ঢাকার ৯৮ শতাংশ শিশুর রক্তে সীসার মাত্রা অতিরিক্ত: আইসিডিডিআর,বি

ঢাকার ৯৮ শতাংশ শিশুর রক্তে অতিরিক্ত সীসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে—যা জনস্বাস্থ্যের জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয় বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি)।
গবেষণা অনুযায়ী, শিশুদের রক্তে সীসার গড় মাত্রা ছিল ৬৭ মাইক্রোগ্রাম প্রতি লিটার, যা যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) নির্ধারিত ৩৫ মাইক্রোগ্রাম/লিটার রেফারেন্স সীমার চেয়ে অনেক বেশি।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় বসবাসকারী শিশুদের রক্তে সীসার মাত্রা তুলনামূলকভাবে বেশি পাওয়া গেছে। আইসিডিডিআর,বি জানিয়েছে, ওই এলাকায় ব্যাটারি তৈরির কারখানা ও পুনর্ব্যবহার কেন্দ্র বেশি হওয়ায় এই মাত্রা বেশি হতে পারে।
আইসিডিডিআর,বি'র সহকারী বিজ্ঞানী ডা. জেসমিন সুলতানা বুধবার (৬ আগস্ট) সংস্থাটির কার্যালয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে গবেষণার এই চিত্র তুলে ধরেন। 'লিড পয়জনিং ইন বাংলাদেশে — প্রোগ্রেস মেড চ্যালেঞ্জের অ্যাহেড' শীর্ষক ওই অনুষ্ঠানে জানানো হয়, ২০২২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ঢাকায় ২ থেকে ৪ বছর বয়সী ৫০০ শিশুকে নিয়ে এই গবেষণা করা হয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, সীসা-ভিত্তিক শিল্পকারখানার এক কিলোমিটারের মধ্যে বসবাসকারী শিশুদের রক্তে প্রতিকেজি শরীরের ওজনে সীসার পরিমাণ গড়ে ৫ মাইক্রোগ্রাম বেশি—যা ৫ কিলোমিটার দূরে বসবাসকারী শিশুদের তুলনায় প্রায় ৪০ শতাংশ বেশি।
ডা. জেসমিন আরও বলেন, সীসা দূষণের অন্যান্য উৎসের মধ্যে রয়েছে ঘরের ধুলাবালি, সীসা-যুক্ত প্রসাধনী ও রান্নার বাসনপত্র।
ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, সীসা দূষণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের চতুর্থ সর্বোচ্চ ক্ষতিগ্রস্ত দেশ। বর্তমানে ৩ কোটি ৬০ লাখ শিশুর রক্তে সীসার মাত্রা উদ্বেগজনক হারে বেশি।
অনুষ্ঠানে উপস্থাপিত আরেকটি গবেষণায় বলা হয়, ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ঢাকার বস্তিগুলোতে ২ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে ৮৭ শতাংশের রক্তে সীসার মাত্রা ছিল ৫০ মাইক্রোগ্রামের বেশি, যা খর্বাকৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত।
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ও আইসিডিডিআরবি'র সাবেক পরিচালক স্টিভ লুবি বলেন, সীসা শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে। এতে বুদ্ধিমত্তার হ্রাস ও মানসিক দক্ষতার ঘাটতি তৈরি হয়, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে স্থায়ীভাবে প্রভাবিত করতে পারে।
তিনি বলেন, "আমাদের শ্বাসপ্রশ্বাস, খাদ্যগ্রহণ, দূষিত মাটি বা ধুলার সংস্পর্শ এবং এমনকি গর্ভকালীন সময়ে প্ল্যাসেন্টার মাধ্যমে শরীরে নানা উপায়ে সীসা প্রবেশ করে। পরিবেশ থেকে এই মূল কারণগুলো দূর করা না গেলে এসব দূষণ এড়ানো প্রায় অসম্ভব।"
শিশুর দেহে সীসার প্রভাব
রক্তে অতিরিক্ত মাত্রায় সীসার কারণে শিশুদের মাঝে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি, শেখার সমস্যা, বুদ্ধিমত্তা হ্রাস, আচরণগত সমস্যা, শ্রবণশক্তি কমে যাওয়া, হাড় ও পেশির বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়া, কিডনির ক্ষতি এবং রক্তশূন্যতা দেখা দিতে পারে।
আইসিডিডিআরবি'র নির্বাহী পরিচালক ডা. তাহমিদ আহমেদ বলেন, "সীসা বিষক্রিয়া নীরবে শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশ ও পুষ্টি ধ্বংস করে। এই ঝুঁকির উৎসগুলো নির্মূল করতে আমাদের অবশ্যই দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে, যেন প্রতিটি শিশু সুস্থ, বুদ্ধিদীপ্ত ও দেশের জন্য উপযোগী নাগরিক হিসেবে বেড়ে উঠতে পারে।"
শিশুদের সুরক্ষায় করণীয়
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, ঢাকার যেসব শিল্পকারখানা থেকে বিষাক্ত সীসা নির্গত হচ্ছে, সেগুলো অবিলম্বে বন্ধ বা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত করা জরুরি। এসব উৎস থেকে হাজার হাজার শিশু মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে।
তারা নিরাপদ বিকল্প হিসেবে নিকেল-জিংক, লিথিয়াম-আয়ন ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিসম্পন্ন সীসা-মুক্ত ব্যাটারির ব্যবহার প্রচলনের পরামর্শ দিয়েছেন। একইসঙ্গে সীসা-মুক্ত রং, রান্নার বাসন, গহনা, সুরমা ও তাবিজ ব্যবহারে উৎসাহিত করার ওপর জোর দিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, ঘরের ভেতরে ধূমপান বন্ধ করা ও নিয়মিত পানি দিয়ে মেঝে পরিষ্কার করার অভ্যাস গড়ে তুললে সীসা-দূষিত ধুলার ঝুঁকি কমানো সম্ভব।
উদাহরণে আশার আলো
আইসিডিডিআরবি'র প্রকল্প সমন্বয়কারী মো. মাহবুবুর রহমান সীসা-সংক্রান্ত এক দশকের গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেন। তার মতে, এখন পর্যন্ত সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপগুলোর একটি ছিল হলুদে ভেজাল সীসা শনাক্ত করে তা বন্ধের উদ্যোগ।
গবেষণার পর বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম, কঠোর নজরদারি ও বিধিনিষেধ আরোপসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এর ফলে ২০১৯ সালে যেখানে ৪৭ শতাংশ হলুদের নমুনায় সীসা পাওয়া গিয়েছিল, ২০২১ সালের মধ্যে তা প্রায় শূন্যে নেমে আসে।