পণ্য বিক্রিতে সরকারি প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরতায় যেভাবে লোকসানে ডুবছে গাজী ওয়্যারস

সরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্রয়ের ওপর অধিক নির্ভরশীলতায় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কপার ওয়্যার প্রস্তুতকারী (তামার তার উৎপাদনকারী) প্রতিষ্ঠান গাজী ওয়্যারস লিমিটেড ক্রমাগত লোকসানে পড়ছে। বিশেষ করে বিগত ৪ বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (বিআরইবি) কাছ থেকে কোনো অর্ডার পাচ্ছে না, ফলে ক্ষতির পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলেছে।
বছর চারেক আগেও গাজী ওয়্যারস থেকে বছরে গড়ে ৫০০-৬০০ টন তার কিনত বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বিআরইবি)। তাদের চাহিদার ভিত্তিতে ৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ে গাজী ওয়্যারসের সক্ষমতা ৫০০ টন থেকে ২০২০ টনে উন্নীত করা হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক আর্থিক বিবরণীর তথ্যমতে, ২০১৪-১৫ থেকে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে যথাক্রমে ১১ কোটি ৯৮ লাখ, ১৫ কোটি ৮৮ লাখ, ১৬ কোটি ৪৩ লাখ, ৮ কোটি ৮৩ লাখ, ৮ কোটি ২৬ লাখ ও ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা মুনাফা হয়েছে।
সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে তার কিনেছিল বিআরইবি। ওই বছরও ৪ কোটি ৭২ লাখ টাকা মুনাফা হয়। বাড়তি দামের কারণ দেখিয়ে এরপর থেকে আর পণ্য কিনেনি। এরপর থেকে লোকাসানে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে গাজী ওয়্যারসের লোকসান একলাফে বেড়ে দাঁড়ায় ৫ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। সদ্য সমাপ্ত ২০২৪–২৫ অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত এই লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ কোটি ৪১ লাখ টাকা।
গাজী ওয়্যারস লিমিটেডের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবদুল হালিম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে (টিবিএস) বলেন, "রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে গাজী ওয়্যারস সবসময় সরকারি প্রতিষ্ঠান ও সাধারণ জনগণের কাছে মানসম্পন্ন পণ্য সরবরাহের লক্ষ্যেই কাজ করেছে। তবে বিগত কয়েক বছর ধরে বিআরইবি কোনো পণ্য না নেওয়ায় আমরা বড় ধরনের লোকসানে পড়েছি।"
তিনি আরও বলেন, "আমাদের কাঁচামাল আমদানির ব্যয় প্রতি কেজিতে প্রায় ১,৪০০ টাকা পড়ে। আমরা তা বিক্রি করি ১,৮৬০ টাকায়। অথচ দেশীয় কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিক্রি করে মাত্র ১,৬৬৫ টাকায়, আর ভারতীয় একটি প্রতিষ্ঠান বিক্রি করে ১,৯৩০ টাকায়। কিন্তু বিআরইবি দাবি করছে, তারা ১,২০০ টাকায় কিনতে পারছে। আমাদের পণ্য সম্পূর্ণ কাঁচামাল থেকে তৈরি, স্ক্র্যাপ দিয়ে নয়। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমরা স্ক্র্যাপ দিয়ে পণ্য তৈরি করতে পারি না। অথচ বাজারের অনেক পণ্য স্ক্র্যাপ থেকে তৈরি হওয়ায় কম দামে বিক্রি সম্ভব হচ্ছে। তারপরও আমরা যেসব পণ্য তৈরি করছি, তা বাজারের অন্য পণ্যের তুলনায় অনেক বেশি টেকসই।"
বিপণন কৌশলে দুর্বলতা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ব্যবসা প্রশাসন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তৈয়ব চৌধুরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "বাজারের বিদ্যমানের চেয়ে ভালো মানের পণ্য উৎপাদনের পরও প্রয়োজনীয় বিপণন নীতি ও কৌশল গ্রহণ না করায় সরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান লোকসানে ভরাডুবি খাচ্ছে। বর্তমনে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে করপোরেট সম্পর্ক স্থাপনসহ বিপণনের নানা কৌশল গ্রহণের মাধ্যমে ক্রেতাদের কাছে পৌঁছাতে হয়। সরকারি প্রতিষ্ঠানে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা রয়েছে। আর লোকসান হলেও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন সচল থাকায় গরজ থাকে না।"
"এ খাতে কোনো বাজেট থাকে না। গাজী ওয়্যারসসহ সব রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে সরকারের নতুনভাবে ভাবা উচিত," যোগ করেন তিনি।
একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে না কিনে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে কিনতে অনেক সময় কমিশন হিসেবে ঘুষ পাওয়া যায়। সরকারি প্রতিষ্ঠান আরেকটি সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য না কেনার এটি আরেকটি কারণ হতে পারে।"
প্রতিষ্ঠা ও বর্তমান অবস্থা
নথিপত্র অনুযায়ী, শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশন (বিএসইসি) নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান গাজী ওয়্যারস ১৯৬৫ সালে চট্টগ্রামের কালুরঘাট ভারী শিল্প এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ব্যক্তিমালিকানায় জাপানের ফুরুকাওয়া ইলেকট্রিক কোম্পানির সহায়তায় চালু হলেও, ১৯৭২ সালে জাতীয়করণের মাধ্যমে বিএসইসির সঙ্গে একীভূত করা হয় এবং পরবর্তীতে এটি বিএসইসির একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।
প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই গাজী ওয়্যারস বিদ্যুৎ ও জ্বালানিবিষয়ক সরকারি সংস্থাগুলোর চাহিদা পূরণে কাজ করে আসছে। শুরুতে এর বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৫০০ মেট্রিক টন। পরে চাহিদা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি নতুন প্ল্যান্ট চালু করা হয়, যার ফলে প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়ে ২,০২০ মেট্রিক টনে পৌঁছায়।
গাজী ওয়্যারস লিমিটেডের তথ্যমতে, বর্তমানে ৩ ধরনের তার উৎপাদন করছে গাজী ওয়্যারস। এগুলো হচ্ছে—সুপার এনামেল তামার তার (গেজ ১২ থেকে ৪৬), এনিল্ড তামার তার (গেজ ১০ থেকে ৪৬) ও হার্ডড্রন বেয়ার তামার তার (গেজ ১ থেকে ৪৬)।
এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি বিক্রি ও উৎপাদন হয় সুপার এনামেল তামার তার।
প্রতিষ্ঠানটিতে ১২৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিক কর্মরত রয়েছেন। মোট ৮০০ টন তার উৎপাদন করলে প্রতিষ্ঠানটির লোকসান হয় না। কিন্তু ২০২৩-২৪ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে ২৬৭ টন। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মাত্র ৮৭ টন। প্রতি কেজিতে উৎপাদন খরচ ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকার কাছাকাছি।
খাত সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, বাংলাদেশে তামার মূল চাহিদা বিভিন্ন গ্রেডের তার বা ওয়্যার তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। এসব তামার তার ট্রান্সফরমার, মোটর, ফ্যান ও বিভিন্ন যন্ত্রের কয়েল, বৈদ্যুতিক পাখাসহ বিভিন্ন ইলেকট্রিক পণ্য ও মেশিনারিজের কয়েল তৈরিতে ব্যবৃহত হয়। দেশে তামার তারের বাজার বছরে প্রায় ৩,০০০ টন।
দেশে গাজী ওয়্যারস ছাড়াও বিআরবি কেবলস, সুপার সাইনসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান তামার তার উৎপাদন করে। মূলত পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড, বিপিডিবি, ডেসকো, বিজেএমসি, উত্তরাঞ্চলের বরেন্দ্র বহুমুখী প্রকল্পের বিভিন্ন ক্ষমতার ট্রান্সফরমার ও মোটরের কয়েল সংযোজনে সুপার এনামেল কপার ওয়্যার ব্যবহৃত হয়।
এছাড়া দেশের বিভিন্ন ফ্যান, এসিসহ ইলেকট্রিক পণ্য উৎপাদনকারী কারখানাগুলো গাজী ওয়্যারস থেকে তামার তার ক্রয় করে।
বিশ্বব্যাপী তামার চাহিদা বাড়ছে
জলবায়ু পরিবর্তন রোধের অংশ হিসেবে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধিতে জোর দিচ্ছে বর্তমান বিশ্ব। ফলে এ খাতে অপরিহার্য ধাতু তামার চাহিদা বাড়ছে লাফিয়ে, কিন্তু বৈশ্বিক সরবরাহ সংকটে এ চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। সরবরাহ ও চাহিদার মধ্যে ক্রমবর্ধমান ব্যবধানে আকাশচুম্বী হয়ে উঠেছে দাম।
দুই বছরের মধ্যে তামার বৈশ্বিক দাম ৭৫ শতাংশেরও বেশি বাড়তে পারে বলে মনে করছেন বাজার পর্যবেক্ষরা।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে দেওয়া এক পূর্বাভাসে বাজার বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান ফিচ সলিউশনের গবেষণা ইউনিট বিএমআই জানায়, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ঊর্ধ্বমুখী লক্ষ্যমাত্রার কারণে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বজুড়ে অতিরিক্ত ৪২ লাখ টন তামার চাহিদা তৈরি হতে পারে। ফলে রেকর্ড মূল্য বৃদ্ধি পেতে পারে।
গাজী ওয়্যারসের এমডি মো. আবদুল হালিম বলেন, "বিআরইবি কর্তৃপক্ষ গত ২২ মে গাজী ওয়্যারস কারখানা পরিদর্শন করে পণ্যের মান দেখে সন্তুষ্ট হয়েছে। শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানী মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করা হচ্ছে। দ্রুত সমস্যার সমাধান হবে।"
"চট্টগ্রামের ক্রেতারা আমাদের পণ্য নিচ্ছেন। ঢাকায় বিস্তৃত বাজার আছে। আমরা চলতি মাস থেকেই বেসরকারি বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি," যোগ করেন তিনি।