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
সম্প্রতি জরুরি স্বাস্থ্যসেবা সচল রাখতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় 'স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর ও কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট সংস্থাসহের অত্যাবশ্যকীয় কার্যক্রম বাস্তবায়ন' শীর্ষক প্রকল্প নিয়েছে।
তবে অর্থ মন্ত্রণালয় কেন্দ্রগুলোর শিশু বিকাশ বিশেষজ্ঞ পদ বাদ দিয়ে প্রকল্প প্রস্তাবনা পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে। সেখানে ৩৫ জন থেরাপিস্ট ও আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে ১২ জন শিশু মনোবিজ্ঞানী রাখা রয়েছে।
হাসপাতালের অন্যান্য শিশু চিকিৎসকদের দিয়ে শিশু বিকাশ কেন্দ্র পরিচালনার কথা ভাবছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশু বিকাশ কেন্দ্র প্রশিক্ষিত চিকিৎসক ছাড়া পরিচালনা করা মানে রোগীদের অন্ধকারে ফেলে দেওয়া।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক এবং শিশু আউটডোর সার্ভিসের প্রধান ডা. সাইদুর রহমান সোহাগ বলেন, 'শিশু বিকাশ কেন্দ্রের চিকিৎসকদের ছাঁটাই করলে অনেক সমস্যা হবে। কারণ তারা স্পেশালাইজড (বিশেষজ্ঞ) ওই বিষয়ে।'
তিনি বলেন, 'ডেভেলপমেন্টাল পেডিয়াট্রিশিয়ানরা বিশেষ বাচ্চাদের বিকাশ বা অন্যান্য ডেভেলপমেন্ট দেখে। এতে একেকজন রোগী দেখতে অনেক সময় লাগে। রোগী দেখার জন্য তারা ১৩–১৪ বছর ধরে প্রশিক্ষিত, সেই কাজ তো অন্যরা করতে পারবে না।'
তিনি আরও বলেন, 'আমি দিনে ৫০ জনের বেশি রোগী দেখি। আমি কীভাবে বিশেষ বাচ্চাদের অতো সময় নিয়ে দেখবো? আমাদের আউটডোরে প্রতিদিন ৬০০–৭০০ রোগী সেবা নেয়। সেখানে একজন বিশেষ শিশুকে আধা ঘণ্টা দেয়ার সুযোগ নেই।'
ডা. সাইদুর বলেন, 'জেনারেল পেডিয়াট্রিশিয়ানরা ডেভেলপমেন্টাল বিষয়টা ওই পরিমাণ সময় নিয়ে দিতে পারবে না। এই রোগীদের জন্য কাউন্সেলিং, থেরাপি—অনেক কিছু দরকার। অন্যরা দিতে পারবে না। আপনি বটগাছ লাগিয়ে আম চাইলে হবে না।''
তিনি বলেন, 'ঢাকা মেডিকেলে রোগীরা ১০ টাকায় যে সেবা পায়, সেই রকই মানের সেবা কর্পোরেট সেন্টারে ৫–৬ হাজার টাকায় দিতে হয়। এখন সরকার যদি সেখানে চিকিৎসক ছাঁটাই করে, তাহলে গরিব মানুষ যাবে কোথায়? এটা খুবই দুঃখজনক।'
হাফেজ ওমর ফারুখ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমি কয়েকবার প্রাইভেট চেম্বারেও আমার বাচ্চাকে দেখিয়েছি। সেখানে ডাক্তাররা শিশু বিকাশ কেন্দ্রের মতো সময় দেয় না। কেন্দ্রের তত্ত্বাবধানে আমার বাচ্চার উন্নতি হচ্ছে। যদি ডাক্তার না থাকে, সমস্যায় পড়ব।'
ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু বিকাশ কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা ডা. তোশিবা রহমান বলেন, 'বিশেষ শিশুদের জন্য স্পেশালিস্ট ডাক্তার দরকার। ডাক্তার ছাড়া শুধু মনোবিজ্ঞানী বা থেরাপিস্ট দিয়ে চিকিৎসা সম্ভব নয়। সঠিক রোগ নির্ণয় জরুরি। প্রতিটি শিশুর পর্যবেক্ষণে ৩০–৪৫ মিনিট লাগে, তাই দিনে ২০ জনের বেশি দেখা যায় না। গুণগত মান বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তাড়াহুড়া করলে ভুল হয়।'
তিনি আরও বলেন, 'গত ১৪ মাস ধরে স্যালারি পাইনি, তবুও কাজ করছি। রোগীরা ১৫–১৬ বছর ধরে আমাদের সঙ্গে আছে। ১০ টাকায় সেবা পাচ্ছে। ২০০৯ সাল থেকে রোগীদের কাছে আমাদের ফোন নম্বর আছে। ডাক্তার ছাড়া সঠিক রোগ নির্ণয় সম্ভব নয়।'
প্রধান উপদেষ্টার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান বলেন, 'আমরা সব ক্রিটিক্যালি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় জনবল ও সম্পদ বজায় রাখার জন্য ব্রিজিং ডিপিপি প্রস্তাব করছি। এটি জুন ২০২৬ পর্যন্ত চলবে, শুধু ক্রিটিক্যাল স্টাফ থাকবে।'