সাংবিধানিক নয়, জুলাই সনদকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিতে চায় বিএনপি

জুলাই সনদকে সাংবিধানিক নয়, বরং রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে অবস্থান জানিয়েছে বিএনপি।
যদিও 'জুলাই সনদ' নামে পরিচিত সংস্কার প্রসঙ্গে জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশনের সংলাপে একমত হওয়ার বিষয়গুলোকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে চায় অন্তর্বর্তী সরকার। তবে জুলাই সনদকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে বিএনপি; একইভাবে জুলাই ঘোষণাপত্রকেও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিতে চায় দলটি। গত সোমবার রাতে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জুলাই সনদের একটি খসড়া ইতোমধ্যে বিএনপিসহ ৩৫টি রাজনৈতিক দল ও জোটের কাছে পাঠিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে ৫ আগস্টের আগেই সনদটি চূড়ান্ত করতে চায় সরকার।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, সেখানে ঐকমত্য কমিশনের সংলাপের বিষয়বস্তু তুলে ধরেন স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। সনদে বিগত ১৫ বছরে বিএনপির আন্দোলন, গুম-খুন, নির্যাতনের বিষয় উল্লেখ না থাকায় বৈঠকে অসন্তোষ প্রকাশ করেনদলের কয়েকজন নেতা।
তারা বলেন, সনদে একমাত্র 'চব্বিশের' জুলাই গণঅভ্যুত্থানকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অথচ শেখ হাসিনার শাসনামলে বিএনপির চার শতাধিক নেতা-কর্মী নিহত হয়েছেন, বহুজন গুম-খুনের শিকার হয়েছেন। বিএনপির দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায়ই এ গণঅভ্যুত্থান ঘটেছে, যা সনদে উপেক্ষিত। এমনকি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবদানও সেভাবে তুলে ধরা হয়নি। দলীয় নেতাদের অভিযোগ, সনদটি একপেশেভাবে তৈরি করা হয়েছে এবং শেখ হাসিনাকে নিয়েও কিছু বলা হয়নি।
জুলাই সনদ ছাড়াও সংস্কার কমিশনের অধীনে থাকা অমীমাংসিত কিছু বিষয় নিয়েও আলোচনা হয় বিএনপির বৈঠকে। এসবের মধ্যে রয়েছে সংসদে উচ্চকক্ষের নির্বাচন পদ্ধতি, নারী আসনে নির্বাচন পদ্ধতি, রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন এবং রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য স্থাপন, এবং জাতীয় সাংবিধানিক পরিষদ (এনসিনি) গঠন।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, এসব বিষয়ে বিএনপির আগের অবস্থানই বহাল রয়েছে। দলটি চায়, নিম্নকক্ষের আসন সংখ্যার অনুপাতে উচ্চকক্ষ এবং সংরক্ষিত নারী আসন বণ্টন হোক। তবে সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে বিএনপি। দলটির মতে, এটি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
এ বিষয়ে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, "নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহি সংসদের কাছে যেমন আছে, তেমনি জনগণের কাছেও আছে। কিন্তু কর্তৃত্ব না রেখে কেবল দায়িত্ব আর জবাবদিহি চাপিয়ে দিলে কার্যকর রাষ্ট্র পরিচালনা সম্ভব নয়। সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ক্ষেত্রে নির্বাহী বিভাগের হাত-পা বাঁধা হলে তা ভবিষ্যতে সমস্যার কারণ হতে পারে।"
গতকাল রাত ৯টার দিকে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপার্সনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলটির স্থায়ী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে লন্ডন থেকে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে সভাপতিত্ব করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমদ, বেগম সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, মেজর অব. হাফিজ উদ্দিন আহমেদ ও ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন।
এদিকে জুলাই সনদের খসড়াকে 'অসম্পূর্ণ' আখ্যা দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। নির্বাচিত সরকারকে দুই বছরের মধ্যে সনদ বাস্তবায়নের প্রস্তাবকে 'বিপজ্জনক' বলেও মন্তব্য করেছে দলটি।
মঙ্গলবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপের বিরতিতে জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, "সংলাপে যেসব বিষয়ে একমত হচ্ছি, সেগুলো বাস্তবায়নের আইনি ভিত্তি থাকতে হবে।"
তিনি দুটি বিকল্প পথের প্রস্তাব দেন—এক, অধ্যাদেশের মাধ্যমে একটি আইনি কাঠামো গঠন করে পরে তা নির্বাচিত পার্লামেন্টে অনুমোদন; দুই, গণভোটের মাধ্যমে জনগণের চূড়ান্ত অনুমোদন নেওয়া।
তাহের বলেন, "আমরা যেকোনো একটি পদ্ধতিতে এই কাঠামোকে আইনগত বৈধতা দিতে চাই। আমরা ঐকমত্যের পক্ষে, তবে তা হতে হবে কার্যকর এবং আইনি কাঠামোর মধ্যে। নইলে দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার দিকে যেতে পারে।"
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক জাভেদ রাসিন বলেন, আলোচনা থেকে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য তৈরি হচ্ছে, সেগুলো নির্বাচনের আগেই আইনি কাঠামোর মাধ্যমে বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা থাকতে হবে। এর ভিত্তিতেই পরবর্তী সংসদ নির্বাচন হতে হবে; না হলে এনসিপি জুলাই সনদ গ্রহণ করবে না।
তিনি আরও বলেন, "কমিশন ছয়টি সিদ্ধান্ত গ্রহণ পদ্ধতির কথা বললেও তা নিয়ে আলোচনা না করেই হঠাৎ করে জুলাই সনদের খসড়া প্রকাশ করেছে, যা গ্রহণযোগ্য নয়। সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা ছাড়াই খসড়া প্রকাশ করায় আমরা এর তীব্র বিরোধিতা করছি।"