‘দুই সপ্তাহ ধরে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়’: দেশে ফিরে ভারতের নির্যাতনের বর্ণনা দিলেন ৭৫ বাংলাদেশি

দেশে ফেরাদের কেউ কেউ দুই থেকে তিন যুগ ধরে বসবাস করছিলেন ভারতের গুজরাটের আহমেদাবাদে। আবার কেউ দুই মাস থেকে পাঁচ-ছয় বছর ধরেও সেখানে থাকছেন বলে জানান বাংলাদেশে ফেরা ৭৫ বাংলাদেশি।
কোস্টগার্ড পশ্চিমজোনের কমান্ডিং অফিসার আবরার জানান, গত ৯ মে ভোররাতে ভারত সুন্দরবনের মান্দারবাড়িয়া চরে ৭৫ জন বাংলাদেশি মুসলিম এবং ৩ জন ভারতীয় মুসলিমকে জোরপূর্বক পুশ ইন করে। ফেরত আসা অধিকাংশই দীর্ঘদিন যাবৎ ভারতের গুজরাট রাজ্যে বসবাস করে আসছিলেন এবং বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন।
ফিরে আসা বাংলাদেশীরা জানান, তাদের অনেকে ২-৩ যুগ ধরে থেকে গুজরাটের আহমেদাবাদের বস্তিতে বসবাস করছিলেন। কেউ কেউ দুই মাস বা পাঁচ-ছয় বছর ধরে সেখানে থাকছেন। গত ২৬ এপ্রিল ভোররাতে ভারতের শত শত পুলিশ ও স্পেশাল ব্রাঞ্চের সদস্যরা বস্তি ঘেরাও করে তাদের আটক করে ও বস্তি ভেঙে ফেলে।
তারা আরও জানান, এসময় অনেককে পরিবারের সদস্যদের সাথে পর্যন্ত দেখা করতে দেওয়া হয়নি। নিজেরা বাংলাদেশে ফিরতে পারলেও সেখানে অবস্থানরত স্ত্রী ও সন্তানরা কোথায় আছেন সেটা বলতে পারছেন না।
নড়াইল জেলার চাতুরী গ্রামের তালেব শেখের ছেলে ফুয়াদ শেখ বলেন, "অনেকের সঙ্গে আমাকেও নেওয়া হয় পুলিশ স্টেশনে। সেখান থেকে অন্যত্র নিয়ে আটকে রাখার পর ৫ মে কালো কাপড়ে মুখ ঢেকে দিয়ে পিছমোড়া করে দু'হাত বেঁধে সবার সাথে তাকেও বিমানে তোলা হয়। পরবর্তীতে একই অবস্থায় একদিন রাখার পর ৯ মে তাদের জাহাজে উঠিয়ে মারধরের পর রাত ১২টার দিকে শরীরে লাইফ জ্যাকেট জড়িয়ে দিয়ে বঙ্গোপসাগরের চরে ফেলে দেওয়া হয়।"
ফুহাদ শেখ জানায়, তার তিন কন্যা শিশু ও স্ত্রী এখনো গুজরাটে রয়েছে। তাকে আটক করার পর পরিবারের সাথে দেখা পর্যন্ত করতে দেওয়া হয়নি।

নড়াইল জেলার কালিয়া উপজেলার জয়পুর গ্রামের আবজাল মৃধা বলেন, "ছেলে রাহাতকে নিয়ে তিনি আহমেদাবাদে প্লাস্টিক কুড়ানোর কাজ করতেন। হঠাৎ ২৬ এপ্রিল ফজরের নামাযের সময় গুজরাটের শাহআলম চান্ডালের মুসলিম বস্তি থেকে তাদেরকে ধরে নিয়ে যায়। বিভিন্ন স্থানে আট/নয় দিন আটকে রাখার সময় 'বাংলাদেশি' বলে গালিগালাজ করার পাশাপাশি বাবা-ছেলেকে মারধর করা হয়।"
আবজাল ও তার ছেলে রাহাত বলেন, "আটক করার পর প্রতিদিন বেলা ১১টার দিকে একটি বিস্কুট ও হাফ গ্লাস পানি দেওয়া হতো। এছাড়া বিকেলের দিকে দুর্গন্ধযুক্ত এক পিছ পাউরুটির বাইরে আর কিছুই খাইতে দিত না। প্রসব-পায়খানার কথা বললেই তাদের প্রত্যেকের উপর নির্মম নির্যাতন চালানো হতো বলে দাবি তাদের।"
তবে শুধু ফুয়াদ কিংবা আবজাল আর রাহাত না। বরং বঙ্গোপসাগরের মান্দারবাড়িয়া এলাকা দিয়ে দেশে পুশইন করা ৭৮ বাংলাদেশির বর্ণনা অভিন্ন। তারা প্রত্যেকেই জানান, ভারতীয় বাহিনীর হাতে আটকের সময়ে তাদেরকে সামান্য বিস্কুট ও পাউরুটি খাইয়ে রাখা হতো। সামান্য পানি দেওয়ার বাইরে প্রতিনিয়ত বাংলাদেশি বলে তাদেরকে গালমন্দ করার পাশাপাশি বেপরোয়া মারপিট করা হতো। এসময় অনেকে পিঠ ও কোমরের নির্যাতনের চিহ্ন দেখান।
পশ্চাৎদেশের কাপড় সরিয়ে কালিয়ার গাজিরহাট গ্রামের আবু বক্কার জানান, প্রত্যেকের কোমরের নিচে পিছনের অংশে পিটিয়েছে। লাঠির আঘাতে কালো দাগ হওয়ার পাশাপাশি অনেকের পশ্চাৎদেশে ঘা হয়ে রস ঝরছে।
ফিরে আসা আরেক ব্যক্তি জাহিদ শেখ জানান, তার স্ত্রী রত্না পারভীন ও পাঁচ ছেলে মেয়ে এখনো গুজরাটে। দুই মেয়েকে সেখানে বিয়েও দেওয়া হয়েছে। তিনি আর ভারতে যেতে চান না। তার ভাগ্য নিয়েও সেখানে অবস্থানরতরা হয়ত বেশী চিন্তিত। তাই সেখানে অবস্থানরত স্ত্রী-সন্তানদের ফিরে পাওয়ার জন্য আরও অনেকের মত তিনি সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
ভারতীয় কোস্টগার্ড ও বিএসএফ এর মাধ্যমে পুশইন হওয়া ৭৮ বাংলাদেশির মধ্যে ৭৫ জনকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে মঙ্গলবার (১৩ মে) বেলা ১২ টায়। সাতক্ষীরার শ্যামনগর থানায় তাদের স্বজনদের নিকট তাদের হস্তান্তর করা হয়।
এদিকে বাবা-মা সবাই বাংলাদেশি হওয়া সত্ত্বেও ভারতে জন্ম নেওয়ার কারণে তিনজনকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তারা হলেন, খুলনা জেলার বটিয়াঘাটা থানার খালিদ শেখ ও কাকলী দম্পতির ছলে আব্দুর রহমান (২০), নড়াইল জেলার কালিয়া থানার বিষ্ণুপুর গ্রামের মৃত মুন্না শাহ ও মৃত নুরজাহান বেগমের ছেলে মো. হাসান শাহ (২২) এবং সোহেল শেখ ও সাবিনা দম্পতির ছেলে সাইফুল শেখ(১৯)।

এজহারে উল্লেখ করা হয়েছে, বাবা-মা গুজরাটে অবস্থানকালে গুজরাটের ফুলবাড়িয়া এলাকার নেহেরীনগর জোপারপাচ্চি এলাকায় তাদের জন্ম।
এসব বিষয়ে কোস্টগার্ড পশ্চিমজোনের কমান্ডিং অফিসার আবরার জানান, অধিকাংশই দীর্ঘদিন যাবৎ ভারতের গুজরাটে বসবাস করে আসছিল এবং বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসায় জানা যায়, গত ২৬ এপ্রিল গভীর রাতে ভারতীয় প্রশাসন তাদের বাসা থেকে আটক করে এবং ৯ মে গোপনে সুন্দরবনের মান্দারাড়ি চরে রেখে যায়।
আবরার আরও জানান, পরবর্তীতে এসব ব্যক্তিরা মান্দারবাড়িয়া চর হতে মান্দারবাড়ি ফরেস্ট অফিসে এসে আশ্রয় নেয়। বিষয়টি কোস্টগার্ডকে জানালে ১০ মে তাদের উদ্ধার করে পরদিন রাতে শ্যামনগর থানা পুলিশের নিকট তাদের হস্তান্তর করা হয়। এসব ব্যক্তিরা প্রত্যেকে তাদের উপর নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন। এদের মধ্যে ১০ জন খুবই গুরুতর অসুস্থ ছিলেন তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
সাতক্ষীরা পুলিশ সুপার মনিরুল ইসলাম বলেন, তিন জনের বিরুদ্ধে অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগ এনেছে কোস্টগার্ড। তারা ভারতীয় নাগরিক বলে দাবি করেছেন। সেজন্য তাদের বিরুদ্ধে শ্যামনগর থানায় মামলা হয়েছে। তারা বর্তমানে কারাগারে আছেন। মামলার তদন্তকালে যদি উপযুক্ত কাগজপত্র পরিবারের সদস্যরা উপস্থাপন করতে পারেন তাহলে তাদের বিরুদ্ধে সেভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পুলিশ সুপার আরও বলেন, বাকি ৭৫ জন বাংলাদেশি নাগরিক। তারা নড়াইল, যশোর, খুলনা, ঢাকা ও সাতক্ষীরার বাসিন্দা। তবে অধিকাংশই নড়াইল জেলার। তাদের যাচাই বাছাই শেষে পরিবার ও নিকটতম স্বজনদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।