রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় বিপর্যস্ত মেডিকেল সরঞ্জাম খাত

রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে নতুন বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় দেশের মেডিকেল সরঞ্জাম খাত বড় ধাক্কা খাচ্ছে। উদ্যোক্তাদের দাবি, এর প্রভাব পড়ছে ব্যবসা ও প্রবৃদ্ধিতে।
সার্জিকেল ইন্সট্রুমেন্টস, ওটি ইকুইপমেন্ট, হাসপাতাল ফার্নিচারসহ বিভিন্ন মেডিকেল সরঞ্জামের জন্য পরিচিত প্রতিষ্ঠান 'মনির নিউরো স্পাইন সার্জিক্যাল মার্ট'। আমদানির পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটি কিছু সরঞ্জাম নিজেরাই উৎপাদন করে। ২০১২ সালে যাত্রা শুরু করা এ প্রতিষ্ঠান মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা ও নেপালসহ বিভিন্ন দেশের মেডিকেল এক্সপোতে অংশ নিয়েছে। তবে গত এক-দেড় বছর ধরে ব্যবসা কিছুটা স্থবির হয়ে পড়েছে বলে জানান প্রতিষ্ঠাতা মো. মনিরুল ইসলাম।
তিনি টিবিএসকে বলেন, 'নতুন বিনিয়োগকারীরা এখন বিনিয়োগ করছেন না। স্বাভাবিকভাবে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা থাকলে কেউ নতুন প্রজেক্টে হাত দিতে চায় না। হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেক্টরে নতুন বিনিয়োগ না আসলে আমাদের ব্যবসায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এর আগে প্রতিবছরই ভালো প্রবৃদ্ধি ছিল। তবে সেটা এবার অনেক কম।'
রাজধানীর ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি বসুন্ধরায় (আইসিসিবি) বৃহস্পতিবার শুরু হয়েছে তিন দিনব্যাপী 'বাংলা মেড এক্সপো ২০২৫'। মেলায় প্রায় ১২০টিরও বেশি দেশী ও বিদেশী প্রতিষ্ঠান সর্বাধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম ও স্বাস্থ্যসেবা উদ্ভাবন প্রদর্শন করছে। বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার মেলায় অংশ নেওয়া উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠানের অন্তত ১২ জন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বললে, প্রায় সবাই বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যবসায়িক চ্যালেঞ্জের কথা জানিয়েছেন।
প্রায় ২২ বছর ধরে দেশের বাজারে হোম হেলথ কেয়ার আইটেম নিয়ে কাজ করছে 'মাইক্রোমেড'। তারা প্রতিবছরই এক্সপোতে অংশ নেয়। প্রতিষ্ঠানটির কাস্টমার সার্ভিস ম্যানেজার মো. শামীম হোসেন টিবিএসকে বলেন, 'প্রায় ৬ মাস ধরে ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা খুবই খারাপ। হয়তো নতুন বিনিয়োগের জন্য মানুষ রাজনৈতিকভাবে নির্বাচিত সরকারের জন্য অপেক্ষা করছে। অথবা মানুষের কাছে টাকা নেই।'
একই শঙ্কার কথা জানান 'ইসলাম ট্রেডিং'-এর সহকারী ব্যবস্থাপক (বিক্রয়) মো. মহসিন। তিনি বলেন, 'বর্তমানে সামগ্রিক ব্যবসায়িক পরিবেশ এখন কিছুটা চ্যালেঞ্জিং।'
এক্সট্রিম এক্সিবিশন অ্যান্ড ইভেন্ট সলিউশন লিমিটেডের আয়োজনে এই প্রদর্শনী ২০২২ সাল থেকে টানা চতুর্থবারের মতো অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এবারের প্রদর্শনীতে বাংলাদেশ, চীন, ভারত, পাকিস্তান, তাইওয়ান ও সুইজারল্যান্ডসহ ১০টি দেশের প্রায় ৪০০ ব্র্যান্ড অংশ নিয়েছে। তারা মেডিকেল ইকুইপমেন্ট ও ডিভাইস, ডিসপোজেবল ও ভোগ্যপণ্য, অর্থোপেডিক ও ফিজিওথেরাপি, ইমেজিং ও ডায়াগনস্টিকস, স্বাস্থ্যসেবা, আইটি সিস্টেম, অবকাঠামো ও সম্পদ, এবং ওয়েলনেস ও প্রিভেনশন সেক্টরের উদ্ভাবন সামগ্রী প্রদর্শন করছে।
প্রদর্শনীর আয়োজক প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র ম্যানেজার অভিজিৎ মণ্ডল টিবিএসকে বলেন, 'মেডিকেল সেক্টর সবসময় পরিবর্তনশীল। এ প্রদর্শনী স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য নতুন প্রযুক্তি প্রদর্শন, অভিজ্ঞতা বিনিময় ও শেখার সুযোগ তৈরি করছে।'
নতুন প্রযুক্তি প্রদর্শনী
এক্সপোতে অংশ নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন প্রযুক্তি প্রদর্শন করছে। দেশীয় প্রতিষ্ঠান ইসলাম ট্রেডিং তাদের স্টলে এনেছে 'আইকেয়ার১৩০০' নামের একটি পিওসিটি অ্যানালাইজার। এই এক মেশিনে সিবিসি, এইচবিএওয়ানসি, বায়োকেমিস্ট্রি এবং ফ্লুরেসেন্স ইমিউন্যাসি পরীক্ষা করা যাবে। চীনের সিনোকেয়ার থেকে আমদানিকৃত মেশিনটি এখনো বাংলাদেশে বিক্রি শুরু হয়নি।
মোহসিন বলেন, 'এ মেশিনটি শুধুমাত্র ডিসপ্লের জন্য রাখা হয়েছে। আগে আলাদা আলাদা যন্ত্রের মাধ্যমে এ পরীক্ষা করা হতো। এখন এক মেশিনেই চারটি পরীক্ষা করা যাবে।'
এছাড়া এক্সপোতে এসেছে অত্যাধুনিক সিপিআর মেশিন, যা এনেছে চীনের টেকমেঞ্জ গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান তিয়াংল্যাং। এ মেশিন কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের রোগীদের জন্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে বুকে চাপ দেওয়ার কাজ করে। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো প্রতিষ্ঠানটি স্বয়ংক্রিয় এ মেশিনটি নিয়ে এসেছে।
কোম্পানির বিক্রয় ও বিপণন ব্যবস্থাপক এরিক তিয়ান বলেন, 'আমরা নতুন উদ্যোক্তাদের আকৃষ্ট করতে নতুন প্রযুক্তি নিয়ে এসেছি। আমরা বাংলাদেশে এমন পরিবেশক খুঁজছি যারা আমাদের সঙ্গে কাজ করবে।'
নেটওয়ার্কিং মূল লক্ষ্য
মেলায় অংগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি দর্শনার্থীদের মূল উদ্দেশ্য নেটওয়ার্কিং। সার্জিকেল আইটেম নিয়ে অংশ নেওয়া স্পার্টেক-এর স্বত্বাধিকারী মুহাম্মদ বাবের বলেন, 'এবারই প্রথম বাংলাদেশের কোনো মেলায় অংশ নিয়েছি। লক্ষ্য নেটওয়ার্ক তৈরি করা এবং বাংলাদেশের কোন কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের সাথে যৌথভাবে কাজ করা।'
এবারের মেলায় উদ্যোক্তা হতে আগ্রহী অনেকেই এসেছেন। ব্যবসায়িক পরিকল্পনা নিয়ে আসা উদ্যোক্তা রাসেল খান বলেন, 'মেডিকেল ইকুইপমেন্ট নিয়ে ব্যবসা শুরু করার ইচ্ছা আছে। বাজারের চাহিদা, আমদানির ধারা ও পণ্যের উৎস সম্পর্কে ধারণা নিতে এসেছি।'
এছাড়া বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরাও নতুন প্রযুক্তি দেখতে মেলায় এসেছে। সাইক কলেজ অব মেডিকেল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির শিক্ষার্থী প্রীতম পাল বলেন, 'এ ধরনের প্রদর্শনীতে এসে নতুন অনেক যন্ত্রপাতি দেখা যায়, ব্যবহারও বোঝা যায়। তাই আমাদের কলেজ নিয়ে এসেছে।'
আয়োজকরা জানান, ২০২০ সালে বাংলাদেশের মেডিকেল ইকুইপমেন্ট ও ডিভাইস বাজারের আকার ছিল ৪৪২ মিলিয়ন ডলার। ২০২৫ সালে তা ৮২০ মিলিয়ন ডলার ছাড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে এবং ২০৩০ সালে তা ৩ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করতে পারে। এ খাতে আমদানির ২৫-৩০ শতাংশ আসে ভারত ও চীন থেকে, ১০-১৫ শতাংশ জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে এবং ৩ শতাংশেরও কম আসে তাইওয়ান ও পাকিস্তান থেকে।
প্রদর্শনীটি শনিবার পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত চলবে।