ছাড়পত্র পেয়েও হাসপাতাল ছাড়ছেন না জুলাই আন্দোলনে আহতরা, ‘জিম্মি’ ৩ হাসপাতাল

জুলাই অভ্যুত্থানে আহত ও হাসপাতাল কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের পর গত ১৪ দিন ধরে দেশের একমাত্র বিশেষায়িত চক্ষু হাসপাতাল, জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল (এনআইওএইচ)-এ চিকিৎসাসেবা বন্ধ রয়েছে।
গত ২৮ মে থেকে হাসপাতালটিতে কেবল জুলাই আন্দোলনে আহতদেরই ভর্তি করা হয়েছে এবং তাদের জন্য খাবার সরবরাহ করছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। যদিও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় শনিবার থেকে হাসপাতালটি পূর্ণাঙ্গভাবে চালুর নির্দেশ দিয়েছে, তবুও স্বাভাবিক কার্যক্রম আদৌ শুরু হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে।
শুধু জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটই নয়, একই পরিস্থিতির মুখে পড়েছে আরও দুটি হাসপাতাল—বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) কেবিন ব্লক এবং জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (নিটোর) দুটি ওয়ার্ড।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, অনেক রোগী ছাড়পত্র পাওয়ার পরও হাসপাতাল ছাড়তে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন, ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যত 'জিম্মি' হয়ে পড়েছে।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে আন্দোলনের জেরে বিএমইউ-র পরিচালককে বদলি করা হয়, আর মার্চে নিটোরে আউটসোর্সিং কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে।
তিনটি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, জুলাই আন্দোলনে আহত ১,৪০০ জনের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। বর্তমানে প্রায় ২০০ জন এই তিন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।
এদের অধিকাংশেরই হাসপাতালে থাকার প্রয়োজন নেই। একাধিকবার ছাড়পত্র দেওয়া হলেও তারা হাসপাতালে রয়ে গেছেন। ঈদুল আজহার ছুটিতে যারা বাড়ি গিয়েছিলেন, তারাও আবার ফিরে আসতে চাচ্ছেন।
এই পরিস্থিতির ফলে সাধারণ রোগীরা হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন না। হাসপাতাল কর্মীদের অভিযোগ, আহতরা চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য কর্মীদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করছেন, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সমস্যার কথা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়েও সমাধান করতে পারছে না।
গত ৪ জুন দেশের শীর্ষস্থানীয় চক্ষু বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত একটি মেডিকেল বোর্ড ভর্তি রোগীদের পরীক্ষা করে ছাড়পত্র দেয়। কিন্তু রোগীরা সেই ছাড়পত্র ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে হাসপাতালে থেকেই যাচ্ছেন।
বর্তমানে, হাসপাতালের ৪ তলার একটি ওয়ার্ডে দুই-তিনজন ভেতর থেকে কলাপসিবল গেট বন্ধ করে অবস্থান করছেন।
জুলাই আন্দোলনে আহত হিল্লোল এক মাস আগে চিকিৎসা নিয়ে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট থেকে বাড়ি ফিরেছেন। তিনি বলেন, 'আমরা হাসপাতাল দখল করে রেখেছি বলে যে অভিযোগ করা হচ্ছে, তা মিথ্যা। আমরা সত্যিই ভর্তি থাকতে বাধ্য।'
তিনি আরও বলেন, 'অনেকে বাড়ি যাওয়ার পর তীব্র ব্যথায় আবার ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন, অনেকের চোখ পর্যন্ত অপসারণ করতে হয়েছে। আমরা যেতে চাই, কিন্তু চিকিৎসকরা কখন চিকিৎসা শেষ হবে বা আমরা পুরোপুরি সুস্থ হব কি না, তা বলেন না।'
চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. জানে আলম বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-কে বলেন, 'ডাক্তার-নার্সদের আতঙ্ক এখনো পুরোপুরি কাটেনি। তবে আমরা তাদের মনোবল ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি। মঙ্গলবার সকালে পাঁচজন খাবার নিয়েছে, কিন্তু ভেতরে ঠিক কতজন রয়েছে, তা আমাদের কোনো নিরাপত্তাকর্মী নিশ্চিত করতে পারেনি। তারা কলাপসিবল গেটে ভেতর থেকে তালা মেরে রাখে এবং কোনো সাড়া দেয় না, শুধু খাবারের সময় খাবার নেয়।'
তিনি আরও বলেন, 'ওই ওয়ার্ডে রান্নার দায়িত্বে থাকা কর্মীদের এখনো নাজেহাল করা হচ্ছে। এই মুহূর্তে তাদের কারোরই হাসপাতালে থাকার প্রয়োজন নেই। দেশের সবচেয়ে বড় চক্ষু বিশেষজ্ঞরা পরীক্ষা করে বলেছেন, তারা বাসায় থেকেই চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারেন এবং প্রয়োজনে কাছাকাছি চক্ষু হাসপাতালে যেতে পারেন।'
'তাদের ইগনোর করা যায় না, আবার ধারণও করা যায় না'
নিটোরের পরিচালক ডা. মো. আবুল কেনান বলেন, 'জুলাই আন্দোলনে আহতরা দেশের জন্য বড় অবদান রেখেছেন। তাই তাদের ইগনোর করা যায় না, আবার ধারণও করা যায় না। পরিস্থিতি কঠিন।'
তিনি জানান, বর্তমানে নিটোরে ৩১ জন রোগী ভর্তি রয়েছেন। এদের মধ্যে অধিকাংশের হাসপাতালে থাকার প্রয়োজন নেই। তারা বাড়ি থেকেই চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারেন এবং মাঝে মাঝে আউটডোরে এসে ফলোআপ করাতে পারেন। শুধু অল্প কিছু রোগীর অস্ত্রোপচার বা ইমপ্লান্ট অপসারণের প্রয়োজন রয়েছে।
ঈদের সময় নিটোরে ৭৪ জন রোগী ভর্তি ছিলেন। তাদের বেশিরভাগই ছাড়পত্র নিয়েছেন, যদিও কিছু রোগী এখনো রয়ে গেছেন। অনেকে জানিয়েছেন, ঈদের পর তারা আবার ফিরে আসবেন।
ডা. কেনান বলেন, 'জুলাই আহতদের আমাদের চিকিৎসার প্রতি আস্থা নেই। অথচ বিদেশি বিশেষজ্ঞ দল এসে জানিয়েছে, এখানে সঠিক চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। মানসিক ট্রমার কারণে তারা অস্থির হয়ে পড়েন, সহজেই ক্ষিপ্ত হন, গালিগালাজ করেন। স্টাফদের বলি ধৈর্য ধরতে, না হলে প্রতিদিনই হাসপাতালে ঝামেলা হবে। এভাবেই চলছে, দেখা যাক কী হয়।'
তিনি আরও বলেন, 'আহতরা দ্রুত সুস্থ হয়ে বিদেশে চিকিৎসা নিতে চান। কিন্তু বিদেশে পাঠানোর আগে রোগীদের অন্তত ছয় থেকে নয় মাস পর্যবেক্ষণে রাখতে হয়। তা না হলে সেখানে গিয়ে সার্জারির জন্য দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হতে পারে এবং খরচও বাড়বে। রোগীরা সেই অপেক্ষা করতে চান না। ঈদের পরে আবার দেখা হবে, কাদের বিদেশে পাঠানো উচিত।'
'এটা একরকম ক্লাব হয়ে গেছে'
বিএমইউ-তে বর্তমানে আন্দোলনে আহত ৫৬ জন রোগী কেবিন ব্লকের দুটি তলা দখল করে আছেন। সেখানে ৮০টি কেবিন থাকলেও সাধারণ রোগীরা ভর্তি হতে পারছেন না।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়) অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, 'আহতরা কেবিন দখল করে রাখায় অন্য রোগীদের ভর্তি করানো যাচ্ছে না। তাদের বিভিন্ন ধরনের কাজের প্রস্তাব দেওয়া হলেও তারা রাজি হননি। তারা হাসপাতালেই থাকতে চান। এটা এখন এক ধরনের ক্লাবের মতো হয়ে গেছে, যোগাযোগের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।'
তিনি আরও বলেন, 'ছাড়পত্র দেওয়ার পরও তারা হাসপাতালে রয়ে যাচ্ছেন, ফলে বিছানা ফাঁকা হচ্ছে না, আর নতুন রোগী ভর্তি করাও সম্ভব হচ্ছে না। তাদের আচরণে চিকিৎসক ও নার্সরাও বিব্রত হচ্ছেন।'
ডা. সায়েদুর জানান, সরকার পুনর্বাসন ও চাকরির ব্যবস্থা করবে, কিন্তু বাসস্থানের ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, 'অনেকে জিজ্ঞাসা করেন, আমরা কোথায় থাকব? কিন্তু এ প্রশ্নের উত্তর হাসপাতাল দিতে পারে না। ঢাকায় বাসস্থান দেওয়া বাস্তবসম্মতও নয়।'
তিনি বলেন, 'এই দেশে কখনোই কাউকে জোর করে হাসপাতাল থেকে বের করে দেওয়া হয়নি। কিন্তু কেউ ছাড়পত্র পাওয়ার পরও থেকে যেতে চাইলে, তার কী করা যায়, সেটাও পরিষ্কার নয়।' তিনি আরও বলেন, 'চক্ষু হাসপাতালে সীমিত পরিসরে জরুরি ও বহির্বিভাগ সেবা চালু করা হয়েছে। শনিবার থেকে সম্পূর্ণ চালুর চেষ্টা চলছে।'
নিটোর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'অনেক রোগীর হাসপাতালে ভর্তি থাকার প্রয়োজন নেই, কেবল চিকিৎসা পেলেই যথেষ্ট। কিন্তু কেউ কেউ বলছেন, তারা আমেরিকা যেতে চান। সম্প্রতি একজন রোগী পরিচালকের কক্ষের সামনে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন।'
জুলাই আন্দোলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'এটি দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা। আমি তুলনা করছি না, কিন্তু বোঝার সুবিধায় বলছি—মুক্তিযোদ্ধারা ৩০ বছর পর মাসে মাত্র ৩০০ টাকা ভাতা পেয়েছেন। কিন্তু জুলাইয়ে আহতরা আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন। নির্ধারিত ৮০ শতাংশ ভুক্তভোগী সহায়তা পেয়েছেন, বাকি সহায়তাও জুলাইয়ের মধ্যেই দেওয়া হবে। যাদের বিদেশে চিকিৎসার প্রয়োজন ছিল, তাদের পাঠানো হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৫৪ জন বিদেশে গেছেন, বাকি ১৭ জন অপেক্ষমাণ তালিকায় আছেন। চিকিৎসা নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ত্রুটি হয়নি।'