‘মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি’, ‘ছাত্র শুনলেই হামলা হয়েছে’: আহত চবি শিক্ষার্থীদের বয়ান

'বাসা থেকে বের হয়ে স্থানীয় গ্রামবাসীর কবলে পড়ে গিয়েছিলাম। কিছু বুঝে উঠার আগের গলায় কোপ দিয়েছিল। আমি হাত দিয়ে ঠেকালে ডান হাতের কবজিতে লাগে। হাতের লিগামেন্ট ছিড়ে গেছে। পরে বলা হয়, কাউকে ফোন দিতে। যেন মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে এসেছি।'
রোববার (৩১ আগস্ট) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় সংঘর্ষের ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন আহত শিক্ষার্থী মাহমুদুল হাসান।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ২৩ নম্বর ওয়ার্ডে অস্ত্রোপচারের জন্য অপেক্ষারত ছিলেন ইংরেজি বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের এই ছাত্র। সংঘর্ষের এলাকায় অনেক শিক্ষার্থীরা বাসা ভাড়া করে থাকেন। তাদের উদ্ধার করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন ও প্রক্টর অধ্যাপক ড. তানভীর হায়দার আরিফ হামলার শিকার হন। এ সময় তাদের সঙ্গে থাকা শিক্ষার্থীদেরও দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে হামলা করা হয়।
মাহমুদুল টিবিএসকে বলেন, 'স্থানীয়রা এসে প্রক্টর স্যারকে হামলা করে। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। শ্বাসকষ্টে ভোগেন। এরপর সেখানে আমি আটকা পড়ি। আমাকে গলায় কোপ দিয়েছিল। আমি হাত দিয়ে ঠেকিয়েছি। আমার মাথায় ও অন্য হাতেও আঘাত করা হয়েছে। মেরে ফেলা হবে বলা হয়। শেষ কারও সঙ্গে কথা বলতে বলা হয়। আমি স্থানীয় পরিচিত কয়েকজন ছোট ভাইকে কল দিয়েছিলাম। তাদের অনুরোধে আমাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।'

হামলার শিকার হয়ে চমেক হাসপাতালের ক্যাজুয়ালটি বিভাগে ভর্তি হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে ছাত্র নিশাদ তালুকদার বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই নম্বর গেট এলাকায় ভাড়া বাসায় অনেক শিক্ষার্থী আটকা পড়েন। প্রক্টর স্যারসহ আমরা তাদের উদ্ধার করতে গিয়েছিলাম। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার ওপর হামলা করা হয়।'
পায়ে কোপানোর পর প্রায় এক ঘণ্টা ধানখেতে পড়ে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ স্টাডিজ বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র মোহাম্মদ রোমান রহমান। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন উল্লেখ করেন তিনি বলেন, 'পায়ে কোপানো হয়। বলা হয়, মেরে ফেলবে। তখন আমার সঙ্গে একজন বলেন, তিনি এতিম। তাকে ছেড়ে দিন। আমাদের মোবাইল নিয়ে নেওয়া হয়েছিল। পরে আরেকজন এসে আমাদের ছেড়ে দেন।'

বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই নম্বর গেট এলাকায় ভাড়া বাসায় দেরিতে ঢোকায় দারোয়ান এক ছাত্রীকে চড় মারেন বলে অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে শনিবার গভীর রাত থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয়দের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে আহত হন অর্ধশতাধিক। সকালে ফের সংঘর্ষ শুরু হয়। তখন উপ-উপাচার্য, প্রক্টর, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা আহত হন। দেশীর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা করা হয়। প্রশাসন বলছে, ৪০০ থেকে ৫০০ জন আহত হয়েছেন।
চমেক হাসপাতালে পরিদর্শনে এসে জেলা সিভিল সার্জন সাংবাদিকদের বলেন, 'চমেক হাসপাতালে ৭৭ জন আহত চিকিৎসা নিতে এসেছেন। পার্কভিউ হাসপাতালে ২৪ জন, হাটহাজারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১০ জন আছেন। আমরা চিকিৎসা অব্যাহত রেখেছি। প্রয়োজনে উন্নত চিকিৎসা দেওয়া হবে। ওষুধপত্রের ব্যবস্থাও করা হচ্ছে।'

বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে চমেক হাসপাতালের উপ-উপরিচালক মো. ইলিয়াস চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, 'গত রাতে ৩০ জন এবং আজকে ৭৭ জন ভর্তি হয়েছেন। তারা নিউরো সার্জারি, অর্থোপেডিক্স, ক্যাজুয়ালটি ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন আছেন।'
'ছাত্র শুনলেই হামলা করা হয়'
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র তোফায়েল আহমেদ বলেন, 'এক নম্বর গেট বাসা থেকে সংঘর্ষ দেখতে বের হয়েছিলাম। এরপর বাসায় ফিরছিলাম। তখন ছাত্র বলে কয়েকজন ধরে মারধর করেন। মাথায় ইট দিয়ে মারেন।'
স্পোর্টস সায়েন্স বিভাগের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র রাজন রাজ বলেন, 'ছাত্র বলেই আক্রমণ করা হয়েছে। ভাড়া বাসা খাবারের জন্য নিচে নেমেও অনেকে হামলার শিকার হয়েছেন।'

বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র মোশাররফ হোসেন ফাহাদ টিবিএসকে বলেন, 'গ্রামবাসীদের হামলার ধরন দেখে তাদের মনে হয়েছে, তারা অনেক বেশি প্রস্তুত। দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা করা হয়েছে।'
দুপুরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে হামলার শিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মো. কামাল উদ্দিন অভিযোগ করেন, গ্রামবাসীদের মধ্যে ছাত্রলীগ, যুবলীগের ক্যাডাররা হেলমেট পরে হামলা করেছে। তারা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা করেছে। পুলিশ, সেনাবাহিনী, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে যোগাযোগ করেও সময়মতো কোনো সাড়া পাননি। এ সময় তিনি অসহায়য়ত্ব প্রকাশ করে অঝোরে কাঁদতে থাকেন।