কুয়েট: উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে অনশনরত এক শিক্ষার্থী জ্ঞান হারিয়েছেন, বাকিরাও অসুস্থ

খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাছুদের পদত্যাগের দাবিতে আমরণ অনশনরত অবস্থায় ফারিন নামের এক শিক্ষার্থী জ্ঞান হারিয়েছেন। আজ মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল) দুপুর ১ টা ৪৫ মিনিটের দিকে কুয়েটের মসজিদে নামাজরত অবস্থায় তিনি জ্ঞান হারান। পরে সেখান থেকে তাকে কুয়েটের মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়।
এর আগে, অনশনরত কয়েকজন শিক্ষার্থী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। প্রচণ্ড গরমে এত দীর্ঘসময় অনশনে থাকার কারণে তাদের অনেকেই শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছেন। কিন্তু, উপাচার্যের পদত্যাগ ব্যতীত তারা অনশন ভাঙবেন না বলে জানিয়েছেন।
সোমবার (২১ এপ্রিল) বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্টস ওয়েলফেয়ার সেন্টারের সামনে বিকেল ৩টায় ৩২ জন শিক্ষার্থী উপাচার্যের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে তাদের পূর্বনির্ধারিত অনশন কর্মসূচি শুরু করেন। এর আগে রোববার তারা ভিসির পদত্যাগের জন্য ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন। আল্টিমেটামের সময়সীমা শেষ হলেই তারা অনশনে বসেন।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বিকেলে শিক্ষার্থীরা ড. এম এ রশীদ হলের সামনে জড়ো হতে থাকেন। সেখান থেকে তারা তোশক, বালিশ, বিছানার চাদর নিয়ে স্টুডেন্ট ওয়েলফেয়ার সেন্টারে গিয়ে বসে পড়েন।
এর আগে থেকেই সেন্টারে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কল্যাণ পরিচালক, সিন্ডিকেট সদস্য, শিক্ষক সমিতির সভাপতি, বিভিন্ন বিভাগের বিভাগীয় প্রধানসহ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষক অবস্থান করছিলেন। শিক্ষার্থীরা আসার পর শিক্ষকরা তাদের কাছে যান।
শিক্ষকদের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের অনশন কর্মসূচি প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হয়। তবে শিক্ষার্থীরা তাদের এক দফা দাবিতে অনড় রয়েছেন। ভিসির পদত্যাগ ছাড়া তারা আন্দোলন থেকে পিছু হটবেন না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দেন।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছেন, গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদল ও বহিরাগতদের হামলার পরও উপাচার্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছেন। উল্টো, হামলার ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে আন্দোলনকারী ৩৭ শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে।
শিক্ষার্থীরা জানান, ঘটনার বিচার এবং উপাচার্য অপসারণের দাবিতে তারা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে স্মারকলিপি দিলেও কোনো আশ্বাস পাননি। ফলে তারা বাধ্য হয়ে আমরণ অনশনে বসেছেন। তাদের বক্তব্য, 'যে ভিসি আন্দোলন নস্যাৎ করতে শিক্ষার্থীদের বহিষ্কার করতে পারেন, তার সঙ্গে আপস করলে ভবিষ্যতে নিরাপত্তা কোথায় থাকবে?'
তারা আরও অভিযোগ করেন, ১৮ ফেব্রুয়ারির ঘটনাকে তদন্ত কমিটি 'সংঘর্ষ' বলে উল্লেখ করলেও, এটি সুনির্দিষ্টভাবে একতরফা হামলা ছিল। সেই সঙ্গে প্রশ্ন তুলেছেন, তদন্ত কমিটি কেন ১৮ ফেব্রুয়ারির ঘটনা তদন্তের কথা বললেও এখন ১৮ ও ১৯ ফেব্রুয়ারির কথা বলছে। আরও প্রশ্ন, তদন্ত কমিটি ও সিন্ডিকেট ছাড়া ক্যাম্পাসের সিসিটিভি ফুটেজ 'বটপেইজ' নামের একটি ফেসবুক পেইজে কীভাবে গেল? শিক্ষার্থীরা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনই হয়ত নিয়ম ভেঙে সন্ত্রাসীদের হাতে প্রমাণ তুলে দিয়েছে।
এ পরিস্থিতিতে গত সোমবার দুপুরে ছাত্র কল্যাণ পরিচালক অধ্যাপক আব্দুল্লাহ ইলিয়াস আক্তার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনার আহ্বান জানালেও শিক্ষার্থীদের ভাষ্য, তারা কেবল নতুন পরিচালকের সঙ্গে দেখা করে ফিরে এসেছেন, কোনো আলোচনা হয়নি।
উল্লেখ্য, ১৮ ফেব্রুয়ারি কুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে আন্দোলনের সময় সংঘর্ষে শতাধিক ব্যক্তি আহত হন। পরদিন শিক্ষার্থীরা সব অ্যাকাডেমিক ভবনে তালা দেন এবং সিন্ডিকেট সভায় কুয়েটে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ওই রাতেই তদন্ত কমিটি গঠন করে এবং অজ্ঞাত ৪০০-৫০০ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করে।
২০ ফেব্রুয়ারি শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ সমাবেশে রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলোকে 'লাল কার্ড' দেখিয়ে উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি করেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি শিক্ষার্থীরা ঢাকায় গিয়ে প্রধান উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি দেন, যেখানে ছয় দফা দাবি উত্থাপন করা হয়। এরপর ২৫ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৯তম (জরুরি) সিন্ডিকেট সভায় আবাসিক হল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয় এবং পরদিন শিক্ষার্থীদের হলত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়।
১৪ এপ্রিল অনুষ্ঠিত ১০১তম (জরুরি) সিন্ডিকেট সভায় ৩৭ শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। জনসংযোগ বিভাগের কর্মকর্তা শাহেদুজ্জামান শেখ জানান, ১৮ ও ১৯ ফেব্রুয়ারির ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটির প্রতিবেদন সিন্ডিকেটে উপস্থাপন ও গৃহীত হয়েছে, এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ছাত্র শৃঙ্খলা কমিটিতে বিষয়টি প্রেরণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে ২ মে হল এবং ৪ মে থেকে ক্লাস শুরু করার সিদ্ধান্ত হয়।
এদিকে, খুলনার বাসিন্দা হোচেন আলী গত ১০ এপ্রিল কুয়েটের ২২ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন। মামলায় অভিযোগ করা হয়, ১৮ ফেব্রুয়ারি তিনি কুয়েট রোড দিয়ে বাড়ি ফেরার সময় আসামিরা তাকে মারধর করে ও সোনার চেইন ছিনিয়ে নেয়।
তবে শিক্ষার্থীরা দাবি করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহযোগিতা ছাড়া একজন বহিরাগত ব্যক্তি ২২ জন শিক্ষার্থীর পরিচয় জানতে পারতেন না। তাদের বক্তব্য, প্রশাসনই এই মামলার পেছনে উসকানিদাতা।