তারেক-ইউনূস বৈঠকে ডিসেম্বরে ভোটের দাবিই হবে মুখ্য, বলছেন বিএনপি নেতারা

নির্বাচনের সময়সূচি নিয়ে সম্প্রতি বিএনপি ও অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে টানাপোড়েন স্পষ্ট হলেও, এখন রাজনৈতিক মহলের সকলের দৃষ্টি লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকের দিকে।
আগামীকাল ১৩ জুন লন্ডনের ডরচেস্টার হোটেলে সকাল ৯টা থেকে ১১টা পর্যন্ত নির্ধারিত তারেক রহমান ও ড. ইউনূসের একান্ত বৈঠক ঘিরে দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মধ্যেও আগ্রহ তুঙ্গে। বিএনপি নেতাদের মতে, এ বৈঠকে এপ্রিলের বদলে ডিসেম্বরে নির্বাচন আয়োজনের বিষয়টিই প্রাধান্য পাবে।
প্রধান উপদেষ্টা সম্প্রতি জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে জানিয়েছেন, আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধে ১৩তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ঘোষণার পর থেকেই বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারকে এই সময়সীমা পুনর্বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়ে আসছে।
বিএনপি ও তাদের সমমনা প্রায় ৩০টি দল যুক্তি দিয়েছে, রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এপ্রিল মাস নির্বাচন আয়োজনের উপযুক্ত সময় নয়। তারা বলছে, এই সময়ের আগে রয়েছে পাবলিক পরীক্ষা ও রমজান, আর এপ্রিল মাসে বিরূপ আবহাওয়ার কারণেও নির্বাচন আয়োজন কঠিন হতে পারে। সব মিলিয়ে ওই সময়ে নির্বাচন করলে অংশগ্রহণমূলক পরিবেশ তৈরি হবে না বলে মনে করছে দলগুলো।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় বাস্তবতা বিবেচনায় জাতীয় নির্বাচনের জন্য এপ্রিল মাস উপযুক্ত নয়।'
তিনি বলেন, বিএনপি চায় দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের সম্মিলিত মতামতের ভিত্তিতে নির্বাচন ডিসেম্বরের আগেই অনুষ্ঠিত হোক। আশা করা যায়, বর্তমান সরকার বিএনপির এই যৌক্তিক বিষয়ে বিবেচনা করবে।'
বিএনপির অভ্যন্তরীণ সূত্র বলছে, ১৩ জুন হতে যাওয়া তারেক-ইউনূস বৈঠকটি নির্বাচন-সংক্রান্ত অচলাবস্থা দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বৈঠকে মূলত এপ্রিলের পরিবর্তে নির্বাচন এগিয়ে এনে ডিসেম্বর বা আপসমূলক সময়সীমা নির্ধারণের ওপরই জোর দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন নেতারা।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বার্তাসংস্থা ইউএনবিকে বলেন, 'তারেক রহমান বৈঠকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরবেন কেন এপ্রিল উপযুক্ত নয় এবং কেন ডিসেম্বরই শ্রেয়। তবে প্রধান উপদেষ্টা যদি ফেব্রুয়ারি প্রস্তাব করেন, তাহলে আলোচনার জায়গা থাকতে পারে।'
তারেক-ইউনূস বৈঠকে ডিসেম্বর নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই আলোচনা হবে—এমনটা ইউএনবিকে জানিয়েছেন বিএনপির অন্য কয়েক শীর্ষ নেতাও।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, 'আমরা আশা করি, এই বৈঠক ইতিবাচক রাজনৈতিক অগ্রগতির পথ দেখাবে এবং একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সুযোগ তৈরি করবে।'
তিনি বলেন, 'নির্বাচনই হবে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দলের অবস্থান তুলে ধরবেন। ডিসেম্বর নির্বাচনের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময়।'
তবে যদি রমজান, পরীক্ষাসহ আবহাওয়ার বিষয় বিবেচনায় নিয়ে ফেব্রুয়ারি নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব আসে, বিএনপি কি সেটি বিবেচনায় নেবে—এ প্রশ্নের জবাবে মোশাররফ বলেন, 'দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্ণ ক্ষমতা তারেক রহমানের ওপরই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।'
বিএনপির আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মোয়াজ্জেম হোসেন আলমগীর বলেন, 'অন্তর্বর্তী সরকার হয়তো তাদের আগের অনড় অবস্থান থেকে একটু হলেও সরে এসেছে। তারা হয়তো বুঝছে যে, বিরোধ নয়—সমঝোতার মাধ্যমেই সমাধান সম্ভব।'
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তারেক রহমানের বৈঠক শুধু সময়োপযোগী নয়, এটি রাজনৈতিক শিষ্টাচারও।
তিনি বলেন, 'এই আলোচনার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলা এবং দুই পক্ষের মধ্যকার দূরত্ব কমানো সম্ভব হতে পারে।'
ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা, নির্বাচন আয়োজন, নিরপেক্ষতা এবং আইনের শাসন—এসব বিষয় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হবে বলেও মন্তব্য করেন সালাহউদ্দিন।
তিনি আরও বলেন, 'আলোচনার মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা যদি নির্বাচনের সময়সূচি পুনর্বিবেচনা করেন, সেটি হবে বাস্তবতানির্ভর একটি সিদ্ধান্ত।'
তিনি জানান, বিএনপি সবসময় আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান চায় এবং এই বৈঠক শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথ দেখাতে পারে।
এদিকে গতকাল বিএনপির নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক ব্রিফিংয়ে দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীও ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে বিএনপির অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, তার দল ইতোমধ্যেই এই সময়সীমার জন্য যৌক্তিক কারণ তুলে ধরেছে।
রিজভী বলেন, 'দেশের জনগণও ডিসেম্বরকে নির্বাচনের জন্য যৌক্তিক সময় বলে মনে করে। আলোচনা চলছে... আমরা পরে ফলাফল জানতে পারব।'
এপ্রিলে নির্বাচনের তারিখ সঠিক নয় মন্তব্য করেন বিএনপি মহাসচিবও। মঙ্গলবার সাংবাদিকদের তিনি বলেন, 'আমরা আশা করছি, বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার এটা বিবেচনা করবেন। সময়টা তো ঠিক না। আমি প্রথম দিনই বলেছি, টাইম (এপ্রিল) ইজ নট গুড ফর ইলেকশন। রোজার মাস, রোজা শেষ হবে, ঈদ শেষ হবে– তার কয়েকদিন পরেই নির্বাচন। আপনি ভাবেন গোটা রোজার মাসটা ক্যান্ডিডেটদের কী অবস্থা হবে, পলিটিক্যাল ওয়ার্কারদের কী অবস্থা হবে।'
রোজার সময় নির্বাচনি প্রচারণা চালাতে প্রার্থী ও রাজনৈতিক কর্মীদের দুর্ভোগ হবে এমনটা জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, আমি তো এখন থেকেই উদ্বিগ্ন যে আমাকে প্রতিদিনই ইফতার পার্টি করতে হবে। এতে নির্বাচনের ব্যয়টাও দ্বিগুণ হয়ে যাবে। গরমে দিনের বেলায় জনসভায় লোকজন কীভাবে আসবে। রাত্রে গিয়ে মিটিং করতে হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'নির্বাচনের তারিখ নিয়ে বিএনপির যে অবস্থান, সে বিষয়ে ফলপ্রসূ আলোচনা হবে। নতুন রাজনৈতিক চিন্তা সৃষ্টির ফলে সরকারে চাপ বা চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে। দুই নেতার বৈঠক একটা বড় সুযোগ অনেক সমস্যা সমাধান করার।'
তবে কেবল নির্বাচন নয়, আলোচনায় আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থান পেতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন বিএনপি নেতারা। এর মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক সংস্কার, জুলাই-আগস্ট গণআন্দোলনে হত্যাকাণ্ডের বিচার, শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর, অন্তর্বর্তী সরকারের নিরাপদ প্রস্থান এবং তারেক রহমানের দেশের ফেরার সম্ভাবনা।