উপদেষ্টার মাথায় বোতল পড়া নিয়ে দুঃখপ্রকাশ, তবে কর্মসূচি চালিয়ে যাবেন জগন্নাথের শিক্ষার্থীরা

দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের প্রতিনিধি ও শিক্ষার্থী সামসুল আরেফিন।
তিনি বলেন, 'আমরা সারারাত এখানেই অবস্থান করব। আমাদের শিক্ষার্থীদের ওপর কোনো আঘাত এলে তার দায় সরকারকে নিতে হবে।'
তিনি আরও জানান, তাদের দাবির সঙ্গে সবগুলো সংগঠন ঐকমত্য হয়েছে।
তিন দফা দাবিতে বুধবার (১৪ মে) রাজধানীর কাকরাইল এলাকায় বিক্ষোভ শুরু করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের কর্মসূচিতে শিক্ষকরাও একাত্মতা প্রকাশ করে যোগ দেন।
শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো হলো: বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীর জন্য আবাসন নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ২০২৫-২৬ অর্থবছর থেকে আবাসন বৃত্তি চালু করা; ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত পূর্ণাঙ্গ বাজেট কাটছাঁট না করে অনুমোদন দেওয়া; এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পাস প্রকল্প পরবর্তী একনেক সভায় অনুমোদন দিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করা।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. রইছ উদ্দিন বলেন, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তারা আন্দোলনের মাঠেই থাকবেন।
উপদেষ্টার ওপর বোতল নিক্ষেপের বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ করে সামসুল আরেফিন বলেন, 'আমরা শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করছি। তবে দুঃখ প্রকাশ করলেও এর দায়-দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে।'
এর আগে রাত ১০টার পর আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলতে আসেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। কিন্তু ভিড়ের মধ্য থেকে কেউ তার দিকে পানির বোতল ছুড়ে মারেন। এরপর তিনি বক্তব্য শেষ না করেই চলে যান।
মাহফুজ তার বক্তব্য শুরুর এক মিনিটের মাথায় বলেন, 'আজকে যেভাবে আন্দোলনে পুলিশের কিছু সদস্য হয়তো—আপনার—উস্কানি…'
এ কথা শোনামাত্র শিক্ষার্থীরা 'ভুয়া ভুয়া' বলে চিৎকার করতে থাকেন। এ সময় মাহফুজ বলেন, 'কথা শেষ করতে দিন।'

কিছু পরেই বাম পাশ থেকে একটি বোতল এসে তার মাথায় লাগে। তখন মাহফুজ বলেন, 'আমি কথা বলব না।' এরপর তিনি পুলিশের নিরাপত্তায় ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।
এই ঘটনায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করে মো. রইছ উদ্দিন বলেন, 'এটা আমাদের শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে করা হয়নি।' তিনি অভিযোগ করেন, 'ভিন্ন একটি পক্ষ আন্দোলনকে নস্যাৎ করার উদ্দেশ্যে এটি করেছে।'
তিনি বলেন, 'প্রশাসন এ ঘটনা তদন্ত করে দায়ীদের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করুক।'
বক্তব্যের শুরুতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে মাহফুজ বলেছিলেন, 'আপনারা ন্যায্য দাবি নিয়ে মাঠে নেমেছেন। এ বিষয়ে আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) শিক্ষা উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলে ডায়ালগের মাধ্যমে সমাধান করা হবে।'
এদিকে রাত পৌনে ১টার দিকে উপদেষ্টা মাহফুজ আলম আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দাবিকে ন্যায্য দাবি হিসেবে পুনর্ব্যক্ত করেন।

তিনি তার ফেসবুক প্রোফাইলে এক পোস্টে বলেন, 'আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ন্যায্য দাবিতে সরকারের কাছে উপস্থিত হয়েছে। তাদেরকে সরাতে কোনোরকম হামলা বা কোনো ফোর্সফুল মেজার [জোরপূর্বক পদক্ষেপ] গ্রহণ না করতে ডিএমপি কমিশনারকে ইতোমধ্যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।'
এর আগে বুধবার বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আটটি বাসে করে আরও কয়েকশ শিক্ষার্থী কাকরাইলে এসে অবস্থান কর্মসূচিতে অংশ নেন।
আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. রেজাউল করিম, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক সাবিনা শরমীন এবং প্রক্টর অধ্যাপক তাজাম্মুল হকও অংশ নেন।
কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা 'রক্ত লাগলে রক্ত নে, জগন্নাথে হল দে' স্লোগান দেন।
এদিন সকালে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে 'লংমার্চ' শুরু করেন প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার উদ্দেশে।

দুপুর সোয়া ১২টার দিকে একাত্তরের গণহত্যা ভাস্কর্য চত্বর থেকে লংমার্চ শুরু হয়।
কাকরাইল মসজিদের সামনে পুলিশ তাদেরকে বাধা দিলে ধাক্কাধাক্কির একপর্যায়ে শুরু হয় লাঠিচার্জ। পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড, কাঁদানে গ্যাস ও জলকামান ব্যবহার করে মিছিল ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
পরে বেলা ২টার দিকে প্রায় ২০০ শিক্ষার্থী কাকরাইল মোড়ে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। এতে ওই মোড়ে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বিকেলে সেখানে আরও শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যোগ দেন এবং দাবির পক্ষে স্লোগান দেন।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা জানান, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের হামলার বিচার না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।
তারা ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা বিভাগের সহকারী কমিশনারের (এসি) বিচারের দাবিও জানান।

এক শিক্ষার্থী, আবির হোসেন দাবি করেন, সংঘর্ষে ২৫ জন আহত হয়েছেন।
আহতদের একজন শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মো. রইছ উদ্দিন বলেন, 'শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের হামলার বিচার ও দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা এখানেই থাকব।'
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক তাজাম্মুল হক বলেন, 'শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ হামলা চালিয়েছে, এমনকি সহকারী প্রক্টরকে আঘাত করেছে। এর বিচার না হওয়া পর্যন্ত আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব।'
আন্দোলনকারীরা জানান, তারা ব্যারিকেড ভেঙে যমুনার দিকে এগোতে চাইলে পুলিশ লাঠিপেটা শুরু করে।
পরে টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড ও জলকামান ছুড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। অনেকে মৎস্য ভবন মোড়ের দিকে সরে যান।

কাঁদানে গ্যাসে আহত শিক্ষার্থী সামিউল রহমান বার্তা সংস্থা ইউএনবিকে বলেন, 'আমাদের যৌক্তিক দাবির শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে পুলিশ হামলা চালিয়েছে। আমার ওপর কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করা হয়েছে।'
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ পরিদর্শক মো. ফারুক জানান, আহতদের কয়েকজনকে জরুরি বিভাগে এনে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
এ কর্মসূচির আয়োজক 'জবি ঐক্য' নামের একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলো একত্রিত হয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার সংগঠনটি কর্মসূচির ঘোষণা দেয়। এর আগে একটি প্রতিনিধি দল বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে (ইউজিসি) গেলেও সন্তোষজনক সাড়া না পাওয়ায় শিক্ষার্থীরা লংমার্চের ডাক দেন।
লংমার্চে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি, ছাত্রদল, ছাত্র অধিকার পরিষদ, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, ছাত্রশিবির, গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর নেতারা অংশ নেন।