পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সংখ্যা এখন গুরুত্বপূর্ণ, নতুন মিত্র খুঁজছে বিএনপি ও জামায়াত

প্রায় ২৪ বছর ধরে চলা বিএনপি ও জামায়াতের জোট শেষ হয়েছে, এবং এখন এই দুই দল একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী; বদলে যাওয়া রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তারা প্রত্যেকেই নতুন মিত্র খুঁজছে।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে উভয় দলই পৃথক জোট গঠন ও নতুন সমঝোতার মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে কাজ করছে।
যদিও এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক জোট বা নির্বাচনী সমঝোতা হয়নি, তবুও দল দুটি ছোট ছোট দলগুলোর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যোগাযোগ রাখছে অন্তত সংখ্যার দিক থেকে তাদের জোট বাড়াতে।
বিএনপি যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের পাশাপাশি ইসলামি দলগুলোর সঙ্গেও আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।
বিএনপির লিয়াঁজো কমিটি গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট এবং জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করছে।
তবে সম্প্রতি বিএনপি ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মধ্যে সম্পর্ক শীতল হয়ে উঠেছে, আর জামায়াত ও এনসিপির মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, "আমরা জোটবদ্ধ রাজনীতিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ—জোট থেকে সরে আসার কোনো প্রশ্নই আসে না। আমরা ৪২টি দল নিয়ে যুগপৎ আন্দোলন শুরু করেছিলাম, পরে আরও কিছু দল যুক্ত হয়ে এখন মোট দলসংখ্যা ৫০ থেকে ৫২টি হয়েছে।"
তিনি বলেন, "আমরা রাজনীতিতে সততা চাই। বিএনপি প্রতিদিন জাতীয় সরকার গঠনের কথা বলে। আমরা সেই লক্ষ্য পরিবর্তন করিনি। এই সব দল শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে সরাতে কঠোর সংগ্রাম করেছে। অনেকেই কারাবরণ করেছে, অনেক নেতা-কর্মী প্রাণ হারিয়েছেন। সবার চেষ্টা মূল্যায়ন করা উচিত। জাতীয় সরকারে সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।"
বিএনপি বলছে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হলে আনুষ্ঠানিক জোট গঠন নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
জনগণের ভোটে যদি বিএনপি ক্ষমতায় আসে, তাহলে শেখ হাসিনার বিরোধিতায় অংশ নেওয়া দলগুলোর সঙ্গে মিলেই জাতীয় সরকার গঠনের বিষয়ে তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ রয়েছে।
এদিকে ইসলামপন্থী ও মধ্যপন্থী দলগুলোকে একত্রিত করার চেষ্টা করছে জামায়াতে ইসলামি, যার লক্ষ্য নির্বাচনী জোটের মাধ্যমে ইসলামপন্থী ভোটকে এক প্ল্যাটফর্মে আনা। বাংলাদেশ ইসলামী আন্দোলনসহ অধিকাংশ ইসলামপন্থী দল এই ধারণাকে সমর্থন করেছে বলে জানা গেছে।
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের টিবিএসকে বলেন, "ইসলামপন্থী ভোট একত্র করার চিন্তাটা এখনো আলোচনা পর্যায়ে রয়েছে। কিছুই এখনো চূড়ান্ত হয়নি।"
তিনি বলেন, "আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ পরিকল্পনার জন্য নিয়মিত বৈঠক করছি। কিছু পরিবর্তনের প্রয়োজন এখনো রয়েছে। তবে আমরা আশা করছি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই সিদ্ধান্ত নিতে পারব।"
জামায়াত প্রথমবার ক্ষমতায় আসে ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বে গঠিত ১৯৯৯ সালের চারদলীয় জোটে যোগ দিয়ে। এই জোট সংসদে বড় ধরনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং জামায়াত দুটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রিসভা পদ—কৃষি ও শিল্প মন্ত্রণালয় পায়।
তবে, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের কাছে এই জোট বড় ব্যবধানে পরাজিত হয়।
২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল চারদলীয় জোট সম্প্রসারিত হয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিতে বিরোধী পক্ষের অবস্থান জোরদারে ১৮ দলীয় জোটে রূপান্তরিত হয়।
পরবর্তীতে আরও দল যোগ দিলে এটি ২০ দলীয় জোটে পরিণত হয়। এই জোট ২০২২ সালের ১২ ডিসেম্বর বিলুপ্ত হয়।
গত ১৯ জুলাই ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জামায়াত একটি বড় রাজনৈতিক সমাবেশ করে—যেখানে ১১টি ধর্মভিত্তিক ও মধ্যপন্থী দল অংশ নেয়। এর মধ্যে ছিল: এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস, হেফাজতে ইসলাম, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, গণ অধিকার পরিষদ, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা) এবং বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোট।
বিএনপির মিত্র এবং যুগপৎ আন্দোলনের শরিক হিসেবে পরিচিত জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা) এই সমাবেশে অংশ নেয়।
দলের সহ-সভাপতি ও মুখপাত্র রাশেদ প্রধান বলেন, "ফ্যাসিস্ট হাসিনার শাসনের বিরুদ্ধে আমরা বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনে ছিলাম, এখনও আছি।"
তিনি বলেন, "হাসিনার বিরোধিতা, ফ্যাসিবাদ আর ভারতীয় হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে যে দলই থাকবে, আমরা তাদের সঙ্গে থাকব—সেটা বিএনপি হোক বা জামায়াত, সেটা বিষয় না।"
তিনি আরও বলেন, "আমরা এখনো ঠিক করিনি, যৌথভাবে নির্বাচন করব নাকি এককভাবে। জোট বা আসন বণ্টন নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। জামায়াতের সমাবেশে যে সাত দফা দাবি তোলা হয়েছিল, আমরা তা সমর্থন করেছি—এই কারণেই আমরা সেই মঞ্চে অংশ নিয়েছি।"
জামায়াতের সমাবেশে জাগপার অংশগ্রহণের পর দলটিকে ১২ দলীয় জোট থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে বলে জানা গেছে। জোটের সমন্বয়ক সৈয়দ এহসানুল হুদা স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, দলটি দীর্ঘদিন ধরে অসহযোগিতা করে আসছিল এবং জোটের শৃঙ্খলা লঙ্ঘন করেছে।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) পরিচালিত এক সাম্প্রতিক জরিপে ১৫–৩৫ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যে ৩৮.৭৬ শতাংশ মনে করেন, আসন্ন নির্বাচনে বিএনপি সবচেয়ে বেশি ভোট পাবে; এরপর রয়েছে জামায়াত (২১.৪৫ শতাংশ) এবং এনসিপি (১৫.৮৪ শতাংশ)।
জরিপে আরও দেখা যায়, আওয়ামী লীগ যদি নির্বাচন করতে পারে, তাহলে তারা প্রায় ১৫ শতাংশ ভোট পেতে পারে। অন্যদিকে জাতীয় পার্টি ও অন্যান্য ইসলামি দলগুলো যথাক্রমে ৩.৭৭ শতাংশ ও ৪.৫৯ শতাংশ ভোট পেতে পারে।
এই জরিপে দেশের আটটি বিভাগের ২,০০০ জন অংশ নিয়েছিলেন।