যে কারণে ডাকসু কার্যকর থাকা অপরিহার্য

দীর্ঘ ছয় বছর পর জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর আবার অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন। প্রতি বছর হওয়ার কথা থাকলেও স্বাধীনতার পর এ নির্বাচন মাত্র সাতবার হয়েছে। শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ, প্রত্যাশা ও জাতীয় রাজনীতির প্রতিফলন মিলিয়ে ডাকসু সবসময় জাতীয়ভাবে গুরুত্ব পেয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন থেকে সর্বশেষ জুলাই অভ্যুত্থান পর্যন্ত প্রতিটি আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিলেন। এসব আন্দোলনের নেতৃত্ব ও পরিকল্পনার বড় অংশ এসেছে ডাকসু থেকে। ফলে কাগজে-কলমে এটি ছাত্রসংসদ হলেও জাতীয় রাজনীতিতে এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এজন্য ডাকসুকে অনেকে দেশের 'দ্বিতীয় সংসদ' বলে অভিহিত করেন।
১৯৯০ সালের ডাকসু নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক (জিএস) নির্বাচিত খায়রুল কবির খোকন, বর্তমানে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ—সব জায়গাতেই ডাকসুর অবদান রয়েছে। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও ডাকসু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। শিক্ষার্থীদের অধিকার যেমন রক্ষা করেছে, তেমনি দেশের মানুষের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদেও সামনে থেকেছে।'
তিনি আরও বলেন, 'নব্বইয়ের প্রেক্ষাপটে ডাকসুর মূল ফোকাস ছিল জাতীয় রাজনীতি। তবে সংস্কারের অংশ হিসেবে ক্যাম্পাসে একাডেমিক ভবনে মিছিল-স্লোগান বন্ধ করে তা রাস্তায় নেওয়া হয়, পোস্টারিং-লিফলেট সীমিত করা হয় এবং সহাবস্থান বজায় রাখতে পরিবেশ পরিষদ গঠন করা হয়েছিল।'
নিয়মিত নির্বাচন না হওয়ার পরিণতি
ডাকসু নির্বাচন চালু হওয়ার পর ব্রিটিশ আমলে ২৩ বছরে হয়েছে ১৪ বার, পাকিস্তান আমলে ২২ বছরে ১৬ বার। স্বাধীনতার পর এ নির্বাচন ক্রমেই অনিয়মিত হয়ে পড়ে এবং নব্বইয়ের পর মাত্র একবার (২০১৯) অনুষ্ঠিত হয়।
বিশ্লেষকদের মতে, নব্বইয়ের পর বিএনপি ও আওয়ামী লীগ উভয় সরকারই ক্যাম্পাসে আধিপত্য বজায় রাখতে ডাকসু নির্বাচনকে 'বাক্সবন্দি' করে রাখে। এর পরিবর্তে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের মাধ্যমে ক্যাম্পাস নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বজায় রাখার সংস্কৃতি চালু হয়। গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠন দ্বারা এ নির্যাতনের মাত্রা নতুন রূপ নেয়। হলে হলে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের দ্বারা গণরুম-গেস্টরুম নির্যাতন, সিট–বাণিজ্য, দখলদারিত্ব ও ভিন্নমত দমন ছিল নিয়মিত ঘটনা।
শিক্ষার্থীদের মতে, ডাকসু যদি নিয়মিত সক্রিয় থাকে, তাহলে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের স্বৈরাচারী হয়ে ওঠা কঠিন হবে। গণতান্ত্রিক আচরণ না করলে শিক্ষার্থীরা পরবর্তী নির্বাচনে তাদের ভোট দেবে না। একইভাবে, যে ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে, তার পক্ষেও অগণতান্ত্রিক আচরণ দীর্ঘমেয়াদে টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। এতে ক্যাম্পাসে আধিপত্যের বদলে গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি হবে এবং অন্যায়ের সুযোগ সীমিত হবে।
২০১৯ সালের ডাকসুর প্রভাব
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এ এফ রহমান হলের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ফয়সাল ইসলাম মানিক বলেন, '২০১৯ সালে ডাকসুর তফসিল ঘোষণার পর পুরো মেয়াদে গেস্টরুম নির্যাতন ও ছাত্রলীগের দমন-পীড়নের মাত্রা চোখে পড়ার মতো কমে যায়। তখন ডাকসু নেতাদের সঙ্গে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের মধ্যে পাওয়ার-ব্যালেন্স তৈরি হয়েছিল।'
তার মতে, ওই মেয়াদে শিক্ষার্থীদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রতিযোগিতা তৈরি হয়। হলে নতুন রিডিং রুম, সাইকেল স্ট্যান্ড নির্মিত হয়, কক্ষগুলো রঙ করা হয়। তবে ডাকসুর মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আবার আগের মতো ছাত্রলীগের আধিপত্য ও নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়।'
২০১৯ সালের নির্বাচনে কবি সুফিয়া কামাল হলে স্বতন্ত্র প্যানেল থেকে জিএস নির্বাচিত মনিরা শারমিন। বর্তমানে তিনি এনসিপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তিনি বলেন, 'আমরা প্রশাসনকে চাপ দিয়ে শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবি আদায় করেছিলাম। রাজনৈতিকভাবে মেয়েদের হলে অবস্থান বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলাম। মেয়েদের হলগুলোতে মাস্টার্সে 'সিঙ্গেল বেড' পাওয়া কঠিন ছিল। একজন মাস্টার্সের শিক্ষার্থী সিঙ্গেল সিট পাওয়ার যোগ্য এবং সেটা আমরা ২০১৯ সালে চালু করতে পেরেছিলাম।'
ডাকসুর উদ্দেশ্য ও কার্যক্রম
গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ডাকসুর প্রধান লক্ষ্য স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের মুল্যবোধকে ধারণ ও লালন, শিক্ষার্থীদের একাডেমিক ও সহশিক্ষা কার্যক্রমে সহায়তা করা। এছাড়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে নেতৃত্ব তৈরি, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং দেশি-বিদেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করাও এর কাজ।
ডাকসুর নিয়মিত কার্যাবলির মধ্যে রয়েছে শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষা, সাধারণ কক্ষ রক্ষণাবেক্ষণ, সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা আয়োজন, সাময়িকী প্রকাশ, আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় সম্মেলনে অংশগ্রহণ ও সমাজসেবা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. খোরশেদ আলম বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়ে সিদ্ধান্ত ও নীতিনির্ধারণ অনেকটাই শিক্ষকদের হাতে থাকে। অথচ শিক্ষার্থীরাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন। ডাকসু ও হল সংসদ শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার মাধ্যমে তাদের অন্তর্ভুক্তি ঘটায়।'
তিনি আরও বলেন, 'শিক্ষার্থীদের অন্তর্ভুক্তি ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ গড়ে তুলতে ডাকসু অপরিহার্য।'