সাদাপাথর লুট: কিছু পাথর ফিরলেও অধরাই রয়েছে প্রভাবশালী অভিযুক্তরা

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার পর্যটনকেন্দ্র সাদাপাথরে নজিরবিহীন লুটপাটের ঘটনায় গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর—দেশজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া হলে নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। লুট হওয়া পাথর উদ্ধার ও তা সাদাপাথরে পুনঃস্থাপনের উদ্যোগ নেয় প্রশাসন। লুটের ঘটনা তদন্তে গঠিত হয় একাধিক কমিটি। আর এরই জেরে বদলি করা হয় সিলেটের জেলা প্রশাসক, কোম্পানীগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে।
তবে লুটপাটের সাথে জড়িতরা এখন পর্যন্ত অধরাই থেকে যাচ্ছেন। লুটের ঘটনায় গত ১৫ আগস্ট অজ্ঞতনামা ২ হাজার জনকে আসামি করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি মামলা করা হয়। মামলা দায়েরের ১৮ দিন পেরিয়ে গেলেও— এপর্যন্ত মাত্র ১৪ জনকে গেপ্তার করা হয়েছে। তবে লুটের সাথে জড়িত হিসেবে যেসব প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নাম উঠে এসেছে, তাদের কাউকে এখনও পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়নি। গ্রেপ্তার অভিযানও অনেকটা স্থিমিত হয়ে এসেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। যদিও পুলিশ বলছে, প্রতিদিনই অভিযান চলছে।
এই মামলার বাইরেও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তে সাদাপাথর লুটে সিলেটের কয়েকজন শীর্ষ রাজনীতিকসহ ৪২ জনের নাম উঠে আসে। এছাড়া জেলা প্রশাসনের তদন্তে ১৩৭ জনের সম্পৃক্ততাও পাওয়া যায়। তবে এখন পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
এছাড়া সিলেটের প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদেরও সাদাপাথর লুটের সাথে সম্পক্ততার প্রমাণ পায় দুদক। তবে তিনজনকে বদলি করা ছাড়া প্রশাসনের কারো বিরুদ্ধেও এপর্যন্ত কোনো আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
এব্যাপারে কোম্পানীগঞ্জ থানার সদ্য বদলির আদেশ হওয়া ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) উজায়ের আল মাহমুদ আদনান আজ মঙ্গলবার টিবিএসকে বলেন, "সাদাপাথর লুটের সাথে জড়িতদের গ্রেপ্তারে প্রতিদিনই অভিযান চলছে। যৌথবাহিনীর সহায়তায় অভিযান চলছে। মামলায় যেহেতু কারো নাম নেই— তাই যাচাই-বাছাই করে অভিযান চালাতে হচ্ছে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে তাদের অবস্থান তথ্য প্রযুক্তির সহায়তা নিয়েও আমরা শনাক্তের চেষ্টা করছি। তবে এখন পর্যন্ত তাদের খোঁজে পাইনি।"

সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. সারওয়ার আলমের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। তবে সম্প্রতি সাদাপাথর পরিদর্শনে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, লুটের ঘটনায় আইনি কার্যক্রম অব্যাহত আছে। তবে যাতে কোনো নিরীহ লোক হয়রানির শিকার না হন— সে ব্যাপারেও আমরা লক্ষ রাখছি। তাই সতর্কতার সাথে অভিযান চলছে।
কতদূর এগোলো প্রতিস্থাপন কাজ?
সাদাপাথর লুট নিয়ে দেশজুড়ে সমালোচনার পর লুট হওয়া পাথর উদ্ধার ও তা পুনঃস্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। পাথর ফিরিয়ে দিতে তিনদিনের আলিটমেটাম দেন সিলেটের জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব পাওয়া মো. সারওয়ার আলম।
প্রশাসনের এই তোড়জোড়ে সাদাপাথরের সৌন্দর্য কিছুটা ফিরতেও শুরু করেছে। লুটপাটে একেবারে মরুভূমিতে পরিণত হওয়া সাদাপাথরে এখন পাথরেরও দেখা মিলছে।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রবিন মিয়া আজ দুপুরে জানিয়েছেন, "এপর্যন্ত প্রায় সাড়ে ১৬ লাখ ঘনফুট সাদাপাথর প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। আর এপর্যন্ত উদ্ধার হয়েছে প্রায় সাড়ে ২৮ লাখ ঘনফুট।"
তিনি জানান, উদ্ধার হওয়া বাকী পাথরও পুনঃস্থাপনের কাজ চলছে। প্রতিদিন ৫০০ শ্রমিক, ৪০০ নৌকা ও ৩০০ ট্রাক ব্যবহার করে চলছে পাথর প্রতিস্থাপনের কাজ।
লুটের সাথে জড়িতদের গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ। তারাই এ ব্যাপারে ভালো বলতে পারবে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর সাদাপাথরে নজিরবিহীন লুটপাট হয়। তবে এক বছরে কী পরিমাণ লুটপাট হয়েছে—তার কোনো তথ্য নেই প্রশাসনের কাছে। জেলা প্রশাসক মো. সারওয়ার আলমের দাবি, লুট হওয়া ৩০ শতাংশ পাথর উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। যদিও স্থানীয়দের মতে, এক বছরে ২ থেকে ৩ কোটি ঘনফুট পাখর লুট হয়েছে।
এদিকে লুটেরাদের শাস্তি নিশ্চিত করা না গেলে ফের এমন ঘটনা ঘটবে বলে মন্তব্য করেছেন পরিবেশবাদী সংগঠন 'ভূমিসন্তান বাংলাদেশ'-এর সমন্বয়ক আশরাফুল কবির। তিনি বলেন, "সিলেটে পাথর লুট নতুন কোনো ঘটনা নয়। যুগ যুগ ধরে এটি চলে আসছে। সবসময়ই দেখা যায় পাথর লুট নিয়ে মিডিয়ায় আলোচনা শুরু হলে—প্রশাসনে কিছুটা তোড়জোড় শুরু হয়। এরপর কিছুদিন পর তা স্থিমিত হয়ে যায়। তখন আবার লুটপাট শুরু হয়। তাই লুট বন্ধ করতে হলে, লুটপাটকারীদের আইনের আওতায় আনতে হবে। অন্তত শীর্ষ কয়েকজনের শাস্তি নিশ্চিত করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে।"

দুই তদন্ত কমিটি, প্রতিবেদন অপ্রকাশিত
সাদাপাথর লুট নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে গত ১২ আগস্ট তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেন সিলেটের তৎকালীন জেলা প্রশাসক শেখ মাহবুব মুরাদ। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (উন্নয়ন ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা) পদ্মাসেন সিংহকে প্রধান করে গঠিত এই কমিটির দুই সদস্য ছিলেন কোম্পানীগঞ্জের বিদায়ী ইউএনও আজিজুন্নাহার ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আফজালুল ইসলাম।
একমিটি গঠনের পর থেকেই শুরু হয় সমালোচনা। বিশেষত কমিটিতে কোম্পানীগঞ্জের ইউএনও আজিজুন্নাহারকে রাখা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেছে। সাদাপাথর লুটপাট ঠেকাতে ব্যর্থতা ও লুটপাটকারীদের ব্যাপারে উদাসীনতার অভিযোগ রয়েছে এই ইউএনওর বিরুদ্ধে।
২০ আগস্ট এই কমিটি তাদের প্রতিবেদন প্রদান করে। প্রতিবেদনে লুটপাটের জন্য অভিযুক্ত করে ১৩৭ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া লুটপাট বন্ধে ১০টি সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
তবে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়নি। এব্যাপারে জেলা প্রশাসক মো. সারওয়ার আলম বলেন, "তদন্ত প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তারাই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন।"
এ ঘটনায় গত ২০ আগস্ট মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। কমিটির আহ্বায়ক করা হয় মন্ত্রিপরিষদ সচিব (সমন্বয় ও সংস্কার) জাহেদা পারভীনকে। গত সপ্তাহে এ কমিটি সাদাপাথর পরিদর্শন ও সিলেট নগরে গণশুনানি করে। তবে এখনো পর্যন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়নি কমিটি।
এছাড়া, সাদাপাথর লুটের ঘটনায় তদন্ত শুরু করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তারা লুটে সম্পৃক্ততায় ৫০ জনের নামে অভিযোগ পেয়েছে বলে জানিয়েছে।
ডিসি-ইউএনও-ওসি বদলি
সাদাপাথর লুটকান্ডে সিলেটের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) আজিজুন্নাহারের পর—গত রোববার এক অফিস আদেশে কোম্পানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) উজায়ের আল মাহমুদকেও বদলি করা হয়। তবে ওসি এখনও কোম্পানীগঞ্জ থানায় রয়েছেন।
এর আগে ১৮ আগস্ট সিলেটের ডিসি মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদকে ওএসডি করা হয় এবং একইদিনে কোম্পানীগঞ্জের ইউএনও আজিজুন্নাহারকে বদলি করা হয়। এ ছাড়া ২৫ আগস্ট সিলেটে পুলিশের ২২ সদস্যকে বদলি করা হয়। তাদের মধ্যে পাথর লুটকাণ্ডে আলোচিত কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট থানায় কর্মরত ১১ জন উপপরিদর্শক (এসআই) ও সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) রয়েছেন।
প্রশাসনের একটি সূত্র জানিয়েছে, কোম্পানীগঞ্জের সাদাপাথর, সংরক্ষিত বাংকার এলাকা, ভোলাগঞ্জ কোয়ারি ও শাহ আরেফিন টিলা এলাকায় পাথর লুট 'ঠেকাতে না পারায়' ডিসি, ইউএনও ও ওসি সমালোচিত হন। সাদাপাথর থেকে সম্প্রতি অন্তত ৮০ শতাংশ পাথর লুট হওয়ায় তারা ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন। এমন পরিস্থিতিতে তাদের বদলি করা হয়। তবে বদলির কারণ হিসেবে এসব উল্লেখ করা হয়নি।
দুদকের তদন্ত প্রতিবেদনে তোলপাড়
গত ১৩ আগস্ট ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর পরিদর্শনে যান দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সিলেট সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক রাফী মো. নাজমুস সাদাৎ-এর নেতৃত্বে গঠিত ৫ সদস্যের একটি দল। তারপর ধারাবাহিক অনুসন্ধান শেষে ১৬ আগস্ট প্রাথমিক প্রতিবেদন দুদক সদরদপ্তরে জমা দেয় জেলা কার্যালয়।
প্রতিবেদনে পাথর লুটে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা মিলিয়ে ৫৩ জনের সম্পৃক্ততা পেয়েছে বলে জানায় দুদক। প্রতিবেদনে পাথর লুটে মহানগর বিএনপির সভাপতি সাধারণ সম্পাদক, মহানগর জামায়াতের আমির ও জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি, এনসিপির জেলা ও মহানগর সমন্বয়কসহ ৪২ রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী সম্পৃক্ত বলে উল্লেখ করা হয়। এতে কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়া আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতারও নাম রয়েছে।
এ ছাড়া বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিজিবিসহ সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে পাথর লুটের জন্য অভিযুক্ত করা হয়।
এই প্রতিবেদন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর সিলেটে শুরু হয় তোলপাড়। সংবাদ সম্মেলন করে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি নেতারা লুটকাণ্ডে সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে এই প্রতিবেদন নিয়েই প্রশ্ন তোলেন। এ ছাড়া এই প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে জামায়াত সিলেটে বিক্ষোভ মিছিল ও এনসিপি স্মারকলিপি প্রদান করেছে। প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যেও দুদকের প্রতিবেদন নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে।
সোমবার সিলেট সফরে এসে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, সাদাপাথর লুট নিয়ে দুদকের প্রতিবেদন সরকার গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখছে। প্রতিবেদনটি সত্য প্রমাণিত হলে, জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে যদি তা অসত্য হয়, তবে দুদকের সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।