গুমের শিকার ব্যক্তিদের জন্য ‘ন্যায়বিচার’ ছিল এক প্রকার শাস্তি: গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন

গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার শাসনামলে গুমের শিকার ব্যক্তিরা শুধু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হননি, বরং গুমের পরপরই দায়ের করা মিথ্যা ফৌজদারি মামলাগুলোর কারণে তারা চরম অর্থনৈতিক, মানসিক ও সামাজিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।
প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়েছে, ন্যায়বিচার পাওয়ার প্রক্রিয়ায় ভুক্তভোগীদের জন্য কোনো প্রতিকার বয়ে আনেনি। বরং এই দীর্ঘস্থায়ী বিচারিক প্রক্রিয়াটি তাদের জন্য হয়ে উঠেছে এক অনবরত যন্ত্রণা, ভয়ভীতি প্রদর্শন ও দারিদ্র্যের কারণ।
আইনি জটিলতার কারণে অর্থনৈতিক বিপর্যয়
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারগুলোকে একাধিক মামলায় মোকাবিলায় আইনি খরচ বাবদ বিপুল পরিমাণ টাকা ব্যয় করতে হয়েছে—অনেক সময় এটি ছিল তাদের দুই বছরের গড় পারিবারিক আয়ের চেয়েও বেশি।
কমিশনের ভাষ্যমতে, এই ব্যয়ের গড় মান ছিল ৭ লাখ টাকা—যা একটি গড় বাংলাদেশি পরিবারের বার্ষিক আয়ের দ্বিগুণেরও বেশি।
কমিশন বলছে, 'পরিবারগুলোকে সম্পদ বিক্রি করতে হয়েছে, অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎস থেকে ঋণ নিতে হয়েছে, কিংবা ক্রমবর্ধমান ঋণের নিচে জীবনযাপন করতে হয়েছে।'
তারা আরও বলেছে, 'এই ধরনের আর্থিক চাপ প্রাথমিক মানসিক আঘাতকে আরও গভীর করেছে এবং নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য নতুন ধরনের সংকট তৈরি করেছে।'
বারবার আদালতে হাজিরা ও মানসিক বিপর্যয়
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনেক ভুক্তভোগী—যাদের অনেকেই তখন তরুণ—বছরের পর বছর ধরে বিচার প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। নিয়মিত জামিন শর্তে তাদের বারবার আদালতে হাজিরা দিতে হয়েছে।
যেসব ক্ষেত্রে একাধিক মামলা ছিল, সেখানে ভুক্তভোগীদের মাসে বহুবার দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা আদালতগুলোতে যেতে হয়েছে।
এই বিচারপ্রক্রিয়াকে 'মিথ্যা ও শাস্তিমূলক' হিসেবে বর্ণনা করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এটি ভুক্তভোগীদের ওপর 'অমানবিক মানসিক চাপ ও শারীরিক ক্লান্তি' চাপিয়ে দিয়েছে।
ন্যায়বিচার দেওয়ার বদলে এই প্রক্রিয়াটি যেন এক দীর্ঘমেয়াদি শাস্তিতে রূপ নিয়েছিল।
মানসিক আঘাত, বিপর্যস্ত জীবন ও দীর্ঘমেয়াদি ভোগান্তি
আদালতের প্রক্রিয়ার বাইরেও, গুমের শিকার ব্যক্তিরা দীর্ঘস্থায়ী মানসিক প্রভাবের মধ্যে দিয়ে গেছেন। এর জন্য অনেকেরই দীর্ঘমেয়াদে চিকিৎসা ও মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তার প্রয়োজন পড়েছে।
কমিশন এক হৃদয়বিদারক ঘটনার উল্লেখ করেছে, যেখানে এক কিশোরকে গুম করে দীর্ঘক্ষণ আটকে রাখাসহ কারাবাস এবং স্পষ্ট নির্যাতনের শিকার হয়েছিল।
তার অপহরণের সময় সে মাত্র নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছিল। এরপর টানা চার বছর তাকে গোপনে আটকে রাখা হয় এবং পরে কারাগারে পাঠানো হয়। সে মুক্তি পায় চরম মানসিক সমস্যাসহ, যা তার জীবনকে মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে।
স্মৃতিতে ভেসে ওঠে তার কান্না ও নির্যাতনের দৃশ্য
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আটক অবস্থায় ছেলেটির নিরবচ্ছিন্ন কান্না ও নির্যাতনের দৃশ্য এখনো মনে রেখেছেন অনেক প্রত্যক্ষদর্শী। বিভিন্ন গোপন বন্দিশিবির থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত একাধিক ব্যক্তি তাকে শনাক্ত করেন। তবে তার পরিচয় নিশ্চিত করতে অনেক বছর ধরে ধৈর্য নিয়ে তদন্ত করতে হয়।
পরবর্তীতে তাকে একটি সাইকেল মেরামতের দোকানে খুঁজে পাওয়া যায়, যেখানে সে মানসিকভাবে ভেঙে পড়া অবস্থায় তার বাবার সঙ্গে থাকছিল।
সে আর পড়াশোনায় ফিরে যেতে পারেনি। পরিবারটি গভীর দারিদ্র্যের সঙ্গে বসবাস করছে এবং মুক্তির পর শুরু হওয়া জটিল আইনি লড়াইয়ে এখনো তারা বিভ্রান্ত ও ক্লান্ত।
ন্যায়বিচারের নামে আরও যন্ত্রণা
কমিশন তার প্রতিবেদনে উপসংহার টেনে বলেছে, গুম সংক্রান্ত মামলাগুলোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় কোনো প্রতিকার নয়, বরং এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি শাস্তিমূলক প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়েছে।
গুম হওয়ার মুহূর্ত থেকে শুরু করে বছরের পর বছর ধরে চলা মামলার শুনানি ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়—পুরো প্রক্রিয়াটি বারবার আগের ক্ষতিকে পুনরায় উসকে দিয়েছে এবং আরও গভীর করেছে।
কমিশন বলছে, 'প্রতিকার দেওয়ার বদলে বিচার প্রক্রিয়াই অনেক সময় নতুন করে ভোগান্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে।'
এই পর্যবেক্ষণগুলো বিচারব্যবস্থার কাঠামোগত সংস্কার, ভুক্তভোগীদের জন্য সহায়তা এবং রাজনৈতিক স্বার্থে আইনি প্রতিষ্ঠানের অপব্যবহার রোধে কার্যকর নিরাপত্তা ব্যবস্থার জরুরি প্রয়োজনীয়তাকে সামনে নিয়ে এসেছে।