গাজী টায়ারে অগ্নিকাণ্ড: নিখোঁজ ১৮২ জনের সন্ধান মেলেনি এক বছরেও

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের বরপা মীরাবাড়ি এলাকার বাসিন্দা আবু সাঈদ আবু সাঈদ (৬০)। পেশায় ছিলেন একজন গাড়ি চালক। তিন মেয়ে আর স্ত্রী নাসরিন আক্তারকে (৪৫) নিয়ে বেশ সুখের সংসার ছিল তার।
গত বছরের ২৫ আগস্ট রূপসী মোড়ে গাজী টায়ার্সে লুটপাট ও মারামারি শুরু হলে হাজারো মানুষের সঙ্গে তিনিও ভেতরে গিয়েছিলেন। কিন্তু আর ফেরেননি।
এক বছর পর মঙ্গলবার (২৬ আগস্ট) দুপুরে তার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় সেখানে চলছে রান্নার প্রস্তুতি।
জিজ্ঞেস করতেই পরিবারের লোকজন জানান, ''আবু সাঈদের সম্ভাব্য মৃত্যুর ধারণা অনুযায়ী গরীব দুঃখী মানুষের জন্য খাবার রান্না করা হচ্ছে।''
গাড়িচালক আবু সাঈদের স্ত্রী নাসরিন আক্তার বলেন, ''ঘটনার দিন সন্ধ্যায় আমাকে ফোন দিয়ে বলল, 'রূপসী আসছি, বাড়ির জন্য বাইরে থেকে কিছু আনতে হবে?' আমি বললাম কিছু লাগবে না। রাত ৯টায় আমাকে ফোন করে বলল, 'আমি কারখানার ভেতরে আটকা পড়ে গেছি। তোমরা লোকজন নিয়ে এসে আমাকে বাচাও।' সেই যে ফোন রাখলো, রাত ১ টা পর্যন্ত ফোন বাজছে। কিন্তু কেউ ধরে নাই। তিনটা মেয়ে আমি এখন একাই বড় করছি। ভাই-বোনদের সহযোগিতা নিয়ে চলছি।'
গত বছরের ২৫ আগস্ট বিকেলে রূপগঞ্জের রূপসী এলাকায় অবস্থিত গাজী টায়ার্স কারখানায় হামলা চালানো হয়। মাইক দিয়ে ঘোষণা দেওয়া হয়, গাজী টায়ারের ভেতরে দখল করে রাখা জমি বুঝে নেওয়া হবে আজ।
এই ঘোষণার পরপরেই শুরু হয় কারখানার ভেতরে লুটপাট। লুটপাটের এক পর্যায়ে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। বেশ কয়েক রাউন্ড গুলির শব্দও শুনতে পান প্রত্যক্ষদর্শীরা। এরমধ্যে একটি গ্রুপ কারখানার ভেতরে ঢুকে লুটপাট শুরু করলে আরেকটি পক্ষ নিচের সাটার লাগিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। ভেতরে আটকে পড়া লোকজন পুড়ে মারা যান।
প্রায় তিনদিন টানা আগুন জ্বলতে থাকে কারখানার ভেতরে। আগুন নেভার পরে ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় ভেতরে যাওয়ার সুযোগ পায়নি ফায়ার সার্ভিস। বুয়েট থেকে পরিদর্শক দল এসেও ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়।
ভেতরে কোনো মরদেহ আছে কি না তা জানতে ড্রোন পাঠানো হলেও সেখানে মরদেহের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। তবে কারখানার বাইরে অপেক্ষমান স্বজনদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ১৮২জন নিখোঁজের একটি তালিকা প্রস্তুত করা হয়।
একই এলাকার বাসিন্দা আসাদ ভূঁইয়া (৪৫) কাজ করতেন স্থানীয় একটি ওয়ার্কশপে। গত বছরের ২৫ আগস্ট রূপসী মোড়ে গাজী টায়ার্সে লুটপাট ও মারামারি শুরু হলে তার ১০ বছর বয়সী সন্তানও গিয়েছিল সেখানে। খবর পেয়ে ছেলেকে খুঁজতে গাজী টায়ার কারখানায় যান আসাদ। কিন্তু কারখানার ভেতরে প্রবেশের পর আর বের হতে পারেননি।
শুধু ফোন করে স্ত্রীকে বলতে পেরেছিলেন, ''আমারে বাচাও রীতা, আমি আটকায়া গেছি।''
আসাদ ভূঁইয়ার ছেলে রিসাদ ভূঁইয়া বলেন, ''আমার বাবারে আর ফিরে পাইলাম না। উনার জানাজাও পড়তে পারি নাই। লাশ পাইলেও বলতে পারতাম যে এখানে আমার বাবার কবর। এখন পুরো সংসারের দায়িত্ব আমার কাছে। সরকার যদি আমাদের পরিবারগুলোরে একটু সহযোগিতা করতো তাইলে আমরা চলতে পারতাম।''
এই ঘটনায় কারা জড়িত বা অগ্নিসংযোগকারীদের বিষয়ে কোন তথ্য দিতে পারেনি নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার প্রত্যুষ কুমার মজুমদার।
তিনি বলেন, ''ঘটনার তদন্তে পুলিশ কাজ করছে। উদ্ধার করা হাড়গুলো ফরেনসিক পরীক্ষায় পাঠানো হলেও কারো স্বজনের সঙ্গে তা ম্যাচ করেনি। আমাদের তদন্তের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। আশা করছি আগামী মাসে রিপোর্ট দিতে পারব।''
নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক জাহিদুল ইসলাম বলেন, ''আমাদের কাছে বেশ কয়েকজন নিখোঁজ স্বজন এসেছিলেন। আমরা তাদের সন্ধানের বিষয়ে পুলিশকে অবগত করেছি। তবে তারা আমাদের কিছু জানায়নি। এই বিষয়ে পুলিশ তদন্ত করছে বলে জানি।''
ঘটনার পর নিখোঁজ স্বজনরা কয়েকদফা জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন। কিন্তু তাদের স্বজনদের সন্ধান দিতে পারেনি কেউ। অনেকেই এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন অন্যত্র। কারখানা আদৌও খুলবে কি না তা বলতে পারছে না কেউ।
কারখানার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা গাজী গ্রুপের কর্মচারীরা বলেন, ''লালবাগে আমাদের প্রধান অফিস থেকে আমাদের নিরাপত্তার কাজে রেখেছে। কারখানা আদৌও খুলবে কি না তা কেউ বলতে পারছে না।''