জুলাই সহিংসতা: পুলিশের বিরুদ্ধে বেশিরভাগ মামলায় এখনও অভিযোগ গঠন হয়নি

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত হত্যা ও নির্যাতনের মতো অপরাধে পুলিশ সদস্যদের ভূমিকার জন্য তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলোতে বিচার এখনও শুরু হয়নি।
বাংলাদেশ পুলিশসহ বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সূত্রমতে, গত এক বছরে ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানে প্রায় ৭০-৮০ জন পুলিশ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এর মধ্যে ২৪ জনকে ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকার ৫০টি থানায় দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। তবে বেশিরভাগ মামলাতেই তদন্তকারীরা এখনও অভিযোগপত্র জমা দেননি। পুলিশ, পিবিআই, সিআইডি, ডিবিসহ দায়িত্বপ্রাপ্ত তদন্ত সংস্থাগুলো কবে নাগাদ এই প্রতিবেদন জমা দেবে, তার কোনো সুস্পষ্ট সময়সীমা এখনও দেয়নি।
সাধারণত মামলার বিচার শুরু হয় ওই মামলার অভিযোগপত্র দাখিলের পর বিচারিক আদালতে চার্জ বা অভিযোগ গঠনের পর। এর আগপর্যন্ত মামলাটি তদন্তাধীন থাকে। পুলিশ সদস্যদের অধিকাংশ মামলারই অভিযোগপত্র দাখিল না হওয়ায় বেশিরভাগ মামলায় এখনও বিচারকার্যই শুরু হয়নি।
তবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) কয়েকটি মামলায় অভিযোগপত্র দাখিল করায় ওই মামলায় সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ কয়েকজনের বিচার শুরু হয়েছে।
তবে সারা দেশে কতগুলো মামলায় পুলিশ সদস্যদের আসামি করা হয়েছে ও কতজন গ্রেপ্তার হয়েছেন, তার সঠিক সংখ্যা বের করা কঠিন। অনেক মামলায় বেসামরিক নাগরিক ও পুলিশ উভয়কেই আসামি করা হয়েছে। কিছু কর্মকর্তা একাধিক মামলায় অভিযুক্ত।
এখনও কোনো পুলিশ সদস্যের শাস্তি হয়নি
আদালত সূত্র, মানবাধিকার কর্মী ও নাগরিক সমাজের নেতারা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের মুখ্য দায়িত্ব পালন না করে পুলিশ বাহিনী গুম, খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ রাজনৈতিক নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে বিভিন্ন মহলকে সহযোগিতা করেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় পুলিশকে ভয়ংকর রূপ দেখা গেছে।
কিন্তু এখন পর্যন্ত জুলাই সহিংসতা ও গুলির অভিযোগে দায়ের করা মামলাগুলোতে কোনো পুলিশ সদস্যকে বিচারের আওতায় আনা বা শাস্তি দেওয়ার কোনো নজির নেই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার অনীক আর হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, জুলাই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পুলিশ বাহিনী দীর্ঘ সময় ধরে নিষ্ক্রিয় ছিল। এতে একটি বিশাল 'গ্যাপ' তৈরি হয়েছে। তাই মামলাগুলো সুষ্ঠু তদন্ত করতে কিছুটা সময় লাগবে।
তিনি বলেন, 'সেই গ্যাপ কাটিয়ে উঠতে সময় প্রয়োজন, তবে পুলিশ এখন সক্রিয় হয়েছে। আশা করি, খুব শীঘ্রই এসব মামলার চার্জশিট দাখিল করবে তদন্ত সংস্থা। চার্জশিট দাখিল হওয়ামাত্রই রাষ্ট্রপক্ষ থেকে দ্রুত এসব মামলায় আসামিদের বিচারের মুখোমুখি করবে।'
'অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে মামলাগুলো তদন্ত করা হচ্ছে'
জুলাই অভ্যুত্থান-সংক্রান্ত মামলাগুলোর তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে সম্প্রতি পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম সাংবাদিকদের বলেন, মামলাগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। সে কারণে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে মামলাগুলো তদন্ত করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, 'অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে সুষ্ঠুভাবে মামলাগুলোর তদন্ত সম্পন্ন করার কাজ চলছে। তাড়াহুড়ো করে তদন্ত শেষ করে মামলার চার্জশিট দাখিল করাটা জরুরি নয়। তাড়াহুড়ো করে তদন্ত শেষ করলে তাতে ত্রুটি থাকলে অপরাধীরা অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার সুযোগ পাবে।'
আইজিপি আরও বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের সঙ্গে বিপুলসংখ্যক মানুষকে হত্যার ঘটনা জড়িত ছিল। সে কারণে তদন্তে শেষ করতে সময় লাগবে। 'এ সম্পর্কিত প্রতিটি মামলার তদন্ত সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার ব্যাপারে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।'
ডিএমপির প্রসিকিউশন বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মাইন উদ্দিন চৌধুরী টিবিএসকে জানান, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সহিংসতাকে কেন্দ্র করে গত এক বছরে ডিএমপির আওতাধীন ৫০ থানায় ৭০৬টি মামলায় ৫ হাজার ৭৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
তিনি বলেন, '[ডিএমপির অধীন] এসব মামলায় এখন পর্যন্ত প্রায় ২৪ জন পুলিশ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলারগুলোতে হত্যা, হত্যাচেষ্টা, মারধর ও নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়েছে।'
৭০ শতাংশ মামলার তদন্তে অগ্রগতি দেখছে টিআইবি
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) তথ্যমতে, গণঅভ্যুত্থানের পরের ১১ মাসে সারা দেশে পুলিশের বিরুদ্ধে মোট ৭৬১টি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
সংস্থাটির প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, এসব মামলায় মোট ১ হাজার ১৬৮ জন পুলিশ সদস্যকে আসামি করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৬১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
টিআইবির কর্মকর্তারা বলছেন, প্রায় ৭০ শতাংশ মামলার তদন্তে 'সন্তোষজনক অগ্রগতি' হয়েছে এবং ৬০-৭০টি হত্যামামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
এছাড়া পুলিশের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলাগুলোর মধ্যে ২৭টি এখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিটি) প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এসব মামলায় মোট আসামি ২০৬ জন পুলিশ সদস্য, যাদের মধ্যে ৭৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আদালত সূত্র অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালে পুলিশের বিরুদ্ধে ৪২৯টি অভিযোগ জমা পড়েছে।
তবে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন সংশোধনের আগেই বিচার শুরু হলেও প্রক্রিয়াটি কিছুটা ধীরগতিতে চলছে।
গ্রেপ্তার হয়েছেন কারা?
গ্রেপ্তার হওয়া পুলিশ সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক দুই আইজিপি শহীদুল হক ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া, ঢাকা জেলার সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহ হিল কাফি, ডিএমপির (গোয়েন্দা) সাবেক উপকমিশনার মশিউর রহমান, যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক পরিদর্শক মাজহারুল ইসলাম, ডিবি গুলশান জোনের সাবেক সহকারী পুলিশ কমিশনার ইফতেখার মাহমুদ, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা (এনএসআই) বর্ডার উইংয়ের সাবেক পরিচালক কমোডর মনিরুল ইসলাম, গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের সাবেক কমিশনার মোল্লা নজরুল ইসলাম, রাঙ্গামাটি ট্রেনিং সেন্টারের সাবেক পুলিশ সুপার (এসপি) মহিউদ্দিন ফারুকী, সাবেক এএসপি আলেপ উদ্দিন, সাবেক এএসপি শাহেন শাহ্, সাবেক এএসপি জুয়েল রানা, সাবেক এএসপি মো. রফিকুল ইসলাম, চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার সাইফুল ইসলাম, রাজশাহীর সারদায় বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির সাবেক এসপি তানভীর সালেহীন ইমন, ডিএমপির বাড্ডা জোনের সাবেক সহকারী পুলিশ কমিশনার রাজন কুমার সাহা ও যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসান।
'দায়মুক্তির কোনো সুযোগ নেই'
পুলিশের বিরুদ্ধে দায়ের করা হত্যামামলা প্রসঙ্গে মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন টিবিএসকে বলেন, কোনো হত্যাকাণ্ডের দায় থেকেই অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের মুক্তির কোনো সুযোগ নেই—যতক্ষণ না সংসদ তাদের দায় থেকে অব্যাহতি দিচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, '[জুলাই আন্দোলনের সময়কার] প্রত্যেকটি হত্যাকাণ্ডের বিচার হওয়া উচিত। সঠিক তদন্তে বের হওয়া উচিত হত্যার মূল রহস্য। একমাত্র পার্লামেন্ট তাদের দায়মুক্তির সুযোগ দিলে তবেই তারা এসব মামলায় মুক্তি পাবেন।'
লিটন আরও বলেন, তিনি আরও বলেন, মানবিক দিন থেকে প্রত্যেকটি হত্যাকাণ্ডের বিচার হওয়ায় উচিত। 'গত ১৫ বছর ধরে ফ্যাসিস্ট সরকার জনগণ ও পুলিশের মধ্যে এ ধরনের শত্রুতার সম্পর্ক তৈরি করেছে। এর ফলশ্রুতিতে এই জুলাই হত্যাকাণ্ড।'