বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে গুম, অপহরণের অভিযোগ থামেনি: মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর

২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হলেও গুম ও অপহরণের অভিযোগ থামেনি বলে জানিয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর। মানবাধিকার সংগঠন ও গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে এসব ঘটনায় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে।
'২০২৪ কান্ট্রি রিপোর্টস অন হিউম্যান রাইটস প্র্যাকটিসেস: বাংলাদেশ' শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, জানুয়ারি থেকে জুনের মধ্যে মানবাধিকার সংস্থা এইচআরএসএস তিনজনকে গুম ও আটজনকে বেআইনিভাবে আটকের ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। এদের ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় আটক রাখা হয়; পরে কেউ মুক্তি পান, কেউ গ্রেপ্তার দেখানো হয়। আগের সরকার এসব ঘটনা প্রতিরোধ, তদন্ত বা দায়ীদের শাস্তি দিতে সীমিত পদক্ষেপ নিয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গুম হওয়া অধিকাংশই বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা, কর্মী ও ভিন্নমতাবলম্বী। অভিযোগ আছে, গুমের পর অনেককে কোনো অভিযোগ গঠন ছাড়াই ছেড়ে দেওয়া হয়, আবার কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে জোরপূর্বক গুমের একটি ঘটনা আনুষ্ঠানিকভাবে নথিভুক্ত হয়েছে। গাড়ি মালিক সমিতির কর্মকর্তা আসলাম সেরনিয়াবাতকে ২০২৪ সালের ২৯ আগস্ট ঢাকায় পুলিশ ও সাদা পোশাকধারী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তুলে নিয়েছে বলে তার স্বজনদের অভিযোগ। পরে থানায় মামলা হয়। ওই বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর পুলিশ তাকে হত্যা মামলায় আদালতে হাজির করে।
সরকার পরিবর্তনের পরপরই গোপন বন্দিশালা থেকে বহু গুম হওয়া ব্যক্তিকে মুক্তি দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আট বছর পর্যন্ত সেখানে আটক ছিলেন। পাহাড়ের অধিকারকর্মী মাইকেল চাকমা পাঁচ বছরের বেশি সময় গোপনে আটক থাকার পর মুক্তি পান। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের হিসাবে, এখনও গুমের শিকার প্রায় ১০০ জন নিখোঁজ রয়েছেন।
ফ্রিডম হাউসের 'ফ্রিডম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড ২০২৪' প্রতিবেদনে বলা হয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, অপহরণ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ বহুদিনের। মাদকবিরোধী অভিযান, সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান ও সংগঠিত অপরাধ দমনের সময়ও এসব অভিযোগ উঠে এসেছে।
গত আগস্টে সরকার 'বাংলাদেশ গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন' গঠন করে। ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত গুমের ঘটনা তদন্তের দায়িত্ব পায় সংস্থাটি। প্রথমে ৪৫ দিনের জন্য মেয়াদ নির্ধারণ হলেও পরে তা বাড়ানো হয়। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়, নভেম্বরে কমিশন ঢাকার ভেতর ও আশপাশে আটটি গোপন বন্দিশালার সন্ধান পায় এবং গুমের ১ হাজার ৬০০ অভিযোগ গ্রহণ করে।
দীর্ঘদিন বিচারবহির্ভূতভাবে আটক
আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, সীমিত সম্পদ, তদন্তের নিয়ম শিথিলভাবে মানা ও দুর্নীতির কারণে দেশে বিচারবহির্ভূতভাবে বা বিচার শুরু হওয়ার আগেই দীর্ঘদিন ধরে আটক রাখার ঘটনা অব্যাহত ছিল। আইনজীবীদের মতে, আগের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ)-এর মতো কিছু আইনের অপব্যবহারও এ প্রবণতার বড় কারণ। এসব আইনের অনেক ধারাতেই জামিনের সুযোগ ছিল না। ফলে অনেক সময় অভিযুক্তকে এতদিন আটক রাখা হতো যে শাস্তি হলেও তা আটক সময়ের সমান বা কম হতো।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংবিধান বিচারবহির্ভূতভাবে গ্রেপ্তার ও আটক নিষিদ্ধ করলেও আইন অনুযায়ী নিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলার জন্য হুমকি মনে করলে, কিংবা গুরুতর অপরাধে জড়িত সন্দেহে, আদালতের পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেপ্তার ও আটক করা যেত।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অনেক সময় আটক ব্যক্তির পরিবারের কাছে বা আইনজীবীর কাছে তাদের অবস্থান জানানো হতো না, এমনকি গ্রেপ্তারের বিষয়টিও স্বীকার করা হতো না।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, সংবিধান যে কোনো ব্যক্তিকে তার গ্রেপ্তার বা আটকের বৈধতা আদালতে চ্যালেঞ্জ করার অধিকার দিয়েছে। আগের সরকার সাধারণত এ নিয়ম মানেনি, তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গত নভেম্বর থেকে তা মেনে চলছে।
সংবিধান বলছে, পরোয়ানার মাধ্যমে বা অপরাধ সংঘটিত হতে দেখা গেলে গ্রেপ্তার ও আটক করা যাবে। তবে আইনে এসব সুরক্ষার বড় ধরনের ব্যতিক্রম রাখা হয়েছে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, রাজনৈতিক সমাবেশ বা বক্তব্যের সঙ্গে যুক্ত থেকে, কিংবা সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানের অংশ হিসেবে বহুবার মানুষকে বিচারবহির্ভূতভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই তাদের আটক রাখা হয়েছে, অনেক সময় অন্য সন্দেহভাজনদের তথ্য আদায়ের জন্য।
১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের বিস্তৃত ক্ষমতা এসব গ্রেপ্তারের আইনি ভিত্তি দিয়েছে, যা অন্য পরিস্থিতিতে বিচারবহির্ভূত হিসেবে গণ্য হতো। কারণ, এ আইন অনুযায়ী গ্রেপ্তারের জন্য আগে সংঘটিত অপরাধ প্রমাণের প্রয়োজন ছিল না।
মানবাধিকারকর্মীরা অভিযোগ করেছেন, আগের সরকার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের নেতা, কর্মী ও সমর্থকদের লক্ষ্য করে পুলিশের মাধ্যমে মিথ্যা মামলা দিয়েছে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করেছে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের দমন করতে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আগের সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের নির্বিচারে গ্রেপ্তার অব্যাহত ছিল। জানুয়ারিতে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে উল্লেখ করা হয়, জাতীয় নির্বাচনের আগে বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে বড় ধরনের দমন অভিযান চালানো হয়। বিএনপির দাবি, নির্বাচনের আগের কয়েক মাসে তাদের ২০ হাজারের বেশি কর্মী-সমর্থককে কারাগারে পাঠানো হয়।
তবে তৎকালীন সরকারি কর্মকর্তারা এ সংখ্যা অস্বীকার করে বলেন, গ্রেপ্তার রাজনৈতিক পরিচয়ের ভিত্তিতে নয়, বরং অগ্নিসংযোগের মতো নির্দিষ্ট অপরাধের অভিযোগে হয়েছে।