অবশেষে ১৫ বছর পর টেকনাফে ৩০০ বছরের পুরোনো বৌদ্ধ বিহারের জমি উদ্ধার

নানা প্রক্রিয়ায় দখলদারদের থাবায় নিশ্চিহ্ন হওয়া কক্সবাজারের টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের বড় ক্যাং বা বৌদ্ধ বিহারের জমি উদ্ধার করে বিহার রক্ষা কমিটির কাছে বুঝিয়ে দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।
মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) সকাল ১০টায় স্থানীয় প্রশাসনের তৎপরতায় বিহারের মূল ফটকে তালা লাগিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বিহার রক্ষা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ক্যজঅং-এর কাছে চাবি হস্তান্তর করার তথ্য নিশ্চিত করেছেন ক্যজঅং নিজেই।
তিনি জানান, 'হ্নীলা ইউনিয়নের ভূমি কর্মকর্তা ও তহসিলদার মিসবাহ উদ্দিনের নেতৃত্বে অভিযানে উপস্থিত ছিলেন হ্নীলা ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ড ইউপি সদস্য রফিকুল ইসলাম, আদিবাসী ফোরাম কক্সবাজার জেলার সভাপতি থোয়াইঅং ও সাধারণ সম্পাদক মংথোয়াইহ্লা রাখাইনসহ স্থানীয় ভূমি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী, দফাদার, চৌকিদার ও বিহারের নিরাপত্তাকর্মীরা।'
তিনি আরও বলেন, 'পুরো বিহারভূমি ও শ্মশান পাহাড় পুনরুদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চলবে এবং দখলদারদের বিরুদ্ধে যথাযথ তদন্ত ও কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সম্মতিতে প্রবারণা পূর্ণিমা শেষে সীমা ঘরের সংস্কার ও পুনর্নির্মাণের কাজ শুরু হবে বলেও জানানো হয়েছে।'

প্রশাসনের এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে ক্যজঅং বলেন, ভবিষ্যতেও সংখ্যালঘু ধর্মীয় স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তা ও মর্যাদা রক্ষায় যথাযথ ভূমিকা রাখা হবে।
বিহার কমিটির দেওয়া তথ্যমতে, হ্নীলা ইউনিয়নের ক্যাংপাড়ায় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস ঘিরে যেখানে এক সময় ঐতিহ্যবাহী বড় ক্যাং বা বৌদ্ধ বিহার ছিল। গত ১৪ বছরে দখলদারদের থাবায় এটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এটি রক্ষায় ধারাবাহিক আন্দোলন চলে আসলেও কোনো কার্যত উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি বিগত সময়ে।
বিহার সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বিহারটির পুরোহিত উপিঞ ওয়াংশ মহাথেরো ২০০১ সালে উখিয়া-টেকনাফ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য (প্রয়াত) মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে একটি নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে চুক্তি করেন। যে চুক্তিতে বিহারের ২ একর জমিতে গাছ রোপণ করে লাভের অংশ ভাগ করার কথা রয়েছে।
একইভাবে ২০০৯ সালে বিহারের পুরোহিত উ কুশল্যা মহাথেরোর সঙ্গেও মোহাম্মদ আলী বিহারের অন্যান্য জমিতে গাছ রোপণের জন্য আরও একটি চুক্তি করেন।
এর মধ্যে ২০১০ সালের ২৬ আগস্ট বিহারটিতে মুখোশধারী কিছু ব্যক্তি হানা দেন। তারা বিহারের পুরোহিতকে হুমকি দিলে তিনি পালিয়ে যান। ওইদিন বিহারের গুরুত্বপূর্ণ কিছু মালামাল লুট হন। মূলত ওইদিন থেকে বিহারটি দখল বা নিশ্চিহ্ন হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এর মধ্যে বিহারের সঙ্গে উধাও হয়ে গেছে পল্লীটিও। বদলে গেছে গ্রামের নাম।

সূত্র মতে, গত ২০১২ সালের ২০ ডিসেম্বর টেকনাফ উপজেলার সহকারি কমিশনার (ভূমি) আবদুল্লাহ আল মামুনের একটি প্রতিবেদন ধরেই ৩১ দখলদারের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ মামলার দায়ের করেন। যে মামলায দখলদারদের উচ্ছেদের আদেশও দেওয়া হয়।
মামলার মতে, যেখানের ৩১ দখলদার হলেন- টেকনাফের হ্নীলা ইউপি চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী, ওসমান গনি, রহিমা খাতুন, আবদুস ছালাম, জহুরা খাতুন, হাসিনা খাতুন, নুরুল ইসলাম, আবদুল ওয়ারেছ, পেটান আলী, জলিল আহমদ, মো. কায়সার, আবুল কালাম, মকবুল হোসেন, বাদশা মিয়া, হাবিবুর রহমান, ওসমান সওদাগর, আবদুল্লাহ, কফিল আহমদ, মো. হাছন, ছৈয়দ হোছন, নবী হোছন, সোনা মিয়া, হাবিবুর রহমান, আবু ছিদ্দিক, ইসমাইল মিস্ত্রি, আবদুল গফুর, রশিদ আহমদ, মো. এলাহাত, মো. আলমগীর, খাইলুল বশর, বেলাল উদ্দিন।
বৌদ্ধবিহার রক্ষা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও আদিবাসী ফোরাম কক্সবাজার জেলা কমিটির সহসভাপতি ক্যজঅং বলেন, 'ওই সময়ের ৩১ দখলদারের সংখ্যা এখন ক্রমাগত বেড়েছে। গত ১৫ বছর ধরে সরকারের একাধিক তদন্ত কমিটি জমির ধরন ও পরিমাণ চিহ্নিত, সীমানা নির্ধারণ, সুনির্দিষ্ট দখলদারদের তালিকা করে তাদের উচ্ছেদ করার সুপারিশ করে।'

তিনি বলেন, 'তদন্তের আলোকে উচ্ছেদ করে বিহারের ভূমিটি পরিচালনা কমিটির কাছে হস্তান্তরে জেলা প্রশাসনের নির্দেশনা থাকলেও সংশ্লিষ্টদের কোনো পদক্ষেপ ছিল না। যেখানে একটি প্রভাবশালী পরিবার বিহারের গেট বন্ধ করে জায়গাটি দখলে রেখে অবৈধভাবে প্লট আকারে বিক্রি করেছে।'
তিনি আরও বলেন, 'এমনকি বিহার এলাকা ঘেঁষে থাকা শ্মশান পাহাড় কেটে নিচু জায়গা ভরাট করে সেখানে মহিলা উদ্যোক্তা বাজার, আইওএম অফিস ও বাঁশের গুদাম নির্মাণ করেছে। বিহারের ভিক্ষু ও উপাসকদের ওপর নির্যাতনের ঘটনাও ঘটেছে।'
১৫ বছর পর বিহারের জমি উদ্ধারের প্রথম পর্ব শুরু হলেও আরও অনেক কাজ বাকি আছে বলে জানান তিনি।
প্রসঙ্গত, এ সংক্রান্ত সচিত্র প্রতিবেদন একাধিকবার বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।