দৈনন্দিন জীবনের হয়রানি বাংলাদেশি পরিবারগুলোর জন্য এখন এক সর্বব্যাপী সংকট: পিপিআরসি

পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি)-এর নতুন এক জরিপে উঠে এসেছে, বাংলাদেশি পরিবারগুলোর জন্য দৈনন্দিন জীবনের নানান হয়রানি এখন সর্বব্যাপী এক সংকটে পরিণত হয়েছে। মৌলিক সেবাপ্রাপ্তি থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্র ও জনপরিসরসহ সমাজের নানা স্তরেই হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে।
জরিপে বলা হয়েছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, চিকিৎসা ব্যয়, ঋণ পরিশোধের চাপ, শিক্ষা খরচ এবং আইনি জটিলতার মতো পুরোনো সামাজিক সংকটের পাশাপাশি হয়রানি এখন এক স্বতন্ত্র ও ক্ষতিকর সমস্যায় রূপ নিয়েছে, কিন্তু এই বিষয়টি এখনও নীতিগতভাবে যথেষ্ট গুরুত্ব পায়নি।
প্রতিবেদনে হয়রানি ও দুর্নীতির মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য টেনে বলা হয়েছে, হয়রানির অর্থনৈতিক ও মানসিক ক্ষয়ক্ষতি প্রায়ই উপেক্ষিত হয়। এতে উল্লেখ করা হয়, "ঘুষ হয়তো মাত্র ১০ টাকা, কিন্তু সেইজন্যে বিলম্ব ও ঝক্কি-ঝামেলায় হারানো এক সপ্তাহের ক্ষতি তার চেয়ে অনেক বেশি।"
খাতভেদে উদ্বেগজনক চিত্র
জরিপের তথ্য অনুযায়ী, স্বাস্থ্যসেবায় হয়রানি সবচেয়ে প্রকট। সারা দেশের প্রায় ৪৯ শতাংশ পরিবার এবং নগর এলাকায় ৫৬ শতাংশ পরিবার স্বাস্থ্য সেবা নিতে গিয়ে নেতিবাচক অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছে। বাজারে হয়রানির শিকার হওয়ার হারও ব্যাপক—সারাদেশে ৪২ শতাংশ এবং নগর এলাকায় ৫২ শতাংশ পরিবার এ ধরনের অভিযোগ করেছে।
সরকারি সেবায় হয়রানির শিকার হওয়ার কথা জানান জাতীয়ভাবে ২২ শতাংশ উত্তরদাতা, যা নগর এলাকায় ৩০ শতাংশ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হয়রানি জাতীয়ভাবে ১৬ শতাংশ ও শহর এলাকায় ২৪ শতাংশ। এছাড়া সড়কপথে হয়রানির কথা জাতীয়ভাবে ১৮ শতাংশ পরিবার জানিয়েছে, এই হার নগর এলাকায় ২৮ শতাংশ। কর্মক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ উত্তরদাতা হয়রানির কথা জানান, এসব হয়রানিও অন্যতম উদ্বেগের কারণ হিসেবে উঠে এসেছে। এসব ফলাফল ইঙ্গিত দেয়, হয়রানি কোনো একটি নির্দিষ্ট খাতেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং সমাজের বিভিন্ন স্তরে তা গভীরভাবে প্রোথিত।
হয়রানির ধরন
"টাকা ছাড়া কোনো কাজ হয় না"—৭৫ শতাংশ পরিবার এ মন্তব্য করেছে। অন্যান্য সাধারণ সমস্যার মধ্যে রয়েছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা (৩৬ শতাংশ), পরিষেবা বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনার অভাব (২৩ শতাংশ), বিলম্ব (২২ শতাংশ), দায়িত্বজ্ঞানহীনতা বা কর্মকর্তার অনুপস্থিতি (২০–১৭ শতাংশ), দুর্ব্যবহার (১৪ শতাংশ) এবং কর্মকর্তাদের মধ্যে নৈতিকতা বা সহায়তার মনোভাবের অভাব (১২ শতাংশ)।
পিপিআরসি'র চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, হয়রানি সংজ্ঞায়িত করা কঠিন, তবে এটি আমাদের সমাজের জীবন্ত বাস্তবতা। এনিয়ে আলোচনা খুব কমই হয়, অথচ এখনই এটি নিয়ে জাতীয়ভাবে আলাপ-আলোচনা জরুরি।
পিপিআরসির গবেষণা প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়েছে, দুর্নীতির মতো হয়রানিও উৎপাদনশীলতা কমায়, জনগণের আস্থার ক্ষয় করে এবং সামাজিক জবাবদিহিতাকে দুর্বল করে। তাই হয়রানিকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে সুশাসন সংস্কারে অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানিয়েছে পিপিআরসি।
ঘুষের প্রবণতায় পরিবর্তন
জরিপে ঘুষ প্রদানের ধরণেও নতুন চিত্র উঠে এসেছে। ২০২৪ সালের আগস্টের পর পরিবারগুলোর ঘুষ দেওয়ার হার ৮.৫৪ শতাংশ থেকে কমে ৩.৬৯ শতাংশে নেমে এসেছে।
যদিও এটি ইতিবাচক ইঙ্গিত, তবে উদ্বেগজনক পরিবর্তনও লক্ষ্য করা গেছে। পুলিশ বিভাগ এখনও সবচেয়ে বড় ঘুষগ্রহণকারী খাত, বরং তাদের অংশ ৩১.৭৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩৯.৩৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের কাছেও ঘুষ প্রদানের প্রবণতা বেড়েছে, যা নতুন ঝুঁকি তৈরি করছে।
অপরদিকে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি ও সরকারি দপ্তরে ঘুষ প্রদানের হার কিছুটা কমেছে, যা ইঙ্গিত করে যে অন্তর্বর্তী সরকারের লক্ষ্যভিত্তিক দুর্নীতি দমন কার্যক্রম কিছুটা সফল হয়েছে।
দুর্নীতির প্রকৃতিতে রূপান্তর
ঘুষ প্রদানের উদ্দেশ্যেও পরিবর্তন ঘটছে। দ্রুত সেবা পাওয়া বা সরাসরি দাবির কারণে ঘুষ প্রদানের হার কমলেও এখন বেশি পরিবার ঘুষ দিচ্ছে আইনি বা প্রক্রিয়াগত ঝামেলা এড়াতে, নিয়ম-কানুন নিয়ে বিভ্রান্তির কারণে অথবা প্রভাবশালী ব্যক্তির অভাবে।
এটি এক গভীর কাঠামোগত সংকটের ইঙ্গিত দেয়, আগে ঘুষ বা দুর্নীতি সরাসরি দাবি হিসেবে চাওয়া হলেও, সেটি এখন এক জটিল প্রশাসনিক কাঠামোর ফাঁদে পরিণত হচ্ছে, যেখানে নাগরিকরা কেবল প্রক্রিয়ার জটিলতা সামলাতে ঘুষ দিতে বাধ্য হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, এই প্রবণতা দীর্ঘমেয়াদে অবিশ্বাস বাড়ায়, অনৈতিক আচরণকে স্বাভাবিক করে তোলে এবং জবাবদিহিকে দুর্বল করে।
জরুরি নীতিগত পদক্ষেপের প্রয়োজন
পিপিআরসি'র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হয়রানি ও দুর্নীতির পরিবর্তিত ধারা বাংলাদেশে সামাজিক বাস্তবতা ও শাসনব্যবস্থার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। ঘুষ প্রদানের হার কমা ইতিবাচক হলেও, মৌলিক সেবায় সর্বব্যাপী হয়রানি এখনই নীতিনির্ধারকদের মনোযোগ দাবি করে।
প্রতিবেদনটি জোর দিয়ে বলেছে, কেবল অপরাধীদের শাস্তি দিলেই হবে না; বরং নিয়ম সহজ করা, স্বচ্ছতা বাড়ানো এবং জনসেবা আরও জবাবদিহিমূলক ও নাগরিকবান্ধব করার সংস্কার জরুরি। অন্যথায় হয়রানি ও দুর্নীতি মোকাবিলায় অর্জিত অগ্রগতি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, আর সামাজিক আস্থা পুনর্গঠন হবে আরও কঠিন।