আন্দোলন থেকে জাকসু নির্বাচন: কেন পিছু হটছেন জাহাঙ্গীরনগরের মেয়েরা

অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলনে দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) মেয়েদের। ১৯৯৯ সালের ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান—সবক্ষেত্রেই নারী শিক্ষার্থীরা সামনের কাতারে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তুলেছেন কণ্ঠ।
কিন্তু দীর্ঘ ৩৩ বছর পর আগামী ১১ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচনকে ঘিরে কিছুটা ভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে। এবারে ব্যালট থেকে কিছুটা যেন পিছিয়ে যাচ্ছেন নারীরা।
যদিও জাবির মোট ১১,৯১৯ জন ভোটারের প্রায় অর্ধেকই নারী, তবু প্রার্থী মনোনয়নে তাদের অংশগ্রহণ অনেক কম।
কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের ২৫টি পদে মোট ২৭৬টি মনোনয়নপত্র জমা পড়েছে। এরমধ্যে নারীদের জমা দেওয়া মনোনয়নপত্র মাত্র ৫৭টি, যার মধ্যে ৪৩টিই কেবল সংরক্ষিত আসনের জন্য।
সহ-সভাপতি পদে কোনো নারী প্রার্থী নেই, আর সাধারণ সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন মাত্র দুইজন নারী।
প্রায় একই চিত্র দেখা যাচ্ছে হল পর্যায়েও। ছেলেদের ১১টি হল থেকে জমা পড়েছে ২৮৯টি মনোনয়নপত্র, অথচ মেয়েদের ১০টি হল থেকে জমা পড়েছে মাত্র ১২৮টি।
অনেক হলেই বিভিন্ন পদের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক প্রার্থী পাওয়া যায়নি। ফলে বেশ কয়েকটি পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
আগামী ২৯ আগস্ট চূড়ান্ত প্রার্থীতালিকা প্রকাশের পর নারী প্রার্থীর সংখ্যা আরও কমে যেতে পারে।
নৃবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী সায়েদা মেহের শাওলি বলেন, "নারীদের কম অংশগ্রহণের একটি প্রধান কারণ হলো, তারা এখনও নিজেদের 'রাজনৈতিক সক্ষমতা' তৈরি করতে পারেনি।"
তিনি বলেন, "২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে নারীরা নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে লড়াই করার পরিবেশ পেয়েছিল। কিন্তু সেই পরিবেশ টেকেনি।"
তিনি আরও যোগ করেন, "আজও যখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বা স্টেকহোল্ডারদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, তখন নারীদের মতামত উপেক্ষা করা হয়। এতে তারা নিজেকে প্রান্তিক মনে করেন। নারীদের রাজনৈতিক ভূমিকায় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করানোর পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে না, যথাযথ সহায়তাও দেওয়া হচ্ছে না। এ কারণেই অনেক নারী জাকসু নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী নন।"
দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী তানজিন তাম্মি বলেন, "২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর নারীদের কোথাও যথাযথভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। তারা সব জায়গায় অবহেলিত থেকেছে। বরং অনেক ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্যাগিং, বুলিং আর ব্যক্তিগত আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে অনেককে। মানুষ একজন নারীর রাজনৈতিক ভূমিকা নয়, বরং তার ব্যক্তিজীবন নিয়েই আলোচনা করতে বেশি আগ্রহী।"
তিনি আরও বলেন, "উদাহরণ হিসেবে রুমিন ফারহানার কথাই ধরা যেতে পারে। রাজনীতিতে তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান উপেক্ষা করে তার ব্যক্তিগত জীবনকে সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দু বানানো হয়েছে। একইভাবে তাসনিম জারা যখন প্রতিষ্ঠিত ক্যারিয়ার ছেড়ে রাজনীতিতে আসেন, তখন তাকে সম্মান না জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়। এসব অভিজ্ঞতা নারী শিক্ষার্থীদের রাজনীতিতে প্রবেশে নিরুৎসাহিত করছে।"
তাম্মি আরও বলেন, "নারীরা যখন এসব দেখছেন, তখন নিজেরাও একই ধরনের অপমানের শিকার হওয়ার ভয় পাচ্ছেন। আর কেউ যদি মূলধারার বিপরীতে মতামত দেন, তাকে তো 'শাহবাগি' ট্যাগ দেওয়া হয়। আমার প্রশ্ন হচ্ছে—কেন?"
"আমার মনে হয়, এসব কারণেই নারীরা নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছেন। এটাই জাকসু নির্বাচনে কিংবা সামগ্রিক রাজনৈতিক অঙ্গনে নারী প্রার্থীর সংখ্যা কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ," যোগ করেন তিনি।