মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ: শেখ হাসিনার পতনের এক বছর, উদযাপনের জোয়ারে ভাসছে জাতি

সময় তখন দুপুর ২টা ২৫ মিনিট। শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পালানোর প্রথম বার্ষিকী উপলক্ষে জাতীয় সংসদের সামনে মানিক মিয়া এভিনিউতে জড়ো হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। ঠিক এক বছর আগে, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মুখে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে গিয়েছিলেন হাসিনা। সেই মুহূর্তটি জাতির সম্মিলিত স্মৃতিতে গভীরভাবে গেঁথে আছে।
চারদিক ছিল উদ্দীপনায় ভরপুর। হাজারো মানুষ চিৎকার করছিল, স্লোগান দিচ্ছিল, এবং আকাশে উড়ছিল বেলুন। সবাই অপেক্ষা করছিল ঠিক সেই মুহূর্তের—যখন হাসিনা একটি সামরিক হেলিকপ্টারে উঠে পালিয়ে যান। আকাশ ছিল বৃষ্টিস্নাত, যা গত বছরের গণঅভ্যুত্থানের সময়কার বর্ষার প্রবল বর্ষণের কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছিল। গত বছর বৃষ্টি আর রক্তে ভেজা সেই দিনটি এখন উদযাপিত হচ্ছে আনন্দ আর উচ্ছ্বাসের সাথে। আজ পরিস্থিতি ভিন্ন, এটি স্বাধীনতার এক উদযাপন, সম্মিলিত স্বস্তি আর নতুন আশার দিন।
রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে পতাকা বিক্রি করছিলেন মনিরা বেগম। তিনি জানান, নানা ধরনের পতাকা পাওয়া গেলেও বাংলাদেশের পতাকার গর্বের সাথে কিছুর তুলনা হয় না। হাজারো মানুষ বৃষ্টি উপেক্ষা করে পরিবার-পরিজন নিয়ে এসেছিলেন। ছোট ছেলে-মেয়েদের হাতে ছিল পতাকা, মুখে ছিল রঙ মাখা আর বুকে ছিল অপার আশা।
ঠিক ২টা ২৫ মিনিটে মঞ্চ থেকে এক পরিচিত স্লোগান ছড়িয়ে পড়ে জনতার মাঝে: 'পলাইছে রে, পলাইছে! শেখ হাসিনা পলাইছে!' এই স্লোগানটি প্রথম ধ্বনিত হয়েছিল ২০২৪ সালে, যখন হাসিনার দেশত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়ে। এখন তা পরিণত হয়েছে বিজয়ের গানে, যা অন্য যেকোনো কিছুর চেয়ে বেশি উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছে মানুষের মধ্যে।
এই স্লোগানে কণ্ঠ মিলিয়েছিলেন শ্যামলীর সাগরও। তিনি বললেন, 'আজকের এই অনুভূতি অন্যরকম। এই দিনেই আমরা এক দমনমূলক শাসনের হাত থেকে স্বাধীনতা ফিরে পেয়েছিলাম। আমরা স্বাধীনই থাকব। শাসক যতই শক্তিশালী হোক না কেন, আমরা রুখে দাঁড়াব, ফ্যাসিবাদ আর স্বৈরতন্ত্রকে পরাজিত করব। হাসিনার মতো কেউ আর আমাদের সামনে দাঁড়াতে পারবে না।'
তার পাশেই ছিলেন নারায়ণগঞ্জের রফিক, যিনি অনেক দূর পাড়ি দিয়ে এসেছেন এই উৎসবে অংশ নিতে। তিনি বললেন, 'এই উদযাপন আমাদের ঐক্যের প্রতীক। যদি সেই পতিত শাসনের ছায়া আবার ফিরে আসে, আমি ২০২৪ সালের মতোই জনগণের পাশে দাঁড়াব।'
এই স্মরণোৎসবে একটি চোখে পড়ার মতো দৃশ্য ছিল—শতাধিক প্রতীকী সামরিক হেলিকপ্টার-আকৃতির বেলুন আকাশে ওড়ানো। আয়োজকরা জানান, এগুলো শেখ হাসিনার পালানোর প্রতীক, যা এক অন্ধকার মুহূর্তকে বিজয়ের চিত্রে রূপ দিয়েছে। উচ্ছ্বসিত জনতা চিৎকারে ফেটে পড়ে, তাদের উল্লাস মিশে যায় বর্ষার কুয়াশাচ্ছন্ন বাতাসে।
তবে এই উৎসবে সাময়িক ছন্দপতন ঘটে যখন আশপাশে উড়তে থাকা কিছু রঙিন ধোঁয়ার ফলে দুর্ঘটনাবশত একটি বেলুনে আগুন ধরে যায়। জ্বলন্ত বেলুনটি উপরের বৈদ্যুতিক তারে আটকে যায়, ফলে কিছুটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং সেখানে স্ফুলিঙ্গ দেখা যায়। স্বেচ্ছাসেবকেরা দ্রুত আগুন নিভিয়ে ফেলায় এই বিঘ্ন মাত্র কয়েক মিনিট স্থায়ী হয়। এরপর অনুষ্ঠান আগের উদ্দীপনাতেই চলতে থাকে।
এই দিনের উৎসবে সংগীত ছিল অন্যতম প্রধান উপাদান। উঠতি হিপ-হপ ব্যান্ড চিটাগাং হিপ-হপ ফুড মঞ্চে উঠে পরিবেশন করে সেইসব গান, যা বিদ্রোহের দিনগুলোতে সাহস জুগিয়েছিল মানুষকে। 'কথা ক' ও 'আওয়াজ উঠা বাংলাদেশ'—এই গানগুলো দমন-পীড়নের অন্ধকার সময়ে হয়ে উঠেছিল প্রতিরোধের সঙ্গীত।
তাদের আরেকটি গান, যা জনপ্রিয় স্লোগান 'চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার'-এর অনুকরণে তৈরি। এটি সরাসরি শেখ হাসিনার সেই বিতর্কিত মন্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়, যেখানে তিনি আন্দোলনকারীদের 'রাজাকার' বলে আখ্যা দিয়েছিলেন, যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি গালিগালের সমতুল্য।
এই ব্যান্ডের তীব্র সতেজ পারফরম্যান্স জনতাকে উত্তেজনায় উদ্বেলিত করে তোলে এবং প্রমাণ করে, হিপ-হপ এখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিসরে দৃঢ়ভাবে জায়গা করে নিয়েছে।
এরপর মঞ্চে ওঠেন বাংলাদেশের জনপ্রিয় র্যাপার সেজান, যার গান 'কথা ক' জুলাই অভ্যুত্থানের আইকনিক গান হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তিনি মঞ্চে উঠলে জনতা তার নাম ধরে স্লোগানে দেয়। 'কথা ক' এবং অন্যান্য জনপ্রিয় গান পরিবেশন করে সেজান সেই গানকে বিজয়ের আহ্বানে রূপ দেন—এক সময়কার গোপন প্রতিরোধের সুর এখন হয়ে উঠেছে জাতীয় গৌরবের প্রতীক।
মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ ছাড়িয়ে জনতা ছড়িয়ে পড়েছে খামারবাড়ি ও আশপাশের সড়কজুড়ে। পরিবার নিয়ে আরও মানুষ জড়ো হচ্ছেন, প্রত্যেকেই পতাকা হাতে গর্বে ভরা। উত্তরা থেকে আগত নোয়াখালীর জাহাঙ্গীর হোসেন তার ছেলে মারুফকে সঙ্গে নিয়ে উল্লাস প্রকাশ করছিলেন। তিনি বলেন, 'এই দিনই শেখ হাসিনার হাত থেকে আমরা মুক্তি পেয়েছিলাম। এই দিনটার মানে আমাদের জন্য অনেক বড়।'
তবে উৎসবের মাঝে দিনটির ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক তাৎপর্যও। খুব শিগগিরই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস জুলাই ঘোষণা পাঠ করবেন। এই আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি জুলাই অভ্যুত্থানকে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক মোড় ঘোরানো ঘটনা হিসেবে ঘোষণা করবে। এই ঘোষণা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়ায় রয়েছে, যাতে এই আন্দোলনের ত্যাগ ও বিজয়কে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্মরণ ও সম্মান জানানো হয়।
এই ঘোষণার অপেক্ষায় জনতা আপাতত সঙ্গীত উৎসব উপভোগ করছে।
এই সময় শূন্য ব্যান্ডের গানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন সন্তানদের নিয়ে আসা একজন মা, নাসিমা আকতার। তিনি বলেন, 'আজ আমরা উৎসব করছি। কিন্তু এটাই মনে করিয়ে দেয়, যতদিন বেঁচে থাকি—এই দেশ আর কখনও পরাধীন হবে না। কোনো শাসক, কোনো স্বৈরাচার, কোনো ফ্যাসিস্ট আর এদেশে মাথা তুলতে পারবে না। কেউ যদি শেখ হাসিনার মতো আবার আসতে চায়—যেকোনো দল থেকে হোক—আমরাই প্রতিরোধ করব। আবার রাস্তায় নামব, যেমনটা করেছিলাম ২০২৪-এ।'