জুলাই সনদ বাস্তবায়নে ভিন্ন অবস্থানে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি; আশাবাদী ঐকমত্য কমিশন

জুলাই জাতীয় সনদের পূর্ণাঙ্গ খসড়া নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে এখন পর্যন্ত ২৬টি দল মতামত দিয়েছে। এতে সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে দেখা দিয়েছে মতপার্থক্য।
বিএনপি চায় সনদ বাস্তবায়ন হোক আগামী সংসদে; অন্যদিকে, এনসিপি প্রস্তাব করেছে গণপরিষদ, আর জামায়াতে ইসলামী দাবি তুলেছে গণভোটের। তবে দলগুলোর অনড় অবস্থান সত্ত্বেও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বিশ্বাস, এ বিষয়ে আইনসম্মত উপায় বের করা সম্ভব হবে। যদিও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা কবে শুরু হবে, তা জানায়নি কমিশন।
এরই মধ্যে কমিশন বিষয়টি নিয়ে আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে। রোববার (২৪ আগস্ট) ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আইন উপদেষ্টা ও অ্যাটর্নি জেনারেলসহ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠক করে কমিশন।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল, অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম এ মতিন, বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী, সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট ড. শরিফ ভূইয়া ও ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিক।
বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির ভিন্ন অবস্থান প্রসঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমি এখনো সম্ভাবনা দেখি। তিনটি প্রস্তাব একসঙ্গে সম্ভব নয়। আলোচনার টেবিলে বসতে হবে। এটি রাজনৈতিক ও আইনি প্রক্রিয়া। আশা করি, দলগুলো বিবেচনা করবে এবং একটি আইনসম্মত ও বাস্তবসম্মত উপায় বের হবে। দেখা যাক, আমরা কোথায় পৌঁছাতে পারি।"
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ঐকমত্য কমিশন যদি জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের পথ নিয়ে আবারও আলোচনায় বসতে চায়, আমরা আন্তরিকভাবে অংশ নেব। বৈধ আইনি ও সাংবিধানিক উপায়ে বাস্তবায়নের বিষয়ে আলোচনায় ঐকমত্য এলে বিএনপি সেটির প্রতি সমর্থন জানাবে।"
গণভোট ও গণপরিষদ নির্বাচনের দাবির বিষয়ে তিনি আরও বলেন, "আমরা আলোচনায় বসতে আগ্রহী। আলোচনায় যে ফলাফল বা ঐকমত্য আসবে, সেই অনুযায়ী জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে বিএনপি অঙ্গীকারবদ্ধ।"
এর আগে, গত ২৯ জুলাই কমিশনের সঙ্গে দ্বিতীয় দফার বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ জানান, জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এর একটি প্রাথমিক খসড়া হাতে পেয়েছেন তারা। তিনি বলেন, "এতে বিস্তারিত প্রস্তাবনা নেই, সেগুলো পরে যুক্ত হবে। তবে খসড়ার মূল কাঠামোর সঙ্গে আমরা মোটামুটি একমত। আগামী সংসদে দুই বছরের মধ্যে সংস্কার বাস্তবায়নের অঙ্গীকারের বিষয়টি বিএনপি সমর্থন করছে।"
অন্যদিকে গত শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, "জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করতে হলে সংবিধানে ৬০-৭০ বা তারও বেশি পরিবর্তন করতে হবে, যা সংবিধান পুনর্লিখনেরই সমান। গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই নতুন সংবিধানের টেক্সট তৈরি করবেন।"
জুলাই সনদকে আইনি ভিত্তি দিতে গণভোট আয়োজনের দাবি তুলেছে জামায়াতে ইসলামী। দলের নায়েবে আমীর সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, "ঐকমত্যের ভিত্তিতে আইনি কাঠামো তৈরি করতে হবে, না হলে এ আলোচনা ফলপ্রসূ হবে না। অতীতে পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনীর মাধ্যমে যেভাবে গণভোট ও প্রোক্লেমেশন সাংবিধানিক মর্যাদা পেয়েছিল, একইভাবে জুলাই সনদকেও আইনি বৈধতা দিতে হবে।"
তিনি আরও বলেন, "কেউ কেউ বলছেন, সংসদে গিয়ে আইন করা যাবে। এটা অবাস্তব। কারণ পরবর্তী সংসদ যদি পুরোনো নিয়মে নির্বাচিত হয়, তবে সংস্কার কার্যকর হবে না।"
মতামত জমা দেওয়া দলসমূহ
এখন পর্যন্ত মতামত দিয়েছে—লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), খেলাফত মজলিস, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম), বিএনপি, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, ১২ দলীয় জোট, আমজনতার দল, গণফোরাম, বাসদ, জাতীয় গণফ্রন্ট, বাসদ (মার্কসবাদী), এনসিপি, গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশ জাসদ, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, জাকের পার্টি, ভাসানী জনশক্তি পার্টি, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি, সিপিবি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও নাগরিক ঐক্য।
এখনও মতামত জমা দেয়নি—গণঅধিকার পরিষদ (জিওপি), রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ ও ইসলামী ঐক্যজোট।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "তিনটি প্রস্তাব একসঙ্গে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। আলোচনার টেবিলে বসে সমাধান খুঁজতে হবে। আশা করি রাজনৈতিক দলগুলো একটি আইনসম্মত ও বাস্তবসম্মত উপায় খুঁজে বের করবে।"
কমিশনের আরেক সদস্য বদিউল আলম মজুমদার বলেন, "আমাদের সবাইকে সচেষ্ট থাকতে হবে যেন সত্যিকার অর্থে একটি ঐকমত্য তৈরি হয়। আমরা কেউ নিশ্চিত নই, তবে সবাই আশাবাদী।"