নন-প্র্যাকটিসিং চিকিৎসকদের ভাতা ও প্রণোদনা দেওয়ার সুপারিশ স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনের

মেডিকেল শিক্ষায় মানোন্নয়ন ও গবেষণাকে উৎসাহিত করতে নন-প্র্যাকটিসিং চিকিৎসকদের জন্য বিশেষ ভাতা ও অতিরিক্ত আর্থিক প্রণোদনা প্রদানের সুপারিশ করেছে স্বাস্থ্যখাত বিষয়ক সংস্কার কমিশন।
গত সোমবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার কাছে কমিশনের প্রতিবেদন হস্তান্তর করা হয়।
কমিশন জানায়, মেডিকেল শিক্ষার প্রতিটি শাখায় একটি স্বতন্ত্র পূর্ণকালীন শিক্ষক ক্যাটাগরি চালু করা প্রয়োজন, যারা শুধুমাত্র শিক্ষা ও গবেষণায় নিয়োজিত থাকবেন।এজন্য নন-প্র্যাকটিসিং ভাতা ও অতিরিক্ত আর্থিক প্রণোদনা প্রদান করতে হবে যাতে শিক্ষকরা নিরবচ্ছিন্নভাবে একাডেমিক কাজে মনোযোগী হতে পারেন।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, জনবল সংকটপূর্ণ বিষয়ে—যেমন মেডিকোলিগ্যাল, ক্লিনিক্যাল ও বেসিক সাবজেক্টসমূহে—আকর্ষণ সৃষ্টির লক্ষ্যে বিশেষ ভাতা ও আর্থিক সুবিধা প্রদান করতে হবে। এতে এসব শাখায় দক্ষ জনবল গড়ে তোলা এবং ধরে রাখা সহজ হবে।
কমিশনের সুপারিশে স্বাস্থ্য অবকাঠামোর বিভিন্ন স্তরে প্রয়োজনীয় নতুন পদ সৃষ্টি, যোগ্যতা অনুযায়ী বেতন নির্ধারণ, এবং পদোন্নতির ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট মানদণ্ড ব্যবহারের কথাও বলা হয়েছে। দুর্গম এলাকায় কাজ করা চিকিৎসকদের জন্য বিশেষ ভাতা ও আবাসনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া প্রস্তাবিত 'বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিস' কাঠামোর আওতায় দেশের স্বাস্থ্যসেবার চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে জনবলের ধরন ও পরিমাণ নির্ধারণ, এবং শূন্যপদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বা নতুন পদ সৃষ্টি করে দ্রুত নিয়োগ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
সরকার ২০২৪ সালের নভেম্বরে ১২ সদস্যের স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন গঠন করে। কমিশনের প্রধান হিসেবে রয়েছেন ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খান।
প্রতিটি বিভাগে একটি পূর্ণাঙ্গ, সর্বাধুনিক সুবিধাসম্পন্ন ও বিশ্ব মানের টারশিয়ারি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার সুপারিশ
প্রতিটি বিভাগে অন্তত একটি পূর্ণাঙ্গ, সর্বাধুনিক সুবিধাসম্পন্ন ও বিশ্ব মানের টারশিয়ারি সেবা হাসপাতালের প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করার সুপারিশ করেছে স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন।
সংস্কার কমিশন মনে করে, এই হাসপাতাল জটিল ও বিশেষায়িত চিকিৎসার জন্য একটি আঞ্চলিক রেফারেল কেন্দ্র হিসেবে কাজ করবে। এটি নতুনভাবে গড়ে তোলা যেতে পারে, অথবা বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানসমূহকে ধাপে ধাপে উন্নীত করে করা যেতে পারে।
এক্ষেত্রে প্রয়োজনে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ ও বিদেশি যৌথ বিনিয়োগ সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। বার্ধক্যজনিত স্বাস্থ্য সমস্যা সংশ্লিষ্ট সেবাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
স্বাস্থ্যের অবস্থা, স্বাস্থ্য সমস্যার অবস্থা ও রোগতাত্ত্বিক প্রয়োজনের আলোকে উপজেলা-ওয়ারি বাজেট ও পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করতে হবে। বিভাগীয় পর্যায়ে কার্যক্রম স্বশাসিত আঞ্চলিক স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ পরিচালিত করবে, যা নিয়ন্ত্রণ করবে বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিস।
একজন চিবিৎসক দিনে ৫০ জন রোগী দেখবেন
একজন চিকিৎসক দিনে ৫০ জন রোগী দেখবেন এবং প্রতি রোগীর জন্য অন্তত ১০ মিনিটের পরামর্শ সময় নিশ্চিতের সুপারিশ করেছে স্বাস্থ্য খাত বিষয়ক সংস্কার কমিশন।
এ জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক সেবা প্রদান কারীর উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে এবং সাপ্তাহিকভাবে প্রেসক্রিপশন নমুনা যাচাই পদ্ধতি চালু করা হবে বলে কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়।
কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশে সর্বমোট ১.৬৬,৮৩৪ জন স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োজিত রয়েছেন। এক্ষেত্রে অনুমোদিত পদ রয়েছে ২৪৪.৭১১ টি; অর্থাৎ অনুমোদিত পদের মধ্যে ৩২ শতাংশ এখনো শূন্য হয়ে আছে।
এতে আরও বলা হয়, স্বাস্থ্য জনবলের আঞ্চলিক বিভাজনে ঢাকা বিভাগে প্রচুর স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছেন যা সমগ্র জাতীয় জনবলের ৪৭ শতাংশ। অর্থাৎ, বাংলাদেশের আনুমানিক ৩০ শতাংশ জনগণের সেবা দিয়ে থাকেন ৪৭ শতাংশ (৩৬৬,৬৮৬) স্বাস্থ্যকর্মী; বাকি ৭০ শতাংশের সেবা করেন ৫৩ শতাংশ স্বাস্থ্যকর্মী। সিলেট বিভাগে জনসংখ্যার অনুপাতে সবচেয়ে কম স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছেন।
এছাড়া, নগরে অঞ্চলে অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছেন প্রায় সব বিভাগে। গ্রামাঞ্চলে স্বাস্থ্যকর্মীর ঘাটতি রয়েছে যেখানে দেশের প্রায় ৬২ শতাংশ মানুষ এখনো গ্রাম অঞ্চলে বাস করেন। স্বাস্থ্যকর্মীর এই অসম বিভাজন দেশের দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় একটি ঋনাত্মক প্রভাব বিস্তার করে। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চল এবং দুর্গম অঞ্চলে স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়োগ অবস্থান নিশ্চিত করা অত্যন্ত দুরূহ হয়ে পড়েছে।
সরকারি হাসপাতালের রোগীকে বেসরকারি হাসপাতালে পাঠানো যাবে না
সরকারি হাসপাতালের রোগীকে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠানো যাবে না বলে সুপারিশ করেছে স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন।
একইসঙ্গে অপারেশন থিয়েটারে সিসিটিভি ক্যামেরা রাখার সুপারিশ করা হয়েছে। শল্য চিকিৎসার প্রতিটি পদক্ষেপ স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হবে এবং তার রেকর্ড রাখার সুপারিশ করা হয়েছে।
এছাড়া ওষুধ প্রস্তুতকারকের প্যাডে প্রেসক্রিপশন লেখা বা অপ্রয়োজনীয় ওষুধ বা পরীক্ষা করার পরামর্শ দেয়া যাবেনা।
একটি রোগে একাধিক বিশেষজ্ঞ দেখানো যাবেনা
একজন রোগী একটি রোগের চিকিৎসার জন্য একজন চিকিৎসককেই দেখাবে একাধিক চিকিৎসক বা বিশেষজ্ঞকে নয় কারণ তা সার্ভিস এর ডুপ্লিকেশন হয়। একজন রোগী ও ডাক্তার উভয়রেই সময় ক্ষেপন হয়।
কমিশনের সুপারিশে বলা হয়, রোগীর চিকিৎসাজনিত জটিলতা বা প্রয়োজন বিবেচনায়, প্রয়োজনে মেডিকেল বোর্ড গঠন করে সমন্বিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে এবং চিকিৎসক রোগীকে উন্নততর চিকিৎসার জন্য উপযুক্ত বিশেষায়িত কেন্দ্রে প্রেরণ করবেন। এটা সরকারি ও বেসরকারী সকল ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে।
সরকারি আধা সরকারি হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসক সে হাসপাতাল থেকে কোন রোগীকে ঐ চিকিৎসকের প্রাইভেট চেম্বারে যেতে বলতে পারবে না। হাসপাতালের কোন কর্মচারী চিকিৎসকের প্রাইভেট চেম্বারে রোগী প্রেরণ করলে তা শাস্তি যোগ্য অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হবে।