সড়কে ফিটনেসবিহীন বাস: ঘটছে দুর্ঘটনা, কালো ধোঁয়ায় দম বন্ধ; ভ্রূক্ষেপ নেই বাস মালিকদের

ঢাকার মগবাজার এলাকায় আগস্টের এক সকালে ৩৪ বছর বয়সী গৃহিণী তাহমিনা হক তার নয় বছর বয়সী ছেলে লুহাম ওয়াসির হাত ধরে স্কুল গেটের দিকে হাঁটছিলেন। হঠাৎ সিগন্যাল থেকে একটি পুরোনো বাস এসে ঘন কালো ধোঁয়ার মেঘে মা-ছেলেকে ঢেকে দিল।
ওয়াসি হঠাৎ জোরে কাশি দিল, ছোট হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল, আর তাহমিনা তাকে কাছে টেনে ধরে ধোঁয়া থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করলেন। তাহমিনা পরে টিবিএসকে বলেন, 'গলা জ্বালা করে, চোখ ঝলসে যায়। এভাবেই আমাদের বাচ্চারা প্রতিদিন বাতাস শ্বাস নিচ্ছে।'
ঢাকার সড়কে এখনও অনেক পুরোনো ও ফিটনেসবিহীন বাস চলাচল করছে। এসব বাসের অনেকগুলোর বয়স ২০ থেকে ৩০ বছর, গায়ের রঙ উঠে গেছে, ইঞ্জিন থেকে কালো ধোঁয়া বের হয়, আর ব্রেকও ভালো কাজ করে না। যাত্রীরা প্রতিদিন এসব বাসে চড়ে ঝুঁকির মুখে পড়েন, যা শারীরিক অসুস্থতা বা প্রাণহানির কারণ হতে পারে।
সরকার সম্প্রতি পরিবেশবিদ ও সাধারণ মানুষের দাবি মেনে এসব পুরোনো বাস উঠিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা সরকারের এই কঠোর পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আগামীকাল থেকে সারাদেশে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছেন।
তবে আজ সোমবার (১১ আগস্ট) পরিবহন মালিকদের সঙ্গে সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের বৈঠকের পর তারা ৭২ ঘণ্টার ধর্মঘট প্রত্যাহার করেছেন।
সড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ফিটনেসবিহীন বাস
সড়কে চলাচলকারী অনেক বাসের ফিটনেস সার্টিফিকেট মেয়াদোত্তীর্ণ বা নেই। কিছু বাস সরকারিভাবে অযোগ্য ঘোষণা করা হলেও, আইন শিথিল থাকায় এগুলো চলাচল করছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)-এর তথ্য থেকে এই সংকটের এক বিস্তারিত চিত্র পাওয়া যায়। ১৯৮৮ সাল থেকে বিআরটিএ মোট ৮৫ হাজার ১৯৮টি বাস ও মিনিবাস এবং ২ লাখ ১৪ হাজার ৪৪৫টি ট্রাক, কার্গো ভ্যান ও ট্যাংকারের নিবন্ধন দিয়েছে।
২০২৫ সালের ২৪ জুলাই পর্যন্ত মোট নিবন্ধিত বাণিজ্যিক যানবাহনের ২৭ শতাংশ, অর্থাৎ ৮০ হাজার ৩০৯টি যানবাহনের অর্থনৈতিক আয়ু শেষ হয়ে গেছে। এর মধ্যে রয়েছে ৩৯ হাজার ১৬৯টি বাস ও মিনিবাস এবং ৪১ হাজার ১৪০টি পণ্যবাহী যানবাহন।
চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ৩ হাজার ৩৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২ হাজার ৯৪৩ জন নিহত হয়েছেন। গত বছর ৫ হাজার ৮৫৬টি দুর্ঘটনায় ৫ হাজার ৪৮০ জনের মৃত্যু হয়েছিল।
অনেক পথচারীর জন্য ফিটনেসবিহীন এসব বাসগুলো দৈনন্দিন ঝুঁকির কারণ। মোটরসাইকেল চালক তাজওয়ান তালহা বলেন, 'আমি যত দুর্ঘটনা দেখেছি, সবই ফিটনেসবিহীন বাসের কারণে।'
গাড়ি চালক নাহিদুল ইসলাম বলেন, 'বেশির ভাগ বাসে ইন্ডিকেটর, হর্ন বা হেডলাইট নেই। ব্রেকিং সিস্টেমও খারাপ। বাস মালিকদের কোনো খেয়াল নেই, বাস যদি অন্য গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা খায় বা যন্ত্রাংশ ভেঙে যায় — কারণ বাসগুলো পুরোনো, কিছুই বদলাবে না। এগুলো যেন মৃত্যু যন্ত্র।'
স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ক্ষতি
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, রাজধানীতে বায়ু দূষণ কমাতে পুরানো ও দূষণকারী বাসগুলো তুলে নেওয়া হবে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, 'ঢাকাবাসী আর বায়ু দূষণে ভুগতে এবং মৃত্যুবরণ করতে পারবে না। কিছু সংখ্যক ব্যক্তির স্বার্থ পুরো জনগণের স্বাস্থ্যকে ছাপিয়ে যাবে না। বাস মালিকদের অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে হবে।'
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকায় পুরোনো ও বাজে অবস্থায় থাকা বাসগুলো গুরুতর পরিবেশ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে। এসব বাস থেকে বিষাক্ত রাসায়নিক নিঃসৃত হয়, যা শহরের আগে থেকেই বিদ্যমান ভয়াবহ বায়ু দূষণকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।
দীর্ঘ সময় এই দূষিত বাতাসের সংস্পর্শে থাকা শ্বাসপ্রশ্বাসের রোগ যেমন অ্যাজমা, ব্রংকাইটিস এবং অন্যান্য ফুসফুসের রোগ বৃদ্ধির কারণ, বিশেষ করে শিশু ও বয়োজ্যেষ্ঠদের মধ্যে। পাশাপাশি, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক এবং অন্যান্য হৃদরোগের ঝুঁকিও বেড়ে যায়।
সরকারের কঠোর অভিযান
২০ জুলাই থেকে দেশজুড়ে ২০ বছরের বেশি পুরোনো বাস ও মিনিবাস এবং ২৫ বছরের বেশি পুরোনো ট্রাক ও কভার্ড ভ্যান সরাতে অভিযান শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। ঢাকায় আটটি স্থানে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেছে বিআরটিএ।
বিআরটিএ চেয়ারম্যান আবু মোমতাজ সাদ উদ্দিন আহমেদ ফার্মগেটে অভিযান চলাকালীন সাংবাদিকদের বলেন, '২০ বছরের বেশি পুরোনো বাস এবং ২৫ বছরের বেশি পুরোনো ট্রাকগুলো রাস্তায় বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে এবং সড়ক দুর্ঘটনার হার বাড়ায়। এই অভিযানের লক্ষ্য এই ধরনের যানবাহনগুলো।'
তিনবার সময় দেওয়ার পরও সংশ্লিষ্টরা পুরোনো যানবাহন সরায়নি। তাই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তৃতীয় ও শেষ সময়সীমা ছিল ১৯ জুলাই।
মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, 'যানবাহন মালিকদের মাসখানেক সময় দেওয়া হয়েছিল পুরোনো যানবাহন বদলাতে, কিন্তু তারা তা করেনি। আমাদের লক্ষ্য সব পুরোনো যানবাহন সরানো না, কারণ এত জায়গাও নেই। আমরা চাই যানবাহনগুলো প্রতিস্থাপন হোক... ধীরে ধীরে সবচেয়ে পুরোনো যানগুলো আগে সরানো হবে।'
পরিবহন মালিকদের বিরোধিতা
সরকারের উদ্যোগে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের মাঝে তীব্র বিরোধিতা দেখা দেয়। ২৭ জুলাই বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি, বাংলাদেশ বাস-ট্রাক মালিক সমিতি ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের মতো তিনটি প্রধান সংগঠনের নেতারা আট দফা দাবি না মানা হলে ১২ আগস্ট থেকে ৭২ ঘণ্টার সর্বাত্মক ধর্মঘটের ডাক দেন।
তাদের দাবির মধ্যে ছিল—চালকদের জামিনসংক্রান্ত সড়ক পরিবহন আইনের ধারাগুলো সংশোধন, বাণিজ্যিক যানবাহনের মেয়াদ ৩০ বছর করা এবং ততদিন পর্যন্ত ডাম্পিং বন্ধ রাখা, বাণিজ্যিক গাড়িতে অগ্রিম আয়কর বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার।
আরও দাবি ছিল, ১২ বছর বয়সী রিকন্ডিশনড গাড়ি আমদানির অনুমতি, দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ি ৭২ ঘণ্টার মধ্যে মালিকদের ফেরত দেওয়া এবং মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ির জন্য স্ক্র্যাপ নীতিমালা তৈরি।
এছাড়া মহাসড়কে থ্রি-হুইলার ও অবৈধ হালকা যানবাহনের জন্য আলাদা লেন চালু করা, ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু ও নবায়নের প্রক্রিয়া দ্রুত করা এবং শ্রমিক ফেডারেশনের বিদ্যমান ১২ দফা দাবি বাস্তবায়নের দাবি জানানো হয়।
মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম বলেন, 'বাণিজ্যিক যানবাহনের অর্থনৈতিক আয়ু ৩০ বছর হওয়া উচিত। আগে মেয়াদ উত্তীর্ণ যানবাহনও ফিটনেস সনদ থাকলে জেলা পর্যায়ে চলতে পারতো। এই নিয়ম বজায় রাখা প্রয়োজন।'
তিনি জোর দিয়ে বলেন, 'ড্রাইভারদের, এমনকি যারা দুর্ঘটনায় জড়িত, তাদের জামিন পাওয়া সাংবিধানিক অধিকার। বর্তমান আইনি বিধান অতিরিক্ত দণ্ডমূলক।'
মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় সভাপতি কফিল উদ্দিন আহমেদ বলেন, '২০ বছর বয়সী যানবাহনগুলো ডাম্পিংয়ের মাঠে পাঠানো হচ্ছে, যার ফলে সড়কে প্রায় ৮০ শতাংশ গাড়ি চলে যাবে। গাড়ি যদি ফিটনেস ক্লিয়ারেন্স পায়, তাহলে চলতে দেয়া উচিত। না হলে সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা যায়। যদি ৮৩ বছর বয়সী মানুষ দেশের প্রধান উপদেষ্টা হতে পারেন, তাহলে ২০ বছর বয়সী গাড়িকে মৃত্যুদণ্ড কেন দেওয়া হবে?'
'রোড সেফটি' ক্যাম্পেইন
রোড সেফটি (সড়ক নিরাপত্তা) ক্যাম্পেইনের কর্মীরা এসব যুক্তি একেবারেই মানেন না। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান কফিল উদ্দিনের তুলনাকে 'পুরোপুরি বাজে' বলে উল্লেখ করেছেন।
তিনি ঝালকাঠিতে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, যেখানে একটি মেয়াদোত্তীর্ণ বাসের ব্রেক ফেইল করে টোল প্লাজায় ধাক্কা দেয়ায় ১৩ জন নিহত হন। সাইদুর বলেন, 'এসব ঘটনা এক ধরনের হত্যাকাণ্ড। এজন্য গাড়ির মালিকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হতে হবে।'
তিনি আরও বলেন, পরিবহন মালিকরাই রুট পারমিট নিতে গিয়ে ২০ বছরের সময়সীমা মেনে নিয়েছেন। 'অধিকাংশ দুর্ঘটনা হয় মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ির কারণে। এমন গাড়ি চালানোর অধিকার কারো নেই, যা মানুষকে মারতে পারে।'
বাস চালকরাও অনেক সময় উপর মহলের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে দেন। ঢাকা থেকে মানিকগঞ্জ পর্যন্ত গাড়ি চালানো রমজান মিয়া বলেন, 'আমরা তো শুধু চাকুরিজীবী। বাসের যত্ন-রক্ষণাবেক্ষণ আমরা করি না। আমার বাসের বয়সও জানি না। আমার কাজ শুধু চালানো, গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব মালিকদের।'
সরকার বলছে, তারা সাধারণ মানুষের ভোগান্তি এড়াতে চায়, কিন্তু ক্যাম্পেইন থেকে সরে আসবে না। উপদেষ্টা ফাওজুল করিম বলেন, 'বাস্তবতা হলো পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা এই উদ্যোগের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। সমস্যা সমাধানে আলাপ-আলোচনা করব, তবে মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি সড়কে থাকতে পারবে না।'
বিআরটিএ জানিয়েছে, ক্যাম্পেইন দিনের আলোয় সীমাবদ্ধ থাকবে না; ধীরে ধীরে সব থেকে পুরোনো গাড়িগুলো লক্ষ্যবস্তু হবে। কিন্তু মালিকরা বলছেন, নতুন নিয়মে তাদের বেশিরভাগ গাড়ি চলে যাবে, তাই রাজধানী ও দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিবহন ধর্মঘটের হুমকি দেখা দিয়েছে।
এখন আলোচনায় রয়েছে জনসাধারণের নিরাপত্তা বনাম অর্থনৈতিক ও পরিচালনাগত সমস্যা নিয়ে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের সাইদুর বলেন, মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি চালানো 'পরিবহন সমস্যা নয়, এটি জীবন ও মৃত্যুর প্রশ্ন'।