সিলেট সীমান্ত দিয়ে ২০ দিনে ৩৯৪ জনকে পুশইন বিএসএফের

সিলেট সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে পুশইন হঠাৎ করে বেড়ে গেছে, এনিয়ে বাড়ছে উদ্বেগও। বাংলাদেশী সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (বিজিবি) এর প্রতিবাদ ও সতর্ক অবস্থান সত্বেও পুশইন অব্যাহত রেখেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)।
গত ২০ দিনে এ পর্যন্ত ৩৯৪ জনকে সিলেটের বিভিন্ন সীমান্ত দিয় পুশ-ইন করেছে বিএসএফ। পুশইনের প্রায় সবগুলো ঘটনাই ঘটছে সিলেট, সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজাররের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে।
সবশেষ মঙ্গবার রাত ও বুধবার সকালে সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার মোকামপুঞ্জি ও মিনাটিলা ও জকিগঞ্জ এবং সুনামগঞ্জের ছাতক সীমান্ত দিয়ে মোট ৮২ জনকে বাংলাদেশে 'পুশইন' করে বিএসএফ।
বিজিবি সূত্র জানায়, রাত তিনটার দিকে মোকামপুঞ্জি সীমান্ত দিয়ে ৩২ জনকে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়। এদের মধ্যে তিনজন শিশু, ১২ জন নারী এবং ৭ জন পুরুষ রয়েছেন। ঘটনার সময় সতর্ক অবস্থানে থাকা শ্রীপুর বিওপি'র বিজিবি সদস্যরা দ্রুত অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করে।
কিছুক্ষণ পর একই উপজেলার মিনাটিলা সীমান্ত দিয়ে আরও ২০ জন নারী, পুরুষ ও শিশুকে পুশইন করা হয়। সেখানে দায়িত্বরত বিজিবি সদস্যরাও তাদের আটক করেন।
এভাবে দেড় ঘণ্টার ব্যবধানে জৈন্তাপুর সীমান্ত দিয়ে মোট ৫২ জন পুশইন-এর শিকার হন।
এদিকে সকালে জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে শিশু নারীসহ আরও ১৪ জনকে পুশইন করা হয়। পরে তাদের আটক করে ১৯ ব্যাটালিয়ন বিজিবি।
এছাড়া মঙ্গলবার রাতে সুনামগঞ্জ জেলার ছাতল উপজেলার নোয়াকোট বিওপির দায়িত্বপূর্ণ এলাকা ছনবাড়ি সীমান্ত দিয়ে ১৬ জনকে পুশইন কারনো হয়েছে। তাদের মধ্যে পুরুষ পাঁচজন, মহিলা পাঁচজন এবং শিশু ছয়জন। তাদের বাড়ি কুড়িগ্রাম জেলায়।
এর আগে সোমবার (২৬ মে) সকালে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর ইউনিয়নের মতেরবল সীমান্ত এলাকা দিয়ে অনুপ্রবেশের সময় ২১ জনকে আটক করা হয়। আটকদের মধ্যে ৭ জন পুরুষ, ৬ জন মহিলা ও ৮ জন শিশু রয়েছেন। আটকরা বাংলাদেশি নাগরিক বলে বিজিবি নিশ্চিত করেছে।
বিজিবির দাবি, বিএসএফ তাদের নিজ সীমান্তে একত্র করে কাঁটাতারের গেট খুলে এই নারী, পুরুষ ও শিশুদের বাংলাদেশে ঠেলে দেয়। আটক ব্যক্তিদের মধ্যে ৫ শিশু, ৮ নারী ও ৬ পুরুষ আছেন। তারা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক এবং কুড়িগ্রামের বাসিন্দা।
তবে এই পুশইনকালে বাংলাদেশি নাগরিকের পাশাপাশি রোহিঙ্গা এবং ভারতীয়দের ঠেলে দেওয়ার শঙ্কা করছে বিজিবি।
যদিও বিজিবি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এব্যাপারে বিজিবি সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছেন তারা। কিন্তু মানবিক কারণে বিজিবি পুশইন হওয়ার পর কাউকে ফের পুশব্যাক করতে পারেন না।
এ অবস্থায় সিলেট সীমান্তজুড়ে সতর্কতা ও তৎপরতা বাড়িয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। তবুও থামছে না পুশইন।
এর আগে রোববার (২৫ মে) সিলেট ও মৌলভীবাজার সীমান্ত দিয়ে বড় ধরনের পুশ-ইন অর্থাৎ সর্বোচ্চ ১৫৩ জনকে পুশইন করে বিএসএফ। তাদের বাড়ি দেশের বিভিন্ন জেলায় বলে বিজিবি সূত্র নিশ্চিত করেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত শনিবার (২৪ মে) গভীর রাত থেকে রোববার (২৫ মে) সকাল ৮টা পর্যন্ত পুশইন করা হয়। তবে বাংলাদেশে প্রবেশের সঙ্গে-সঙ্গেই তাদের আটক করেছে বিজিবি। এদের মধ্যে বড়লেখার লাতু বিওপি ক্যাম্প আটক করে ৭৯ জন, পাল্লাথল বিওপি ক্যাম্প আটক করে ৪২ জন ও নয়াগ্রাম বিওপি ক্যাম্প আটক করে ৩২ জনকে।
বিজিবি জানায়, ঘনজঙ্গল ও বিলের মধ্য দিয়ে তাদের বাংলাদেশে পাঠানো হয়। বিজিবি ৫২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মেহেদী হাসান বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
জানা গেছে, সীমান্ত পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠায় ভারতের মেঘালয়ের পূর্ব জৈন্তিয়া হিলস জেলাসহ তিনটি জেলায় আন্তর্জাতিক সীমান্তজুড়ে রাত্রিকালীন কারফিউ জারি করা হয়েছে। রাত ৮টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করে সীমান্তের শূন্যরেখা থেকে ৫শ মিটার পর্যন্ত এলাকায় কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এতে অবৈধ অনুপ্রবেশ, চোরাচালান, গবাদিপশু পারাপার, অস্ত্র বা বিপজ্জনক বস্তু বহনের ওপরও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
তবুও থামছে না পুশ-ইনের মতো ঘটনা। সম্প্রতি সিলেট সীমান্তজুড়ে আরও বেড়েই চলছে এরকম কার্যক্রম।
বিজিবি ৫২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মেহেদী হাসান জানান, 'সীমান্ত এলাকার কিছু অংশ পাহাড়ি আবার কিছু এলাকায় জলাভূমি বিল থাকায় জিরো পয়েন্ট থেকে নজরদারি করা কঠিন। বিএসএফ তাদের এলাকায় স্থাপিত নিরাপত্তা লাইট বন্ধ করে দিয়ে মানুষদের সীমান্তের এপারে ঠেলে দেয়। পরে টহল বিজিবি তাদের আটক করে।'
তিনি আরও বলেন, 'বিজিবির হাতে আটকের পর পরিচয় যাচাই করে বাংলাদেশি নাগরিক বলে মানবিক দিক বিবেচনায় তাদের পরিবারের কাছে পাঠানোর জন্য পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।'
এ ব্যাপারে সিলেট জেলা বারের সাবেক সভাপতি ও সিলেট জজকোর্টের সাবেক পিপি এডভোকেট এমাদুল্লাহ শহীদুল ইসলাম শাহীন বলেন, পুশ-ইন কিংবা পুশ-ব্যাক দুটিই বেআইনী এবং মানবাধিকার পরিপন্থী। সিলেট বিভাগ হচ্ছে সীমান্ত ঘেরা অঞ্চল। এই অঞ্চলে ভারত যেভাবে পুশইনের মাধ্যমে প্রতিদিন শত শত মানুষকে জোর করে ঠেলে দিচ্ছে তা কোনভাবেই মেনে নেয়ার মতো নয়। এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ক শুধু কড়া বিবৃতি নয়, কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনের আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার সংগঠনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে।
তিনি বলেন, সম্প্রতি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় সীমান্তে উভয় দেশের মানুষ বন্দী হয়েছে। তখন দুটি দেশ তাদের মানুষকে আইনীভাবে হস্থান্তর ও গ্রহণ করেছে। এটাই সঠিক পদ্ধতি। বাংলাদেশী অবৈধভাবে ভারতে অনুপ্রবেশ করলে সেদেশের আইন অনুযায়ী বাংলাদেশী দূতাবাসকে বিষয়টি অবহিত করতে হবে। দুতাবাসের মাধ্যমেই তাদেরকে দেশে পাঠাতে হবে। এভাবে বাংলাদেশী বলে শত শত মানুষকে পুশইন করা কোনভাবেই সঠিক নয়। বিষয়টি উভয় দেশের জন্য বিপজ্জনক। তাই এখনি কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, গত ২৪ মে সিলেটের কানাইঘাট সীমান্ত দিয়ে ২১ বাংলাদেশিকে পুশ-ইন করেছে বিএসএফ। তাদের মধ্যে ১২ জন পুরুষ, চারজন নারী ও পাঁচজন শিশু ছিলেন। এর আগে গত ১৪ মে একই উপজেলার ডোনা সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে আরও ১৬ নারী-পুরুষকে পুশইন করা হয়। তাদের মধ্যে আটজন পুরুষ, ৬ জন নারী ও দুজন শিশু ছিলেন।
গত ২২ মে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার কর্মধা ইউনিয়নের মুরইছড়া সীমান্ত দিয়ে শিশুসহ ৭ বাংলাদেশিকে পুশইন করেছে বিএসএফ। আটকদের মধ্যে ছিলেন দুইজন পুরুষ, দুইজন নারী ও তিন শিশু। তারা সবাই কুড়িগ্রাম জেলার বাসিন্দা।
গত ১৬ মে মৌলভীবাজারের বড়লেখার নিউ পাল্লাথল সীমান্ত এলাকা দিয়ে আরও ১৬ জনকে পুশইন করেছে বিএসএফ। এরমধ্যে ১৪ জন নারী ও দুজন পুরুষ ছিলেন।
গত ১৪ মে মৌলভীবাজারের বড়লেখার পাল্লাতল সীমান্ত দিয়ে নারী ও শিশুসহ ৪৪ জনকে পুশইন করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ১৩ জন পুরুষ, ১৮ জন নারী ও ১৩ শিশু ছিলেন।
এর আগে গত ৮ মে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে আরও ১৫ জনকে পুশইন করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৯ জন পুরুষ, তিনজন নারী ও তিনজন শিশু ছিলেন।