কুমিল্লায় গণপিটুনিতে নিহত তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ৩০টি

মাদক ও ছিনতাই নিয়ে সালিশের বিরোধ থেকে স্থানীয় চেয়ারম্যান এবং মেম্বারের গায়ে হাত তোলা নিয়ে কুমিল্লায় এক নারীসহ একই পরিবারের তিনজনকে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়েছে।
নিহতরা হলেন—কড়ইবাড়ি গ্রামের হাবিবুর রহমানের স্ত্রী রোকসানা বেগম রুবি (৪৭), রুবির মেয়ে তাসপিয়া আক্তার হ্যাপি ওরফে জোনাকি (২৯) ও রুবির ছেলে মো. রাসেল মিয়া (৪০)। এ ঘটনায় রুবির আরেক মেয়ে রুমা আক্তারকে (২৭) গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
নিহত জোনাকির স্বামী হায়দারাবাদ গ্রামের আবদুল হামিদের ছেলে মনির হোসেন। মনির হোসেন, নিহত তিনজন ও হাবিবুর রহমানের আরেক মেয়েসহ তাদের পরিবারের পাঁচ সদস্যের বিরুদ্ধে ৪৩টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে নিহত তিনজনের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা ৩০টি।
আজ বৃহস্পতিবার (৩ জুলাই) বিকেলে ওই বাড়িতে গিয়ে টিবিএসের প্রতিবেদক দেখেন, সাততলা ভবনের বেশিরভাগ জানালার কাচ ভাঙা। কিছু স্থানে ছোপছোপ রক্তের দাগ। বাড়ির আঙিনায় একটি মোটরসাইকেল ভাঙাচোরা অবস্থায় পড়ে আছে। বাইরে অসংখ্য মানুষের জটলা।
স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানান, দীর্ঘদিন ধরে শুনে আসছি এ পরিবার মাদকের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কমপক্ষে ৪০ বছর ধরে তারা মাদক ব্যবসা করছেন। অনেকবার শুনেছি, তাদের ক্রসফায়ার দেওয়া হবে। কিন্তু, তারা বারবার বেঁচে যায়। তারা সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত না হলেও—আওয়ামী লীগের রাজনীতি করা ব্যক্তিদের সাথে ওঠাবসা ছিল। সম্প্রতি এক স্কুল শিক্ষকের মোবাইল ছিনতাই হয়। ওই ছিনতাইকারীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিল রুবিদের পরিবারের। রুবিদের পরিবার ওই ছিনতাইকারীকে বাড়িতে আশ্রয়ও দেয়। গত মঙ্গলবার কড়ইবাড়ি গ্রামে এ ঘটনাসহ তাদের নানা অপকর্ম নিয়ে সালিশ হয়। সেখানে তাদের অপকর্মের বিষয়ে মানুষজন নানান অভিযোগ তোলেন। এ পরিবার মাদক ছড়িয়ে দেওয়ায় গ্রামের আটজন রিহ্যাব সেন্টারে আছেন বলে অভিযোগ করা হয়।
নাম না প্রকাশ শর্তে এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ঘটনাটি নিয়ে আমরা ভীষণরকম উদ্বিগ্ন। এভাবে আইন হাতে তুলে নেওয়ার ব্যাপারটি কাম্য নয়। তবে এ পরিবার মামলাবাজির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এলাকার মানুষ দীর্ঘদিন ধরে তাদের মামলা নিয়ে অতিষ্ঠ ছিল। তাদের বিরুদ্ধেও বেশকিছু মামলা রয়েছে। এসব কারণে এমন ঘটনা ঘটতে পারে। তবে আমরা বিষয়টি অধিকতর তদন্ত করে দেখছি। পরে বিস্তারিত বলা যাবে।

বৃহস্পতিবার সকালে হায়দারাবাদ-কড়ইবাড়ি সড়কের কাজ পরিদর্শনে আসেন আকুবপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাল। এসময় সালিশের ঘটনা নিয়ে শিমুল বিল্লাল ও স্থানীয় বাচ্চু মেম্বারের গায়ে আচমকা হাত তোলেন রোকসানা বেগম রুবি। স্থানীয়রা এর প্রতিবাদ করলে, রুবি নিজের হাত কেটে মামলার ভয় দেখান। এরপর পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে যায়।
নিহত রাসেলের স্ত্রী মীম আক্তার জানান, 'আমার ননদের দোকানে চাকরি করা এক যুবক মোবাইল চুরির অভিযোগে ধরা পড়ে। অভিযুক্তের বাবা এ ঘটনায় আমাদের বাড়িতে এসে বলেন, আমি একলাখ টাকা জরিমানা দেব। আমার স্বামী রাসেল যাতে বিষয়টি মীমাংসা করে দেন। গত পরশু বিষয়টি সুরাহার জন্য সবাই বসে। আমার শাশুড়ি বিষয়টি নিয়ে কথা বললে, স্থানীয় বাছিরের সঙ্গে ঝামেলা হয়। বাছির আমার শাশুড়ি ও ননদকে মারধর করে। এসময় তর্কাতর্কি ও ঝামেলার এক পর্যায়ে আমার এক বছরেরও কম বয়সী মেয়ের হাত বাড়ি দিয়ে ভেঙে দেয় তারা। আমার স্বামী তখন বাইরে ছিল। তিনি এটি জানতে পারার পর খুবই উত্তেজিত হয়ে যান। এনিয়ে খুব ঝামেলা হয়। তবে ওইদিন রাতের মধ্যে পরিস্থিতি শান্ত হয়ে যায়। কিন্তু বৃহস্পতিবার সকালে এক-দেড়শ লোক বাঁশ ও ছুরি নিয়ে হাজির হন। তারা প্রথমে ঘরের ভেতর ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করেন। এরপর ঘরে ঢুকে আমার শাশুড়িকে হত্যা করেন। ঘরের বাইরে নাশতার জন্য যাওয়া ননদকেও হত্যা করা হয়। এরপর আলমারিতে লুকিয়ে থাকা স্বামীকেও হত্যা করে তারা। আমার স্বামী ছোট সন্তানের জন্য বারবার প্রাণভিক্ষা চাইলেও লাভ হয়নি। এখনও পর্যন্ত আমার শ্বশুর নিখোঁজ। আমি এ ঘটনায় মামলা করব।'
কুমিল্লার পুলিশ সুপার নাজির আহমেদ খাঁন জানান, 'নিহতদের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। নিহতদের বিরুদ্ধে যতই অভিযোগ থাকুক, এভাবে কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নিতে পারেন না। যারা হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।'