এই মুহূর্তে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনই সবচেয়ে সঠিক পদ্ধতি: জামায়াতের সমাবেশে ডা. তাহের
পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনই হচ্ছে এই মুহূর্তে সবচেয়ে সঠিক পদ্ধতি বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের।
রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ করতে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করাসহ সাত দফা দাবিতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী আয়োজিত জাতীয় সমাবেশে তিনি এ মন্তব্য করেন।
ডা. তাহের বলেন, সংস্কার সবাই বলে মানি। কিন্তু যখন মিটিংয়ে বসে, তখন দেখি ভিন্ন মত। পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনই হচ্ছে এই মুহূর্তে সবচেয়ে সঠিক পদ্ধতি।
তিনি বলেন, আগামী নির্বাচনে জনগণ জিতবে। জনগণ যাদের ভোট দেবেন তারাই জিতবে। আজকের এই সমাবেশই প্রমাণ করে জনগণ জিতবে। জুলাই সনদ দিতে হবে এবং যারা নির্বাচনে জিতবে, তারা পার্লামেন্টে গিয়ে সেটি পূর্ণরূপ দেবেন।
সমাবেশ থেকে জুলাই হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচার ও জুলাই ঘোষণাপত্রের দাবি জানিয়েছে আন্দোলনে শহীদ ও আহতদের পরিবারের সদস্যরা।
আজ শনিবার (১৯ জুলাই) দুপুর ২টায় পবিত্র কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এ সমাবেশ শুরু হয়।
সমাবেশে সভাপতিত্ব করছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান।

জামায়াতের সেক্রেটারি মিয়া গোলাম পারওয়ার বলেন, আজকের এই জনসমুদ্র হচ্ছে বিগত বছরগুলোতে যে অন্যায় নিপীড়ন চালানো হয়েছে, তার প্রতিবাদী ঝড়। বাংলাদেশ সবচেয়ে বড় মজলুম দল হচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। আমরা আগামী নির্বাচন চাই পিআর ভিত্তিতে। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করে নির্বাচনের পথে হাঁটতে হবে।
জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির শহীদ মতিউর রহমান নিজামীর ছেলে ব্যারিস্টার নাজিবুর রহমান বলেন, 'ভারতীয় আধিপত্যবাদী শক্তি পরিকল্পনা করেছিল এদেশ থেকে জামায়াতকে তাড়িয়ে দেবে। আজ সেই ফ্যাসিবাদ কোথায় পালিয়েছে? এখন আমরা দেখছি সেই ফ্যাসিবাদ চোখ রাঙাচ্ছে। আমরা চাই দ্রুত বিচার শুরু হোক।'

ঢাকা মহানগর উত্তর জামায়াতের আমির সেলিম উদ্দিন বলেন, 'জামায়াতে ইসলামী যেনতেন নির্বাচনে বিশ্বাস করে না। এমন কোনো নির্বাচন চাই না যে নির্বাচন বাংলাদেশকে আরও ৫০ বছর পিছিয়ে যাবে। জামায়াত নির্বাচনকে ভয় পায় না। নির্বাচনে যদি কোনো পক্ষপাতিত্বের চেষ্টা করলে জুলাই আন্দোলনকারীরা মেনে নেবে না।'
ঢাকা দক্ষিণ জামায়াতের আমির নুরুল ইসলাম বুলবুল বলেন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড না হলে এদেশের মানুষ নির্বাচনে যাবে না। আমরা চাই পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন। পিআর পদ্ধতি ছাড়া কোনো উপায় নেই। জুলাই গণহত্যার বিচার দৃশ্যমান করতে হবে।'
দ্রুত বিচার, জুলাই ঘোষণাপত্রের দাবি জুলাই আন্দোলনে হতাহতদের পরিবারের
সমাবেশে 'জুলাই স্মৃতি পরিবার'-এর পক্ষে কথা বলেন আবুল হাসনাত, শহীদ শাহরিয়ার হাসান আবিদের বাবা।
তারা বলেন, বিচারের নামে আমাদের সাথে প্রহসন করা হচ্ছে, বিচারের নামে টালবাহানা করা হচ্ছে। আমরা বলি আমাদের সরকার কিন্তু জুলাই প্রক্লমেশন দিতে এক বছর লাগবে কেন? আপনারা জুলাইয়ের মধ্যেই জুলাই ঘোষণাপত্র দেবেন।
সাধারণ সম্পাদক গোবিন্দ চন্দ্র প্রামানিক বলেন, 'আমি বলব, আপনারা জামায়াতের সাথে আসেন। পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন দিতে হবে। জামায়াত একটি দল নয়, একটি বিশ্ববিদ্যালয়।'
শহীদ আবরার ফাহাদের বাবা বরকতউল্লাহ বলেন, 'গত ৫ বছরে আমি কোনো বিচার দেখতে পাইনি। আমার সন্তানের রক্ত যেন বৃথা না যায়।'
চট্টগ্রামের শহীদ ফয়সাল আলম শান্তর বাবা মোহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, 'আমি মোটেও বিচলিত নই। আমার সন্তান শহীদ হয়েছে—এজন্য আমি গর্বিত।'
শহীদ আবু সাঈদের বড় ভাই মো. রমজান আলী বলেন, 'গত কয়েক বছরে আমরা এমন সমাবেশ করতে পেরেছি? যদি দেশের সেই পরিবেশ ফিরে না পাই, তাহলে আমাদের ভাইদের ফিরিয়ে দিন। নির্বাচনের আগে আমাদের শহীদ ভাইদের ঘাতকদের বিচার চাই।'
দেশ থেকে এখনো মুজিববাদ বিদায় হয়নি, মুজিববাদের কোমর ভেঙে দিতে হবে: সারজিস
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম বলেন, অভ্যুত্থানের এক জুলাই পেরিয়ে আরেক জুলাইয়ে এসেছি। কিন্তু দেশ থেকে মুজিববাদ বিদায় হয়নি। এই মুজিববাদের কোমড় ভেঙে দিতে হবে। আমরা দেখেছি এখনও কীভাবে গোপালগঞ্জে মুজিববাদের শেকড় রয়ে গেছে। বাংলাদেশে বাংলাদেশপন্থী ব্যতীত অন্য কোনো দেশের আধিপত্য হতে দেওয়া হবে না।
তিনি বলেন, ৫ আগস্ট আমাদের যে মুক্তি হয়েছে, সেই মুক্তি জাগিয়ে রাখতে হবে। আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে অভ্যুত্থানপরবর্তী সরকারের ভূমিকা দেখতে চাই। খুনি হাসিনার বিরুদ্ধে রায়ের কার্যকর দেখতে চাই। আমরা এই দেশে কোনো দলীয়পন্থী বিচার ব্যবস্থা দেখতে চাই না। রাজনীতির প্রতিযোগিতা থাকবে, কিন্তু কোনো প্রতিহিংসা আমরা দেখতে চাই না।
দ্রুত জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার দৃশ্যমান করুন: আখতার হোসেন
এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, জুলাই সনদ ঘোষণা করতে হবে। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ইসলামি শক্তিসহ সব শক্তিকে অবস্থান নিতে হবে। আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বলব, আপনারা দ্রুত জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার দৃশ্যমান করুন। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করে নির্বাচনের পথে আগান।
দরকার হলে আবার লড়াই করব, কিন্তু এ দেশে আর কোনো ফ্যাসিবাদ গড়ে উঠতে দেব না: শিবির সভাপতি
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম বলেন, গত জুলাই ছিল প্রতিবাদ, প্রতিরোধের মাস। গণঅভ্যুত্থানের এক বছরেও কিন্তু আমরা এই সরকারের থেকে বিচার কাজের অগ্রগতি দেখতে পাচ্ছি না। বিগত ফ্যাসিবাদের আমলে বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনগুলোকে সন্ত্রাসের অভয়ারণ্যে পরিণত করা হয়েছিল। ছাত্রদের এখন প্রাণের দাবি, ছাত্র সংসদ নির্বাচন।
তিনি আরও বলেন, অনেক রক্ত আর ত্যাগের বিনিময়ে আমরা এই পর্যায়ে দাঁড়িয়েছি। দরকার হয় আবার লড়াই করবো, প্রাণ দেব, তবুও এদেশে কারও আধিপত্য চলবে না। কোনো ফ্যাসিবাদ গড়ে উঠতে দেবে না ইসলামী ছাত্রশিবির।
লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত না করে নির্বাচনের পথে হাঁটবেন না: সরকারকে নুরুল হক
গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, গত ১৬ বছর আল্লাহ আমাদের থেকে আল্লাহ ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়েছেন। সেখানে আমরা উত্তীর্ণ হতে পেরেছি। ফলে আমরা ৫ আগস্ট মুক্তি পেয়েছিলাম। কিন্তু আল্লাহ এটাও বলেছেন, তিনি সীমালঙ্ঘন করলে তাদেরও শাস্তি দেন।
তিনি বলেন, আমরা সরকারকে বলতে চাই, দেশের শাসনব্যবস্থা স্বচ্ছ ও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত না করে নির্বাচনের পথে হাঁটবেন না। আমরা বলতে চাই দ্রুত স্থানীয় সরকার নির্বাচন দেন। ডাকসুসহ সব ছাত্র সংসদের নির্বাচন দিতে হবে। আমরা সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জুলাই ঘোষণাপত্র ঘোষণা করতে চাই।
এদিকে, দুপুর ২টা থেকে সমাবেশ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও গতকাল শুক্রবার (১৮ জুলাই) সন্ধ্যা থেকেই উদ্যানে জড়ো হতে শুরু করেন জামায়াতের নেতা-কর্মীরা। তবে আজ ভোর থেকেই রাজধানীতে ঢল নামে দলটির নেতা-কর্মীদের।
দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে বাস, ট্রেন ও লঞ্চে করে রাজধানীতে এসে মিছিল সহকারে নেতা-কর্মীরা সমাবেশস্থলে প্রবেশ করেন। দাঁড়িপাল্লা ও দলীয় মনোগ্রাম সম্বলিত টি-শার্ট, পাঞ্জাবি পরে এসেছেন হাজার হাজার নেতা-কর্মী, অনেকের হাতে দলীয় প্রতীক দাাঁড়িপাল্লা দেখা গেছে।
পাশাপাশি, জাতীয় সমাবেশে যোগদানের জন্য জামায়াতকে রাজশাহী ও সিরাজগঞ্জ দুটি স্পেশাল ট্রেন বরাদ্দ দিয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। এছাড়া, চট্টগ্রাম থেকেও একটি স্পেশাল ট্রেন ভাড়া করেছে দলটি।
জামায়াত সূত্র জানিয়েছে, স্পেশাল ট্রেন ছাড়াও চট্টগ্রামের কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালী, চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকেও বাস ভাড়া নিয়ে নেতা-কর্মীরা ঢাকায় এসেছেন।

জামায়েতের সমাবেশকে ঘিরে রাজধানীর বিভিন্ন প্রবেশমুখ দিয়ে নেতা-কর্মীরা প্রবেশ করেন। শাহবাগ, মৎস্য ভবন মোড়, বাংলামোটর, কারওয়ান বাজারসহ আশপাশের এলাকায় নেতা-কর্মীদের উপস্থিতিতে সড়কে যান চলাচলে ধীর গতি দেখা গেছে। বেশিরভাগ জায়গায় সড়কের একটি অংশ যানবাহন চলাচলের জন্য ছেড়ে দিয়ে অন্য পাশ দিয়ে মিছিল নিয়ে সমাবেশের দিকে যেতে দেখা গেছে নেতা-কর্মীদের।

নেতাকর্মীরা বিভিন্ন স্লোগান নিয়ে সমাবেশ স্থলে যেতে দেখা যায়। স্লোগানের মধ্যে রয়েছে: 'কে বলেরে রাজাকার, সাঈদী মোদের অহংকার', 'দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা', 'বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ', 'মুজিদবাদ মুজিদবাদ, মুর্দাবাদ মুর্দাবাদ', 'জামায়াতে ইসলামীর বাংলায়, মুজিববাদের ঠাই নাই' ইত্যাদি।
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নেতা-কর্মীদের বহন করে নিয়ে আসা বাসগুলো মানিক মিয়া এভিনিউ, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, ইস্কাটন এলাকায় পার্কিং করতে দেখা গেছে।

জামায়াতের ৭ দফা দাবি
জামায়াতের সাত দফা দাবিগুলো হলো: অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা, সব গণহত্যার বিচার, প্রয়োজনীয় মৌলিক সংস্কার, 'জুলাই সনদ' ও ঘোষণাপত্র বাস্তবায়ন, জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের পরিবারের পুনর্বাসন, সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচন এবং এক কোটিরও বেশি প্রবাসী ভোটারদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা।
সমাবেশে যেসব দল অংশ নিয়েছে
জামায়াতের সমাবেশে অংশ নেওয়া দলগুলো হলো- জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণঅধিকার পরিষদ, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস, খেলাফত আন্দোলন, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা), জনতার অধিকার পার্টি। এছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি দলের নেতারা অংশগ্রহণ করেছেন।
তবে বিএনপি স্থায়ী কমিটি সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, জামায়াতে ইসলামীর সমাবেশে বিএনপি দাওয়াত পায়নি।